Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
বহুস্তরীয় গাফিলতি এবং দুর্নীতির সঙ্গে ঘটনার যোগ বেআব্রু
R G Kar Medical College And Hospital Incident

‘ফাঁসি চাই’ যখন শর্টকাট

প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্যবাসীর দাবি ছিল খুব সোজাসাপ্টা— সুরক্ষাব্যবস্থার গলদ চিহ্নিত হোক, তদন্ত সুষ্ঠু পথে এগোক এবং দোষীরা শাস্তি পাক। কোনও নিক্তিতেই একে খুব বেশি চাওয়া বলে না। বরং ন্যূনতম চাওয়া বললেই ঠিক হয়।

অভিমুখ: আর জি করে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মিছিল, ১৬ অগস্ট।

অভিমুখ: আর জি করে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মিছিল, ১৬ অগস্ট। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:১৭
Share: Save:

হয় ‘সাজানো ঘটনা’, নয় ‘ফাঁসি চাই-এনকাউন্টার চাই’। এ রাজ্যে ধর্ষণকে ঘিরে বর্তমান শাসক শিবিরের চিন্তাভাবনার ট্র্যাক-রেকর্ড দু’টি চরম বিন্দুই স্পর্শ করে ফেলল। সেই পার্ক
স্ট্রিট থেকে আজকের আর জি কর— রাজ্য সরকার যেন একটি পরিক্রমা সম্পূর্ণ করল। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্যবাসীর দাবি ছিল খুব সোজাসাপ্টা— সুরক্ষাব্যবস্থার গলদ চিহ্নিত হোক, তদন্ত সুষ্ঠু পথে এগোক এবং দোষীরা শাস্তি পাক। কোনও নিক্তিতেই একে খুব বেশি চাওয়া বলে না। বরং ন্যূনতম চাওয়া বললেই ঠিক হয়। কিন্তু বর্তমান শাসক দল তার তৃতীয় মেয়াদ সম্পূর্ণ করার কাছাকাছি চলে এসেও এই ন্যূনতম চাওয়াটুকুকে সম্মান করতে শিখল না। বরং নারী-নির্যাতনের যে কোনও ঘটনাকে খাটো করা, হেয় করা, কুৎসায় মুড়ে দেওয়াকেই তার অভ্যাস করে তুলল। অথচ এ রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কি উল্টোটাই সবচেয়ে বেশি করে প্রত্যাশিত ছিল না? কাঠুয়া-উন্নাও-হাথরস-মণিপুর প্রসঙ্গে সতত সরব থাকেন যিনি, উচিত কাজই করেন। কিন্তু ঘরের মাটিতে একটা ঘটনা ঘটলে প্রাণপণ অস্বীকারের চেষ্টা কেন? বাম আমলের বানতলা-বিরাটি-ধানতলা মনে করাবেন, আর পার্ক স্ট্রিট-কামদুনি-কাটোয়া ভুলে যাবেন? যোগী-রাজ্যে এনকাউন্টার হলে ‘হায় হায়’ করবেন, আর নিজেরা সেই ‘এনকাউন্টার’কেই জনমোহিনী দাওয়াই হিসাবে তুলে ধরতে চাইবেন? দিনের পর দিন ধরে অপশাসনের পাহাড় গড়ে তুলে তার পর ‘ফাঁসি চাই’ বলে শর্টকাট খুঁজবেন?

মুখ্যমন্ত্রী নিজে বার বার বলেন, তিনি আন্দোলনের মানুষ। সারা জীবন আন্দোলন করেই এগিয়েছেন। ভুল নেই তাতে। অনেকেই মনে করতে পারবেন ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসের সেই দিনটি। এ রাজ্য তখন নারী-নির্যাতনের পর পর অনেক ঘটনার সাক্ষী। বিশেষ করে চার মাস আগেই ফুলবাগান থানা ব্যারাকের মধ্যে ধর্ষণ নিয়ে তখনও তোলপাড় চলছে। ইতিমধ্যে খবর আসে নদিয়ায় এক মূক-বধির বালিকা ধর্ষিত হয়েছে। মমতা তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ওই বালিকাকে নিয়ে মহাকরণে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। পুলিশ তাঁকে চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে মারতে মারতে বার করে দিয়েছিল। আজকের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই মমতাকে চিনতে পারেন কি?

নাগরিকদের অনেকেই কিন্তু পারেন না। তাঁরা চিনতে পারেননি সেই মমতাকে, যিনি পার্ক স্ট্রিটের পরে বলেছিলেন, সব সাজানো ঘটনা। তাঁরা চিনতে পারেননি সেই মমতাকে— যিনি পুলিশি তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ মেলার পরে তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেনকে অন্যত্র বদলি করে দিয়েছিলেন, যিনি কামদুনির প্রতিবাদীদের ধমকে উঠেছিলেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাটোয়াতে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে মমতা ঘটনাটিকে নস্যাৎ করে বলেছিলেন, ওই মহিলার স্বামী সিপিএম করেন! যেখানে বাস্তবে মহিলার স্বামী প্রয়াত অনেক বছর আগেই। তার দশ বছর পর ২০২২ সালে হাঁসখালির ঘটনাতেও তাঁকে একই ভাবে ধর্ষণকে খাটো করে প্রেমজ সম্পর্কের কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ যে অবলীলায় মেয়েটির রাতে সেমিনার রুমে যাওয়া নিয়ে আঙুল তুলতে পারলেন, সেটা এই অসংবেদনশীল তাচ্ছিল্য ছুড়ে দেওয়া ‘সরকারি ঐতিহ্য’-এরই ধারাবাহিকতা।

লক্ষণীয়, আর জি করের বেলায় মমতা নিজে কিন্তু মৌখিক ভাবে এমন কিছু বলেননি। কোনও ‘ছোট্ট ঘটনা-সাজানো ঘটনা’র তত্ত্ব হাজির করেননি। বরং মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর্বে বোধ করি এই প্রথম নিজে থেকে সিবিআই ডাকতেও রাজি বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এরই পাশাপাশি তাঁরই পুলিশ ও প্রশাসন পর পর এমন সব পদক্ষেপ করে চলল, যাতে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ গেল চুরমার হয়ে। এফআইআর করতে দেরি, সন্দীপ ঘোষকে তড়িঘড়ি ন্যাশনাল মেডিক্যালে পুনর্বহাল করার চেষ্টা, ডাক্তারদের বদলির নোটিস ধরাতে যাওয়া (পরে স্থগিত), হাসপাতালে ভাঙচুর আটকাতে না পারা, ডুরান্ড ম্যাচ বাতিল করা, নিহত চিকিৎসকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে চাওয়া, নাইট ডিউটি থেকে মহিলাদের অব্যাহতির প্রস্তাব— এই প্রত্যেকটি পদক্ষেপ শুধু রাজ্য সরকারের বিপক্ষেই যায়নি, তার মূলগত অভিপ্রায় নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। রাখালের বাঘে খাওয়ার গল্পের মতো সরকারের কোনও ‘সত্যভাষণ’ই এখন যেন আর ‘সত্য’ বলে মনে হচ্ছে না মানুষের কাছে। এমতাবস্থায় ‘ফাঁসি চাই’ বলে আইন আনলেই অবিশ্বাসের বাতাবরণ ঝট করে সরে যাবে, এমন ভাবনা বাতুলতা। তদুপরি, মৃত্যুদণ্ডেই সব সমস্যার সমাধান জাতীয় অতিসরলতার খপ্পরে পা দিয়ে নীতিগত বিতর্কের নতুন দরজা খুলে দেওয়াটাও খুব কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়।

অবশ্য কাণ্ডজ্ঞান বস্তুটি বর্তমানে এ রাজ্যে অতি দুষ্প্রাপ্য। প্রশাসনের কথা তো ছেড়েই দেওয়া গেল! বিরোধী শিবির, নাগরিক সমাজ, মায় সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশও জাগরূকতাকে নানাবিধ ভুয়ো-অতিরঞ্জিত-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-দিগভ্রষ্ট সন্দর্ভ চালাচালির সমার্থক বলে ধরে নিয়েছে। নিত্যদিন নিয়ম করে রচিত হয়ে চলেছে চক্রান্ত-কাহিনি। মানুষ অম্লান বদনে সে সব জরুরি পথ্যের মতো করে সেবন করছেন, প্রচার করছেন, নাগরিক সচেতনতার অঙ্গ বলে মনে করছেন। গণআন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততার একটা বড় অংশ উন্মেষিত হচ্ছে এই ভার্চুয়াল ‘রহস্য-লহরী’র কল্যাণে। ভাইরাল অডিয়ো ক্লিপ থেকে ‘প্রকৃত দোষী’র নামতালিকার কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে। প্রশাসনের প্রতি দীর্ঘপুঞ্জিত অবিশ্বাসের জমি তৈরি ছিল বলেই এটা সম্ভব হল— এ কথা সত্য। একই সঙ্গে এ-ও সত্য— অনবরত জোগানের মধ্যে দিয়েও চাহিদা উৎপাদন করা যায়। ঘটনার কল্পিত বিবরণ, ‘আসল’ ভিলেনদের তালিকা, হরেক ‘ষড়যন্ত্র’-এর পর্দা ফাঁস, অজস্র ‘জেনে নিন-দেখে নিন’ সিরিজ়-এর এমন বাড়বাড়ন্ত এ রাজ্যে আগে এই আকারে দেখা যায়নি, জনমনের দখল নেওয়ার এমন সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসও এতটা ব্যাপ্ত হয়নি।

ইতিহাসের পাঠকমাত্রেই জানেন, যে কোনও বড় ঘটনায় জনপ্রতিক্রিয়া নির্মাণে গুজবের একটা ভূমিকা থাকে। স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার আমলে গুজবের নব রূপান্তর ঘটেছে ভুয়ো খবরের সংগঠিত অবয়বে। অজস্র খাপ পঞ্চায়েত রোজ নিদান হাঁকছে। ফাঁকতালে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা বাড়ছে, রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে। প্রায় সাত লক্ষ রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এই সময়-পর্বে (দ্র. দ্য টেলিগ্রাফ, ৩০ অগস্ট)— তাঁদের ‘জাস্টিস’ নিয়ে শহুরে নাগরিক সমাজের এই মুহূর্তে খুব ভাবনা নেই। সরকারি হাসপাতাল যতটা তাঁদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাঙ্গন, চিকিৎসা পাওয়ার জায়গা তত নয়। ঠিক যেমন সরকারি স্কুল যতটা তাঁদের চাকরিক্ষেত্র, ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠানোর জায়গা তত নয়।

এই চালচিত্রকে সঙ্গী করেই আর জি করের ঘটনা এবং তৎপরবর্তী আন্দোলন পায়ে পায়ে এক মাস ছুঁতে যাচ্ছে। ধূপগুড়ি (২০১৪) বা মধ্যমগ্রাম (২০১৪) বা হাঁসখালি (২০২২) যা পারেনি, আর জি কর সেটা পেরেছে— ভদ্রবিত্তের নিরাপত্তাবোধে সরাসরি আঘাত হেনেছে সে। আন্দোলনের চালিকাশক্তিও ভদ্রবিত্তের হাতে। নারীসুরক্ষার গলদ দূরীকরণ, ধর্ষণ ও নিগ্রহ প্রতিরোধের ডাক, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ— এ সবই জরুরি কাজ নিঃসন্দেহে। কিন্তু সবার আগে সরকারকে উপলব্ধি করতেই হবে— সরকারি হাসপাতালে যখন কোনও চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণ ঘটে যায়, তখন সেটা সব কিছু ছাপিয়ে প্রশাসনিক-প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে সীমাহীন ব্যর্থতা। বহুস্তরীয় গাফিলতি এবং দুর্নীতির সঙ্গে তার যোগ বেআব্রু। নানাবিধ অবরুদ্ধ অসন্তোষের লকগেট খুলে যাওয়ার রাস্তা অতএব প্রস্তুত। ‘ফাঁসি চাই’-এর শর্টকাট তার প্রতিষেধক নয়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বার ভেবে দেখতে পারেন, এই অবস্থায় মমতা নিজে বিরোধী নেত্রী থাকলে কী করতেন, কতটা করতেন। ইতিহাস বলছে, এ রাজ্যের মানুষ খেপে উঠতে সময় নেন। কিন্তু এক বার খেপে উঠলে ‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩০’-এর আত্মবিশ্বাসও গুঁড়িয়ে যেতে সময় লাগে না। আর কেউ না জানুক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা খুব ভাল জানেন না কি?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy