ভোট-যুদ্ধ যত এগিয়ে আসছে, বাঙালি মনীষীরা তত ব্যবহৃত হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি চলছে। তিনি বিপ্লবী, অতিবিপ্লবী, না কি উদারনৈতিক নাগরিক সমাজের ধ্বজাধারী, তা নিয়ে কথা উঠছে-পড়ছে। এই সব কথার একটাই উত্তর: রবীন্দ্রনাথের দায় নিজেরই কাছে। তাঁর চলায় অন্যরা এসে কখনও কখনও মেশেন বটে, কিন্তু ভাবনা ও সে-ভাবনার রূপায়ণে নিজের পথকেই গুরুত্ব দেন তিনি, তাই একলাই চলতে হয় তাঁকে। তিনি উদ্ধত বিপ্লবী, না কি শীলিত ভদ্রলোক? তাঁর সে দিনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নীতিতে কিছু সূত্র মিলতে পারে।
১৯২২, ২৩ জুলাই, রবিবার। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। সংসদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ, সদস্য দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ়, এলম্হার্স্ট, ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর, জগদানন্দ রায় প্রমুখ। মহিলারাও সদস্যপদ পেয়েছেন— আছেন স্নেহলতা সেন, কিরণবালা সেন, হেমলতা ঠাকুর। পুরুষে-মহিলায় মিলে প্রতিষ্ঠানের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চাই। শান্তিনিকেতনের আদিপর্বে বালিকা বিদ্যালয় খোলা হয়েছিল, ১৯১০-এ তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯২২-এ যখন পরিবেশগত আনুকূল্য পাওয়া গেল, তখন পুনরায় খুলে গেল তা। সংসদ সদস্যদের মধ্যে স্নেহলতা সেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের মেয়ে। পুত্র-কন্যা নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। লোরেটোর ছাত্রী, ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে তাঁর বিশেষ অধিকার ছিল। সুশিক্ষিত স্নেহলতা ১৯২২-এ নারীবিভাগের অধ্যক্ষ। সংসদেরও অন্যতম সদস্য। ঘরে-বাইরে উপন্যাসে বিমলাকে বাইরে এনে নতুন করে গড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘স্ত্রীর পত্র’-র মৃণাল তার স্বামীর চরণতলাশ্রয় ছিন্ন করতে পেরেছিল। সাহিত্যে যা হয়, বাস্তবে তার কিছুই কি হবে না? প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অনিবার্য।
সংসদ হল বিশ্বভারতী পরিচালনার কার্যনির্বাহী সভা। কিশোর রবি স্কুল-পালানো ছেলে হতেই পারে, কিন্তু পরিণত রবীন্দ্রনাথ তো আর স্কুল-পালানো নন। তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে সচল রাখার জন্য তিনি নানা সময়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিলেন প্রশাসনিক কাঠামো। ব্রহ্মচর্যাশ্রম যখন বিশ্বভারতীতে সম্প্রসারিত হল, রবীন্দ্রনাথ যখন ভাবছেন ‘এই institution-টার প্রসার সমস্ত পৃথিবীতে’ (প্রমথ চৌধুরীকে লিখিত পত্র), তখন তো সেই প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ প্রশাসনিকতার আওতায় আনতে হবে। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সভাপতিত্বে ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদ্যালয়কে সর্বসাধারণের হাতে উৎসর্গ করলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মোক্ষম টিপ্পনী: “এই সাধারণ বা পাবলিক বিশ্বসংসারের জনতা নহে। বিশ্বভারতীর সদস্য বা মেম্বররা এই পাবলিক...।” ঠিকই তো, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠানকে তো ‘অনিয়ন্ত্রিত’ জনতার হাতে তুলে দিতে পারেন না।
সদস্য দু’রকম। যাঁরা বছরে বারো টাকা দেন তাঁরা সাধারণ সদস্য; আর যাঁরা এককালীন আড়াইশো টাকা দিলেন, তাঁরা আজীবন সদস্য। এই দু’রকম সদস্য নিয়ে গঠিত হল ‘বিশ্বভারতী পরিষদ্’। কবির প্রতিষ্ঠানে বিশ্বসংসারের জনতা টাকা দেবেনই বা কেন? তাঁরাই অর্থ দেবেন, যাঁদের কবির শিক্ষানীতির উপর আস্থা আছে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে এই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মূল ভাবনা হল আত্মসম্প্রসারণ— এ ভারতবর্ষের জিনিস হতে পারে, কিন্তু একে সমস্ত মানবের তপস্যা ক্ষেত্র করা চাই, এই ছিল রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে। ১৯২২ সালের ১৬ মে বিশ্বভারতীর সংবিধান কলকাতায় ‘রেজিস্টারী’ হল। ‘বিশ্বভারতী পরিষদ্’ আর বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের থেকে নির্বাচিত ও মনোনীত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হল ‘সংসদ’— বিশ্বভারতী পরিচালনার কার্যনির্বাহী সভা। তারই প্রথম অধিবেশন বসেছিল সেই রবিবারে।
এই পরিচালন সভায় কেমন করে কথা বলবেন সদস্যরা? কেমন করে কোন ভাষায় কথা বলা উচিত, নানা ক্ষেত্রে তা নিয়ে তো রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু ভেবেছেন। প্রাদেশিক কংগ্রেসে গ্রামের কৃষকদের সামনে নেতারা অনর্গল ইংরেজি বলে যাবেন, এমন ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করে রাজনীতির ভাষায় বাংলার প্রয়োগ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাউল গানের সুরে বেঁধেছেন দেশের জন্য গান। সেই মেঠো সুরের টানে সেই সব গান অনেকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। তাঁর বিমলা-মৃণাল এক রকম করে বলেছে তাদের কথা। এ বার নিজের প্রতিষ্ঠানে কী ভাষায় কী ভাবে কথা বলা উচিত, তার দস্তুর স্থির করতে হল।
রবীন্দ্রভবনে সযত্নে রক্ষিত ‘বিশ্বভারতী পেপারস’-এর মধ্যে রয়েছে সংসদের ‘রুলস অব প্রসিডিয়র অ্যান্ড বিজ়নেস’। সংসদের সভায় কেমন করে কথা বলবেন সদস্যরা, তার সমস্ত খুঁটিনাটি নির্দেশ ছিল সেখানে। এখন এত বছর পরে সেই নির্দেশাবলি পড়তে গিয়ে কৌতুক বোধ হয়, আবার ভালও লাগে। কৌতুক বোধ হয় এই কারণে যে, সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণে যেমনই হোন না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কিন্তু বিশেষ নিয়মনীতির পক্ষপাতী তিনি, নিজের ‘মত’ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্ধত বাক্সঞ্চালনাকে সমর্থন করছেন না।
আবার ভাল লাগে এই ভেবে যে, ঔদ্ধত্য যেমন তাঁর কাম্য নয়, তেমনই বাক্বিনিময়ের পথকে কোনও ভাবেই রুদ্ধ করেননি। বাক্বিনিময় তো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সদস্যদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা যাতে বজায় থাকে, নির্বিঘ্নে যাতে কথা বলা যায়, সে বিষয়ে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। যাঁরা এই সংসদের সদস্য, তাঁরা সকলেই দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন বিশিষ্ট মানুষ। তাঁদের কথা বলার শিষ্টাচার শেখানোর মানে হয় না। তবু ভব্যতার বিধি-বিধান সবই শেখানো হয়েছে। পরবর্তী কালে ভব্যতা যাতে বজায় থাকে, সে জন্যই হয়তো সংসদের অধিবেশনের গোড়াতেই তা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
কী ছিল সেই সব নিয়ম? পয়েন্ট করে ইংরেজিতে সাজানো সেই সব বিধি নিষেধ বাংলায় দাখিল করা যাক। সভায় সদস্যরা বসে কথা বলতে পারবেন। সভার কার্যাবলি ইংরেজিতেই চালানো হবে, তবে সদস্যরা বাংলা বা ইংরেজি যে কোনও ভাষাতে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। বাংলা ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষা ব্যবহার করলে কর্মসচিবের অনুমোদন নিতে হবে। সেই ভাষা সদস্যরা যাতে বুঝতে পারেন, তার জন্য বক্তব্যের মর্মার্থ বোধগম্য ভাষায় জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা চাই। ভাষার সঙ্গে শিষ্টাচারও জরুরি। এক সঙ্গে সবাই কথা বলতে পারবেন না, একে একে কথা বলতে হবে। যে কোনও কথাই সভাপতিকে উদ্দেশ বলা চাই, সদস্যরা সভায় কোনও বিষয় নিয়ে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে পারবেন না। সভাপতির হাতে রইল বিশেষ ক্ষমতা। তিনি থামিয়ে দিলে কোনও সদস্য তাঁর বক্তব্য সভায় আর পেশ করতে পারবেন না। ‘নো স্পিকিং মেম্বার শ্যাল প্রসিড উইথ হিজ় স্পিচ আফটার দ্য চেয়ারম্যান হ্যাজ় আস্কড হিম টু স্টপ।’ মনে হতে পারে, সভাপতির হাতে বুঝি অগাধ ক্ষমতা। তা কিন্তু নয়, এ হল সভার শিষ্টাচার। সভা কোনও বিষয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করলে কাউকে তো রাশ টানতেই হবে। না হলে কথা চালানো যাবে কী ভাবে? সভাপতি ও সদস্য উভয় পক্ষ পরস্পরকে কী ভাবে সম্বোধন করবেন তাও বলা ছিল সেখানে। সদস্যরা বলবেন ‘মহামান্য সভাপতি মহাশয়’, আর সভাপতি বলবেন ‘মান্যবর সদস্য মহাশয়’। সভার মধ্যে কথা বলতে চাইলে সদস্যকে ডান হাত তুলে অপেক্ষা করতে হবে, সভাপতি হাত তোলার ক্রমানুসারে তাঁদের কথা বলতে আহ্বান জানাবেন। একই বিষয়ে সদস্যরা এক বারের বেশি কথা বলার সুযোগ পাবেন না, তবে কোনও সদস্যের অভিমত যদি অপর কোনও সদস্য ‘ভুল বোঝেন’, তা হলে হাত তুলে সভাপতির অনুমতি নিয়ে নিজের অভিমত ব্যাখ্যা করার সুযোগ মিলবে। তবে কোনও বিষয়ের উত্থাপক যে হেতু সবার আগে কথা বলেছেন, সে হেতু তিনি আর এক বার কথা বলার সুযোগ পাবেন।
অনেকেই লেখাপত্রের সূত্রে রবীন্দ্রনাথকে যে রকম ‘বিপ্লবী’ বলে মনে করেন, ১৯২২ সালে নথিভুক্ত সভা পরিচালনার এই বাক্বিধি পড়ে হয়তো সে রকম ‘বিপ্লবী’ বলে আর মনে করবেন না। এই নিয়মনীতির মধ্যে তাঁরা হয়তো খুঁজে পাবেন নিয়মতান্ত্রিক রক্ষণশীল এক রবীন্দ্রনাথকে। পেতেই পারেন, তবে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনই অপরিকল্পিত আবেগের বশবর্তী হয়ে তাৎক্ষণিক কোনও কাজ করার পক্ষপাতী নন। তরুণদের অবিবেচনার শক্তিকে তিনি স্বীকার করেন, সেই অবিবেচনা যে স্থিতিশীল বঙ্গদেশের চণ্ডীমণ্ডপের অন্ধতাকে প্রশ্ন করে, তা মানেন। তাঁদের সেই অবিবেচনার জন্য ঔপনিবেশিক শিক্ষাতন্ত্রীরা যে ভাবে শাস্তির খড়্গ তোলেন রবীন্দ্রনাথ কখনও তা করেন না। সাহেব-শিক্ষকের সঙ্গে লড়াইয়ে ছাত্র সুভাষচন্দ্রের পক্ষ নেন নির্দ্বিধায়। তবে তরুণের আবেগকে তিনি কর্মের নীতিতে কাজে লাগাতে চান। এই রবীন্দ্রনাথই তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংসদের কাজ চালানোর জন্য তৈরি করেন বাক্বিধির নানা নিয়ম। ভদ্রতা বজায় রেখে কথা চালানোর সে এক উপায় বলেই তাঁর ধারণা। আর, পুরনো ভারতে দার্শনিক বিষয়আশয় নিয়ে যে তর্কপদ্ধতি প্রচলিত ছিল, বা গ্রাম-সমাজের অধিবেশন যে ভাবে পরিচালিত হত, তার সঙ্গে এই সভা পরিচালন রীতির মিল নেই। এ প্রায় পুরোটাই পাশ্চাত্যের বাক্সংস্কৃতির অনুসারী। দার্শনিক বিষয়ের প্রতিষ্ঠা বা গ্রাম-সমাজের পরিচালন যে ভাবে করা হত, সে ভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চালানো মুশকিল— এ কথাই হয়তো ভাবছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy