প্রস্তুতি: ‘কথা বলতে বলতেই— আর একটু পা চালিয়ে...’। কলকাতা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
মহানগরের ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাসন্ন জনসভার প্রস্তুতিপর্বে একটি গানের ‘প্যারডি’ নিয়ে বেশ কয়েক দিন যাবৎ কথার পিঠে কথা চলেছে। মতের উত্তরে বিপরীত মত, যুক্তির পাল্টা প্রতিযুক্তি, ব্যঙ্গের জবাবে বিদ্রুপ। এবং, অধুনা এই সমাজে যা প্রায় অবধারিত— তর্ক ছাপিয়ে উঠেছে তরজা, বাঁধ ভেঙেছে দলাদলি, গোষ্ঠীকোঁদল আর ব্যক্তিগত আক্রমণের, কুরুপাণ্ডব আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে, প্রত্যেকের কাছেই আছে সব প্রশ্নের নির্ভুল, নিশ্চিত এবং একমাত্র উত্তর।
অথচ প্রশ্নগুলো রীতিমতো জটিল। হ্যাঁ কিংবা না, ভাল অথবা খারাপ— এমন ছকে তাদের উত্তর দেওয়া কঠিন। একেবারে গোড়ার প্রশ্নটাই ধরা যাক। বামপন্থী রাজনীতির চর্চায় জনরুচিকে কী ভাবে দেখা হবে? এ-সমস্যা বহুচর্চিত। সেই ইতিহাস মনে রেখেই ভেবে দেখা যায়— যে-গান বহুজনের প্রিয়, তার সুরে ও ছন্দে, তারই কথার কাঠামোয় প্রচার-সঙ্গীত বেঁধে যদি অনেক মানুষকে আকর্ষণ করা যায়, ক্ষতি কী? বিশেষ করে, আজকের পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির পক্ষে বহুজনের কাছে পৌঁছোনো যখন আর সহজ নয়? হতে পারে, জনপ্রিয়তার সুযোগ নিতে গিয়ে ‘রুচি’র মাপকাঠিতে আপস করতে হল। হতে পারে, মূল জন-সঙ্গীতটির অলখ টানে তার নতুন গণ-সংস্করণটিও পিতৃতন্ত্রের মূল্যবোধকেই নিরাবরণ এবং নির্লজ্জ প্রশ্রয় দিল। হতে পারে, সস্তায় বাজিমাত করবার তাড়নায় জনতার পছন্দ-অপছন্দের দোহাই দিয়ে বাজার-সফল চটুলতাকেই আরও এক বার জনরুচি নির্মাণের বাজারে চালিয়ে দেওয়া হল, যে বাজার রকমারি চাহিদা তৈরি করেই চলেছে। কিন্তু তার পরেও তো এই সত্য থেকেই যায় যে, বহু মানুষ এ-গানের কল্যাণে জনসভার প্রচারে কান দিলেন, প্রচারের কিছু কথা অনেকের মন অবধি পৌঁছল, তাঁদের একাংশের চেতনা হয়তো কথার টানে ব্রিগেডের রাজনীতির পাশে দাঁড়াল, হয়তো বা থেকেও গেল তার সঙ্গী হয়ে। এই সাফল্যকে, অন্তত সাফল্যের সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করা যায় কি?
একটা বিশুদ্ধ নৈতিক অবস্থান থেকে কেউ বলতেই পারেন: ব্যর্থ হই হব, একলা চলতে হলে একলাই চলব, তাই বলে রুচির প্রশ্নে, মূল্যবোধের প্রশ্নে আপস? নৈব নৈব চ। এমন কঠোর বিধান নিয়ে সমস্যা দুটো। প্রথম সমস্যা ব্যবহারিক— এই অবস্থানে অবিচল থেকে রাজনীতির চলে না, মানুষকে সঙ্গী না করতে পারলে সে পপাত চ মমার চ। দ্বিতীয় এবং গভীরতর সমস্যা— রুচি বা মূল্যবোধ সমাজবাস্তব থেকেই উঠে আসে, বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গেই তার বিবর্তন ঘটে। বাস্তব পরিস্থিতিকে জড়িয়ে নিয়েই তার বিচার করা দরকার, তা না হলে নীতিবাগীশরা হাজার টেবিল চাপড়ালেও পাবলিক যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে। বস্তুত, আমাদের বামপন্থী দলনেতাদের নীতিবাগীশ মানসিকতা নিয়ে বরাবরই বিস্তর নিন্দেমন্দ হয়েছে। আর তাই, সন্দেহ হয়, সেই অপবাদ ঘোচানোর তাগিদেই তাঁদের কেউ কেউ এ-বার সাত তাড়াতাড়ি গানটিকে সমাজমাধ্যম মারফত দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে তৎপর হননি তো? সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে দেখলে তাঁরা নিজেদের এই প্রচারে জড়াতেন কি?
সে কথা থাক। বড় প্রশ্ন হল, ব্রিগেডে মিটিং করতে হবে বলে আজ এমন ‘গান’-এর দোর ধরে জনগণমন পাওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে কেন। অনেকেই দুঃখ করে বলেছেন: এক দিন আলোর পথযাত্রীদের সংগ্রামী আহ্বান জানাত সলিল চৌধুরীর সেই সব কথা আর সুর, আর আজ...। আক্ষেপ সত্যিই হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত আক্ষেপকে এক পাশে সরিয়ে রেখে ভাবা দরকার, সমাজ ও রাজনীতির যে মিথস্ক্রিয়ায় সংগ্রামের গান তৈরি হয়, তৈরি হয় প্রতিস্পর্ধী সংস্কৃতি, তার এই দুর্বলতা এবং দৈন্য আমাদের বাস্তব হয়ে উঠল কেন? বামপন্থী রাজনীতির সমাজ-সংযোগের দুর্বলতা এবং দৈন্যই কি এর কারণ? দীর্ঘদিন শাসক দলের ভূমিকায় থেকে আমাদের বামপন্থীরা কি একটা আত্মঘাতী দ্বন্দ্বের ফেরে পড়ে গেছেন? হয় তাঁরা ক্ষমতার জোরে সমাজকে শাসন করবেন, নয়তো সমাজের দ্বারা— অতএব কার্যত বাজারের দ্বারা— শাসিত হবেন? হয় সব কিছুর গায়ে সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতির সিলমোহর লাগিয়ে দেবেন, নয়তো যা কিছু ‘জনপ্রিয়’— অর্থাৎ বাজার-সফল— তাকেই নির্বিচারে মেনে নেবেন? সমাজের মাথায় বসে নয়, তার পাশে থেকে তার সঙ্গে নিরন্তর আদানপ্রদান এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার বামপন্থী দায়িত্ব কী ভাবে পালন করতে হয়, সেটাই কি তাঁরা ভুলে মেরে দিয়েছেন? অতএব হয় আধিপত্য, নয় আত্মসমর্পণ? মাঝে কিছু নাহি আর?
পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক পরিস্থিতি এতটা কঠিন বলেই বামপন্থী রাজনীতি ও তার সাংস্কৃতিক দর্শনের ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সঙ্গে সে-রাজনীতির বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাববার দায়িত্ব, সেই ভাবনার সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রমের সংযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব। তার কোনও নীল নকশা হয় না। দলের নেতারা (এবং, আজও অনেকখানি পিছনে থেকে) নেত্রীরা সদর দফতরে বসে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ঠিক করে দেবেন আর কর্মী ও অনুগামীরা তা রূপায়ণ করবেন— এই ধারণার কানাগলি থেকে বেরিয়ে পথ খুঁজতে হবে। তার প্রথম শর্ত মানুষের কথা শোনা। শোনা মানে মেনে নেওয়া নয়। বাজারে যা চলছে, তাকেই বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা নয়। কিন্তু আন্তরিক ভাবে শোনা। এবং তার ভিত্তিতেই মানুষের সঙ্গে কথা বলা। কথোপকথনের সংস্কৃতি তৈরি করা।
সেই কথোপকথন চালাতে হবে বামপন্থী নৈতিকতার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই, যে নৈতিকতা শোষণমুক্তি এবং সামাজিক ন্যায়ের মৌলিক লক্ষ্যে অবিচল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন মতের বিভিন্ন স্বরের মানুষের সঙ্গে অবিরত আলাপের মধ্যে দিয়েই, তাঁদের দাবিদাওয়া, অভাব-অভিযোগ এবং তাদের ঘিরে গড়ে ওঠা নানান ছোট বড় সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে নিরন্তর সংযোগ সাধনের পথ ধরেই বামপন্থী রাজনীতি এবং সংস্কৃতি অগ্রসর হতে পারে। রুচির প্রশ্নে, মূল্যবোধের প্রশ্নে আপস না করে, সেই প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করেই নতুন রাজনীতি গড়ে তোলার সম্ভাবনাও এই পথে জাগ্রত থাকে। পশ্চিমবঙ্গে সেই নতুন রাজনীতির বিপুল সম্ভাবনা ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে হেলায়— এবং ক্ষমতা ধরে রাখার তাড়নায়— হারিয়েছেন। আজ তার বহু কুফল দেখছি আমরা, ভুগছিও। তার একটি উদাহরণ— সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে বামপন্থী রাজনীতি যদি নারী-পুরুষের অধিকারসাম্যের প্রসারে যথেষ্ট মনোযোগী হত, তা হলে আজ হয়তো প্যারডি গানের অন্তর্নিহিত পিতৃতন্ত্র নিয়ে শোরগোল তোলার দরকারই হত না, কারণ জনপ্রিয় গানের ভুবনে সেই তন্ত্রের এমন একচ্ছত্র রাজত্ব জারি থাকত না। এ যে নিছক কল্পনাবিলাস নয়, তার প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে— এই নিতান্ত সীমিত এবং সাময়িক আলোড়নের কল্যাণেই দেখতে দেখতে ব্রিগেডের গানের নতুন নতুন জবাবি সংস্করণ উঠে আসছে সমাজের ভিতর থেকে, মেয়েরা সেখানে আর অনুগামিনী নয়, স্বাধীন স্বক্ষম সহগামিনী। আবার এরই পাশাপাশি উঠে আসছে জনপ্রিয় সংস্কৃতির নতুন আঙ্গিকে প্রতিস্পর্ধার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। এরই নাম সম্ভাবনা। রাজনীতি যে সম্ভাবনার শিল্প।
ব্রিগেডে মিটিং হবে, মিটিং শেষও হবে। কথার পাহাড় পার হয়ে— এবং কথা বলতে বলতেই— এ-বার আর একটু পা চালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। নতুন ব্রিগেডের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy