Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Women Harassment

উড়ানহীন প্লাস্টিক-ডানা

সংসদীয় রাজনীতিতে প্রার্থীর ‘ভাবমূর্তি’, ‘ভাবমূর্তি গঠন’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরুষ-প্রার্থী আর নারী-প্রার্থীর ভাবমূর্তি গঠনের ধরনটি আলাদা।

—প্রতীকী চিত্র।

শতাব্দী দাশ
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৫
Share: Save:

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, প্রচারকালীন শব্দকল্পদ্রুম তত মনে করিয়ে দেয়, সংসদীয় রাজনীতি আর লিঙ্গরাজনীতির মধ্যে বোঝাপড়ার এখনও ঢের বাকি। এ শুধু ভারতের সমস্যা নয়। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী গণমাধ্যম এক সময় হিলারি ক্লিন্টনের কথনভঙ্গিকে ‘ইয়েলিং’ আর ‘স্ক্রিমিং’ বলে উল্লেখ করত। তবে কি নারী-প্রার্থী হবেন ‘নারীসুলভ’ ও কোমল? তা হলে ভোটার তাঁকে দুর্বল ভাবতে পারেন। তিনি কি উগ্ররূপা হবেন? তাতেও যে বড় পুরুষালি দেখায়! ‘মেয়েলি' আর ‘পুরুষালি’-র নিখুঁত ভারসাম্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠতে হয় তাঁকে, বা তার ভান করতে হয়। এক দিকে দৃঢ়, অপর দিকে স্নেহময়ী কল্যাণী।

সংসদীয় রাজনীতিতে প্রার্থীর ‘ভাবমূর্তি’, ‘ভাবমূর্তি গঠন’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরুষ-প্রার্থী আর নারী-প্রার্থীর ভাবমূর্তি গঠনের ধরনটি আলাদা। প্রার্থীর সম্পত্তির হিসাব স্বচ্ছ ভাবে জনতার দরবারে পেশ করার নিয়ম, কিন্তু আসলে প্রার্থীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনও জনগণের আতশকাচের তলায় আসে। লরা মালভে-র ‘মেল গেজ়’-এর সূত্র অনুযায়ী যদি ক্যামেরার চোখ, সমাজের চোখ, আমার-আপনার-সবার চোখ জারিত হয় পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গিতে, তা হলে নারী-প্রার্থীর ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিশ্লেষণের আওতায় আসার কথা নারীশরীরের— ভোটারের কাছে, বিপক্ষের কাছে, নিজের দলের কাছেও। এ ছাড়া প্রাসঙ্গিক তাঁর যৌনচরিত্র, বাচনভঙ্গি, পোশাক, হাঁটাচলা। তিনি যদি পুরুষ-নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘সুন্দরী’ না হন, তবে বিপক্ষের পোস্টারে তাঁকে ‘কাজের মেয়ে’ বলে ডাকা হয়— মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল। উল্টোটা হলে তাঁর নামে ভুয়ো পর্নোগ্রাফিক ছবি প্রচার হয়, যেমন হয়েছিল ২০২১ সালে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি বিধানসভায় নির্দল প্রার্থী রাফিকা সুলতানার ক্ষেত্রে। ২০১৯ সালে মডেল/অভিনেত্রী গুল পনাগকে আপ প্রার্থী ঘোষণা করার সম্ভাবনা তৈরি হতেই তাঁরও ছবি বিকৃত করে ছড়ানো হয়েছিল। অতিশী মারলেনার বিরুদ্ধে প্রচারিত হয়েছিল যৌন কেচ্ছার বর্ণনাসম্বলিত লিফলেট। প্রশ্ন উঠেছিল, তাঁর প্রচারে কেন ‘স্বামী’ আসেন না?

সংসদীয় গণতন্ত্রে সচরাচর মহিলা প্রার্থীরা ওজনদার পুরুষ নেতার মেয়ে, বৌ বা পুত্রবধূ। তার অন্যথা হলে চোখে লাগে বিরোধীদের, ভোটারদেরও। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, ঊনত্রিশটি দেশের ৪৪% মহিলা রাজনীতিককে খুন, ধর্ষণ বা অপহরণের হুমকি পেতে হয়েছে, অথবা সত্যিই এমন ঘটনা ঘটেছে তাঁদের সঙ্গে। ভোটরঙ্গের নিরন্তর নারীবিদ্বেষী ভাষার পাশে বেমানান লাগে যাবতীয় ইস্তাহারের নারীভোটার-মুখী প্রতিশ্রুতিকে।

সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুমন্তব্য করেছেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। তবে কি শুধু পুরুষরাই এমন আক্রমণ করেন? কংগ্রেসের প্রার্থী তথা হেভিওয়েট কংগ্রেস নেতার স্ত্রী তথা পুত্রবধূ সুপ্রিয়া শ্রীনতে মণ্ডীর বিজেপি প্রার্থী অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের প্রতি যে ইঙ্গিত করেছেন, তা নারীকে হেনস্থা করার জন্য পুরুষের অতি পরিচিত অস্ত্র। কঙ্গনা ন্যায্যতই সমবেদনা ও সহানুভূতি পেয়েছেন। কিন্তু নীতিগত ভাবে কঙ্গনারও বিরোধীদের প্রতি সেই অস্ত্র ব্যবহারে আপত্তি নেই বলেই মনে হয়। তিনিই এক সময় কংগ্রেস প্রার্থী উর্মিলা মাতন্ডকরকে ‘সফট পর্ন অ্যাক্টর’ বলেছিলেন। এই মুহূর্তে সমাজমাধ্যমে মিয়া খলিফার সঙ্গে তুলনা চলছে রাহুল গান্ধীর সমর্থক এক বিজেপি-বিরোধী ভোজপুরি গায়িকা নেহা সিংহ রাঠোরের। অর্থাৎ, মূলগত ভাবে প্রার্থী-নারীকে শুধুমাত্র শরীর— ভোগযোগ্য শরীর— হিসাবে দেখা নিয়ে কোনও দলের, কিংবা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনও নেতা বা সমর্থকেরই নীতিগত আপত্তি দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবাদ থেকে নীতি বাদ দিলে হাতে পড়ে থাকে দলীয় কোন্দল।

যদি কোনও মহিলা রাজনীতিককে নিয়ে সদর্থক প্রচার হয়, তা হলেও কি সেই দেখায় নারী একটি শরীরের বাইরে আর কিছু হয়ে উঠতে পারেন? শশী তারুর কিছু দিন আগে ছয় নারী সাংসদের সঙ্গে সেল্ফি শেয়ার করে সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, তাঁর কাজের জায়গাটি বেশ চিত্তাকর্ষক! প্রশংসাই করেছিলেন সহ-সাংসদদের; কিন্তু কিসের প্রশংসা? সুন্দর শরীর বা মুখশ্রীর প্রশংসা অপরাধ নয়। কিন্তু শুধুমাত্র শারীরিক বর্ণনায় প্রশংসা মাথা কুটে মরলে, তা নারীর বস্তুকরণ। বিশেষত যেখানে শারীরিক সৌন্দর্যের প্রাসঙ্গিকতা নেই, সেখানে তা নিয়ে শুধু নিন্দাবাক্য নয়, প্রশংসাবাক্যও শরীরেই আটকে রাখছে মননকে। শাসক দলের প্রার্থী ও অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলে বসেন যে, হুগলির মানুষ সৌভাগ্যবান কারণ তাঁরা তাঁর দেখা পাবেন— তখন তিনি নিজের রুপোলি পর্দার নায়িকার ইমেজটি সম্পর্কে সচেতন, যে ইমেজ অনেকাংশে দৈহিক রূপ-নির্ভর। অর্থাৎ, তিনি নিজেই নিজেকে বেঁধে ফেলছেন শরীরের চৌহদ্দিতে। বামপন্থী দলের তমলুক কেন্দ্রের প্রার্থী শাঁখা-পলাশোভিত নববধূকে নিয়ে প্রচারে বেরোচ্ছেন। বাড়ির মেয়ে-বৌ দেহে সনাতনী সংস্কারচিহ্ন ধারণ করলে পুরুষটির প্র‍তি জনগণের আস্থা বাড়ে হয়তো— তাঁকে মনে হয় স্থিতাবস্থার ধারক ও রক্ষক। কিন্তু বদলের কান্ডারি মনে হয় কি?

কিছু দিন আগে দেখলাম, সিপিএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধরকে রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে এক রচনাধর্মী ই-পোস্টারে। ‘কৃষ্ণকলি’ গানে, গাঁয়ের লোক যে মেয়েকে ‘কালো’ বলে বাতিল করে, তারই হরিণচোখে কবি খুঁজে পান অপার রহস্য। নারীসৌন্দর্যের সামাজিক আর ব্যক্তিগত সংজ্ঞার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কিন্তু সে সৌন্দর্যও দেহাতীত নয়, সে নজরও পুরুষের— এক গ্রাম্যবধূর সৌন্দর্যের প্রতি এক নাগরিক পুরুষের। সে নারীসৌন্দর্যের আর এক ব্র‍্যান্ড। দীপ্সিতা, আশা করা যায়, ধীময়ী, সংগ্রামী যুবনেত্রী। পুরুষচোখে কালোরূপের মোহময়ী ইমেজ-এ আটকা পড়তে তিনি কি রাজি? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।

পরিদের ডানা বড় বালাই। কেটে-ছেঁটে ফেলা যায়। তার পর ক্ষতমুখ খোলা থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো কাজ হল অর্ডারি প্লাস্টিক ডানা জুড়ে দেওয়া সে জায়গায়। তাতে উড়ানবিহীন ডানার ভ্রম তৈরি হয়। পুরুষতন্ত্রের কাছে সেই ভ্রমটি বড়ই আকর্ষণীয়, বড়ই স্বস্তিদায়ক।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy