নারীবাদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিসর ইদানীং বহুলাংশে বেড়েছে। প্রতীকী ছবি।
বিমল করের অসময় উপন্যাসের নায়ক অবিন এক বার পুরনো পত্রিকার তাড়া খুলে তার বাল্যে প্রয়াত মায়ের একটি ছোট্ট পদ্য ছাপার অক্ষরে আবিষ্কার করেছিল। সেই পদ্যের প্রথম পঙ্ক্তিটি ছিল, আমি থাকি নিজ মনে। অবিনের মনে হয়েছিল, এই সংসারের মধ্যে তার মায়ের একটি নিজস্ব জগৎ ছিল আসলে। যেখানে তিনি নিঃসঙ্গ, নিজের দুঃখের সঙ্গে নিজে একলাটি। আমি থাকি নিজ মনে, যেন সেই একান্ত নির্জনতার একটি উচ্চারণ। অবিনের মা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কথা জানতেন না। জানতেন না নারীবাদের কথাও। কিন্তু সাংসারিক ঘনঘোরের মধ্যে নিজ মনটিকে বাঁচিয়ে রাখা আর সেই মনকে সঙ্গ দেওয়ার কাজটি তিনি সঙ্গোপনে করে গিয়েছিলেন। নারী দিবস, নারীবাদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিসর ইদানীং বহুলাংশে বেড়েছে। মেয়েদের জীবন, মেয়েদের অধিকার, মেয়েদের কাজ, মেয়েদের আত্মপ্রকাশ নিয়ে তর্কবিতর্কের খই ফুটছে সর্বত্র। সেটা এক দিক থেকে অনেকখানি আশার কথা অবশ্যই। কিন্তু প্রতিস্বরও ক্রমশ বাঁধা সড়কে পর্যবসিত হলে নিজ মনটি কোথাও হারিয়ে যায় কি না, সে কথাটাও বোধ হয় ভেবে দেখা দরকার।
১৯৭৭ সাল থেকে ৮ মার্চ দিনটিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ (গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার) যখন রাশিয়ার নারী-শ্রমিকরা রুটি আর শান্তির দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্য ভোটাধিকার আদায় করে ছেড়েছিলেন, তখন তাঁরা জানতেন না, ৮ মার্চ এক দিন সারা পৃথিবী জুড়ে নারী-আন্দোলনের অন্যতম দিশারি হয়ে উঠবে। তাঁদের সেই অর্জন এবং নারী-আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অর্জনই ৮ মার্চকে বিশ্বব্যাপী উদ্যাপনের মূল ধারায় সংযুক্ত করেছে। নারীর অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এর গুরুত্ব অসীম। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখা দরকার, শুধু মনে রাখা নয়, সচেতন থাকা দরকার যে— যখনই কোনও প্রতিস্পর্ধী কণ্ঠ ধীরে ধীরে তার নিজেরই সাফল্যে, নিজেরই শক্তিতে মূলস্রোতে মিশতে থাকে, মূলস্রোতও তার নিজস্ব জড়িবুটি সহযোগে সেই কণ্ঠকে নিজের মতো করে গড়েপিটে নেওয়ার চেষ্টা করে। নারী দিবসের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। বিশেষত কর্পোরেট সংস্কৃতি আজকাল যে ভাবে নারী দিবসকে কেন্দ্র করে তার বাজার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তা নারী দিবসের উদ্দেশ্য-বিধেয় গুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
স্বস্তির কথা এই যে, গুলিয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস সম্পর্কে নারী-আন্দোলন অন্ধ হয়ে বসে নেই। বাজারি মুনাফার ফাঁদে বোড়ে হয়ে যাওয়ার বিপদ নিয়ে লেখালিখি চোখে পড়ে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু তার পরেও গুটিকয় দুশ্চিন্তার জায়গা থেকেই যাচ্ছে। বাজারি অর্থনীতি কী ভাবে নারী দিবসকে আত্মসাৎ করতে চায়, সেটা নজর করা আদতে খুব কঠিন নয়। বিজ্ঞাপনের বহরেই তা চোখ টানতে বাধ্য। কিন্তু এই প্রতাপী দৃশ্যমানতার পিছনে অন্তঃসলিলা যে ‘সফল নারী’র নির্মাণ, তা নিয়ে কথাবার্তা কম। উদ্বেগের জায়গা সেখানেই। কারণ, এই ‘সাফল্য’-এর গ্রন্থনা কিন্তু গ্রাস করার ক্ষমতা রাখে নারী-আন্দোলনের বড় অংশকেও।
যে কোনও আন্দোলন, সংগ্রামই জয়ের লক্ষ্যমাত্রা রাখে, রাখে সাফল্যের চাহিদা। ধাপে ধাপে তার চৌহদ্দি বাড়ে। এক সাফল্য আর এক সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার যে প্রতিষ্ঠান, যে ক্ষমতা-কাঠামোর বিরুদ্ধে তার লড়াই, সাফল্যের কাহিনি বেচতে সে সদাই প্রস্তুত। সাফল্যের বাজার-মূল্য তখন স্বয়ংক্রিয় হয়ে এই ‘অন্য’ ‘ভিন্ন’ সাফল্যকেও তার ঝোলায় পুরে নেয়। সমষ্টির সাফল্য আর ব্যক্তির সাফল্যের ভারসাম্যরেখা ঝাপসা হতে শুরু করে। নারীবাদীও তখন সেলেব্রিটি হন। নারীর লড়াই মিডিয়ার খাদ্য হয়। নারীর নানাবিধ অর্জন-কাহিনি জনমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এর কোনওটাই ফেলনা নয়, নয় পুরোপুরি অবাঞ্ছিতও। জনসচেতনতার বিস্তারে এর প্রয়োজনকে কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তার সঙ্গেই ওত পেতে থাকে দ্বিবিধ বিপদ। সফলতাকেই জীবনের বীজমন্ত্র করে তোলার যে বাজারি প্রণোদনা সর্বদা ক্রিয়াশীল, নিজের অজানিতেই কোথাও তার খোপে পা দিয়ে ফেলে নারী। নারীর সাফল্যেই নারীর মূল্য নির্ধারিত হতে থাকে। আর অন্য দিকে, সফল হয়ে ওঠার চাপ, নিজেকে বাজারে ‘প্রমাণ’ করার এক প্রবল তাগিদ আচ্ছন্ন করে ফেলে বৃহত্তর নারীসমাজকেও। যত ক্ষণ না কোনও বিক্রয়যোগ্য সফলতার নজির সে গড়তে পারছে, তত ক্ষণ এমনকি নারীবাদের প্রাতিষ্ঠানিক আঙিনাতেও যেন সে অপাঙ্ক্তেয় হতে থাকে অনেকাংশে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পরিসর তো ছেড়েই দেওয়া গেল। সুতরাং ফেসবুকে রান্নার ছবি দিয়েই হোক, কি ইউটিউবে গান গেয়েই হোক কি নিরন্তর নিজের ছবি সাঁটিয়ে দিয়েই হোক— আত্মকে ক্রমাগত বিপণন করতে না পারলে যেন আজ আর তার শান্তি নেই।
উনিশ শতকের বাংলায় রাসসুন্দরী দেবী যখন নিজের জীবনকথা লিখতে শুরু করেছিলেন, তাঁর ধারণাও ছিল না, তিনি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। তিনি লিখেছিলেন তাঁর আপন খেয়ালে, মনের টানে। পথিকৃৎ হয়ে ওঠার বাসনা তাঁকে তাড়া করেনি। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত গদ্যই নারীর স্বলিখন, নারীর স্বীয় সত্তার প্রকাশ আর সময়ের মুদ্রিত নথি হয়ে থেকে গিয়েছে ইতিহাসে। নিজেকে ব্যক্তি হিসেবে জানা এবং জানান দেওয়ার জন্য অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে মেয়েদের। যা কিছু ব্যক্তিগত তা-ও যে রাজনৈতিক, এ কথা নারী-আন্দোলনই জোর গলায় বলতে শিখিয়েছিল অনেক দশক পরে। এ বার সময় এসেছে, ব্যক্তিগততার পরিসরটুকু বাঁচিয়ে রাখার ব্রতকে একটি রাজনৈতিক কর্তব্য করে তোলার। পুরুষের তৈরি সদর আর অন্দরের চৌকাঠ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ভার নারীকেই নিতে হয়েছিল এক দিন। এখন মনন-যাপনের সব রকম নিভৃতি যখন ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে, ভিতর ঘরে খিল দেওয়ার দায়িত্বও তারই নেওয়া দরকার সবার আগে। ব্যক্তিসত্তার নির্ঘোষকে স্বগর্বী নিমগ্নতায় পর্যবসিত করতে পারলে আদতে কার লাভ, এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার রোখ দেখানোর কথা তারই। পলে পলে নিজেই নিজের ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠার সর্বনাশা রোগ নিবারণের ডাক দেওয়ার তাগিদ নারীবাদী নৈতিকতার উঠোন থেকেই তো আসা উচিত। নচেৎ আত্মরতির আগ্রাসন, যা কিনা চরিত্রে পুরুষ, এক দিন আত্মবিলোপের দিকে ঠেলে দেবে নারীকে।
ঘরের শিকল অনেকখানি ভেঙেছে নারী, বহুলাংশে ভেঙেছে মনের পাঁচিলও। এ বার কিন্তু সযত্নে একান্ত আমিটিকে আগলানোর সময়। নারীত্বের ধ্বজা ওড়ানো ঠিকাদারি মোচ্ছবকে এড়িয়ে চলার সময়। নারীশক্তির উদ্যাপন যখন কায়েমি ছকের ঘুঁটি, সেই শক্তিপীঠে নিজ নিজ দোকান খোলার দৌড় থেকে বিরাম নিয়ে আবারও বলার সময়, আমি থাকি নিজ মনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy