পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগ মানুষ এখনও খড়কুটো, খড়, শুকনো পাতায় উনুন জ্বালেন। ফাইল ছবি।
যে সব মানুষ বলেন, উজ্জ্বলা প্রকল্পের সিলিন্ডার গরিবের কাজে লাগছে না, তাঁদের কথায় কান দেওয়া ঠিক নয়। দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, সিলিন্ডারের সঙ্গে শাড়ির এক প্রান্ত, অপর প্রান্ত জানলায় বেঁধে দিব্যি দোলনা তৈরি হয়েছে, তাতে দোল খাচ্ছে একরত্তি শিশু। বেলাশেষে ছাপা শাড়িতে সরকার-প্রেরিত উপহারের দোলনাটি যত্নে ঢেকে রাখেন মা। কেউ রাতে বন্ধ দরজার এ দিকে সিলিন্ডার রেখে শুয়ে পড়েন, সেটি খিলের কাজ করে। অনেকে গাছের উঁচু ডাল থেকে সজনে পাড়েন সিলিন্ডারের উপরে চড়ে। একটি ঘরে দেখা গেল, ভাঙা টেবিলের একটি পায়ার বিকল্প হয়েছে সিলিন্ডার। কেবল তিনটি ঘর স্বীকার করল, সিলিন্ডার তারা কেজিদরে কামারশালায় বিক্রি করে দিয়েছে। দাম এগারোশো টাকা ছাড়ানোর অনেক আগেই গ্রামের মানুষের সাধ্যের সীমা ছাড়িয়ে, স্বপ্নের সীমাও ছাড়িয়ে গিয়েছে এলপিজি-র সিলিন্ডার। অগত্যা কুড়িয়ে আনা শুকনো ডাল, কাঠকুটোই ফের বেশির ভাগ ঘরে জড়ো করে রাখা হচ্ছে, জ্বালানি হবে।
সম্প্রতি একটি জাতীয় সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগ মানুষ এখনও খড়কুটো, খড়, শুকনো পাতায় উনুন জ্বালেন। শহরে ৭৬ শতাংশ মানুষ রান্নায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও গ্রামে ছবিটা উল্টো— গ্রামীণ এলাকার ৭৬ শতাংশ মানুষই মাটির উনুনে রান্না করেন। যদিও সরকার প্রচার করেছিল, কয়লা বা কাঠের মতো দূষণকারী জ্বালানিতে রান্না করা হলে নারীদেহে চারশো সিগারেটের ধোঁয়া প্রবেশ করে। শ্বাসযন্ত্র, ফুসফুসের রোগ থেকে নিষ্কৃতি মেলে এলপিজি ব্যবহার করলে। সেই আশ্বাস ফের মুখ লুকিয়েছে। মল্লিকা সোরেন, চিলমিলি বাস্কেরা ফিরে গিয়েছেন ধোঁয়াভরা রান্নাঘরে। কাশি, গলা-চোখ জ্বালা, এ সবই এখন তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গী। এ পাড়ায় সব হেঁশেলের হাঁড়িই কুচকুচে কালো। উজ্জ্বল বলতে ঝামা ঘষে খানিক রং ফেরানো সসপ্যানটি, আর মশলাদানির ঢাকনা থেকে উঁকি দেওয়া হলুদ, জিরে, মেথি। সেগুলো বাদে ভাত-জোগানো মেয়েদের রান্নাঘর যেন কৃষ্ণগহ্বর। কালো যে এক অপমানের রং, তা এ চত্বরের রসুইঘরগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায়। প্রথমে কাঠকুটো কুড়িয়ে আনার শ্রম, তার পর পুকুরপাড়ে বাসন মেজে মেজে হাঁড়ি-কড়াইয়ের কালিমা ঘোচানোর শ্রম, মেয়েদের কাজ সারতে বেলা পড়ে যায়।
উজ্জ্বলা প্রকল্পে দরিদ্র মানুষেরা বিনেপয়সায় এলপিজি গ্যাসের সংযোগ পেয়েছেন, এলপিজি সিলিন্ডারের জোগানও রয়েছে যথেষ্ট। কেবল গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ গ্যাসের উনুনে রান্নাবান্না করেন। রান্নার প্রক্রিয়া যেখানে উনুন ধরানো থেকে শুরু হয়, সেখানে মেয়েদের সঙ্গে রান্নার বাধ্যতামূলক আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাড়ির পুরুষটি কখনও গ্যাসে চা জলখাবার, বা খাবারে দু’একটা পদ বানিয়ে নিলেও নিতে পারেন। কিন্তু হেঁশেলে ঢুকে উনুনে হাওয়া দিতে বসবেন, গ্রামে এ প্রায় অকল্পনীয়। ফলে গরম ভাতের আনন্দ কালো ধোঁয়ায় ম্লান হয়, অসুখ আর অস্বস্তি বাড়ায় প্রতি দিন। সন্ধ্যার পর চুলোর ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে, হেঁশেলগুলোকে যেন ‘অভাগীর স্বর্গ’ মনে হয়।
সারা বাড়ির মাঝে সবচেয়ে সঙ্কীর্ণ, ঝুলমাখা, অন্ধকার ঘরটিই বরাবর রান্নাঘর বলে নির্দিষ্ট হয়। পরিবারের খাদ্যমেলার প্রাত্যহিক উৎসবে মেয়েদের মজুরিহীন শ্রমের সময়সীমা আরও বাড়ে। মেয়েটি উচ্চ পদমর্যাদার আধিকারিক হোন, বা নামকরা খেলোয়াড়, দিনশেষে এখানে তাঁকে আসতেই হবে। হাসপাতাল থেকে সদ্য রিলিজ়-পাওয়া বৃদ্ধা থেকে সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ স্থির হওয়া প্রসূতি— মাছ ভাজা, কুটনো কোটা বাড়ির মেয়েটিরই কাজ। অতি অসুস্থতার দিনেও, বা শোকতাপের মুহূর্তেও, কাঁপতে কাঁপতে পাকশালার দরজা খুলে দৃঢ়তা দেখানোই বীরাঙ্গনার পরিচয়। ‘খাওয়ার পর রাঁধা, আর রাঁধার পর খাওয়া’-র চক্রপাক বেঁধে রেখেছে মেয়েদের।
এলপিজি গ্যাস সেখানে একটু নিঃশ্বাস ফেলার অবসর দেওয়ার আশ্বাস নিয়ে এসেছিল। রান্নাঘরে মেয়েদের শ্রম দেশের চোখেও গুরুত্বপূর্ণ, দেশের সরকার মেয়েদের শ্রম লাঘব করতে চায়, সহজে জ্বালানির জোগান দিয়ে মেয়েদের কাজে অংশীদারি নিতে চায়— এই বার্তা অন্তত পৌঁছনো গিয়েছিল। এখন তার গতি উল্টো পথে— এগারোশো টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কেনার ক্ষমতা বা ইচ্ছা না থাকলে কাঠ কুড়োনোই মেয়েদের ভবিতব্য, সরকার এ কথায় যেন নীরবে সায় দিচ্ছে। ফলে একবিংশ শতকের ভারতে মেয়েরা ফের রাস্তায় ঘুরছে শুকনো কাঠকুটোর খোঁজে। প্রীতিলতা টুডুর মতো মেয়েদের রোজই অগ্নিপরীক্ষা— গায়ে চড়া রোদ মেখে কাঠপাতা কুড়োনোর পর বাড়ি ফিরে তারা রান্নার সাতসতেরো জোগাড় করে চলে অগ্নিতাপের সম্মুখে। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির মতো কষ্ট চোখেই পড়ে না কারও। অমন তো হয়েই থাকে।
আবার ভোট আসছে। এ বারও নিশ্চয়ই দূর গ্রামের দলিত-জনজাতির ঘরে পাত পেড়ে দু’মুঠো খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবেন নানা দলের বড় নেতারা। এই সুযোগে তাঁরা যদি এক পলক বাড়ির অনুজ্জ্বল হেঁশেলগুলোর দিকে চেয়ে দেখেন, বুঝতে পারবেন, জরাজীর্ণ অন্ধকারটার সঙ্গে মৃদু আলোর ভোটিং কম্পার্টমেন্টের কতখানি মিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy