Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলা ভাষার প্রতি যত্ন ছাড়া সমাজ-সংস্কৃতির দুর্দিন কাটবে না
Bengali Language

‘যতনে’ রাখব কি

স্বাধীনতার পরে ভাঙা বঙ্গদেশেও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে যত্নের নানা নমুনা চোখে পড়ে। স্বাধীনতা দুই বাঙালিকে আলাদা করেছিল।

bengali language.

বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি। ফাইল চিত্র।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৩৩
Share: Save:

কমলাকান্তের শ্যামাসঙ্গীত ছিল ‘হৃদয়ে যতনে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’। সংস্কৃত যত্ন শব্দটিকে ভেঙে নরম করে ‘যতন’ করে নিয়েছিলেন কমলাকান্ত। তবে তিনি জানতেন যত্ন শব্দের প্রকৃত অর্থ— চেষ্টা, উদ্যম, উদ্যোগ। শ্যামা মাকে হৃদয়ে রাখার জন্য সাধককে তাই উদ্যমী হতে হয়। চেষ্টা আর উদ্যোগ না থাকলে কালী হৃদয়ে থাকবেন কেন? শ্মশানচারিণী হবেন। মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালবাসার সম্পর্ক। সেই ভালবাসার শ্রমই মিশে থাকে যত্নে। আজকাল মনোবিদরাও মনকেমনিয়া মানুষদের একটা কথা প্রায়ই বলেন: নিজের যত্ন নিন। কথাটার একটা মানে এই নিজের দিকে তাকান, নিজের স্বভাব ও সামর্থ্য অনুযায়ী কী পেলেন তা ভাবুন। অন্যের কী হল, অপরে কী পেল তা না ভেবে নিজের যত্ন নিতে নিতে নিজেকে আবার গড়ে তুলুন।

আজকাল এই কথাটাই খুব মনে হয় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে তাকালে। মনে হয়, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে সারা ক্ষণ ‘গেল গেল’ রব না তুলে আমরা কি তার একটু যত্ন করতে পারি না? তেমন যত্নের ইতিহাস আমাদের আছে। উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয়-এর মতো ভাষা-শিক্ষার বই লিখছেন, বঙ্কিমচন্দ্র বাংলাকে জ্ঞানচর্চার ভাষা হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের শেষে ‘শিক্ষার হেরফের’-এর মতো প্রবন্ধ লিখে বাংলা ভাষাকে পড়াশোনার বাহন ও মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও যত্নের অভাব হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম এ পড়ানো (১৯২০) চালু হল। আমরা যাকে মাধ্যমিক স্তরে বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়-ব্যবস্থা বলি তার ভিত্তি স্থাপিত হল বিশ শতকের ত্রিশের দশকে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় এম এ পড়ানোর ক্ষেত্রে ও তাঁর পুত্র শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যালয় স্তরে বাংলা-মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরে ভাঙা বঙ্গদেশেও বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে যত্নের নানা নমুনা চোখে পড়ে। স্বাধীনতা দুই বাঙালিকে আলাদা করেছিল। দেশভাগ ঘা দিয়েছিল বাঙালির স্বপ্নে, তার ভাষায়, সংস্কৃতিতে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির ভাষাভিত্তিক আত্মপরিচয় নির্মাণের লড়াই এবং তার সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে বাঙালির ঐতিহাসিক উত্তরণ ঘটবে সিকি শতকের মধ্যে। কিন্তু এপারেও, ভাঙা স্বাধীনতার টুকরোগুলি কুড়িয়ে নিতে নিতে এবং উত্তাল রাজনীতি আর অস্থির সমাজের ক্রমাগত তরঙ্গবিক্ষোভগুলিকে সামলাতে সামলাতে বাঙালি মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ভদ্রলোক নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে নিজের পায়ে সুস্থিত হওয়ার কথা ভাবছিলেন। সেই যত্নের ইতিবৃত্ত মনে রাখি না। রাখা দরকার। আজকের বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির দুর্দিনে সেই যত্ন বড় সহায় হতে পারে।

প্রথমেই খেয়াল করতে হবে, বাঙালি ভদ্রলোকদের একটি সৃষ্টিশীল অংশ ভাষা-সংস্কৃতির যত্নের পরিসরটিকে কেবল নিজেদের জন্য সীমিত রাখেননি, খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সেই পরিসর তৈরি করতে হবে, এ বোধ তাঁদের ছিল। বিশেষ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়বে। জেলখাটা বামপন্থী কর্মী সুভাষ জানতেন, পড়াশোনা করা ভদ্রবাবুদের অনেকের ধারণা— খেটে খাওয়া মানুষেরা ভাষা-সংস্কৃতির যত্নের কথা বুঝতে পারবে না। তাই অনেক সময়েই গতর-খাটা মানুষদের জন্য তাঁরা ‘সহজ’ কিছু দিতে চান। দুধের বদলে পিটুলি-গোলা জল। এ ভাবনা যে সম্পূর্ণ ভুল, সুভাষ তা জানতেন। পঞ্চাশের দশকেই পাওয়া গেল তাঁর ভূতের বেগার। একই রকম প্রয়াস থেকে জ্যোতি ভট্টাচার্য লিখলেন শ্রমিকের দর্শন। শ্রমিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার সূত্রে গড়ে উঠেছিল সেই বই। পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি তাদের প্রকাশিত বইপত্রের মাধ্যমে কম খরচে সাধারণ বাঙালির ধ্রুপদী বই পড়ার ইচ্ছে ও অভ্যাস বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। ১৯৭৬-এ প্রকাশিত সাক্ষরতা প্রকাশনার কাশীদাসী মহাভারত বইটি দেখলে চোখের আরাম হয়। গোপাল হালদার ভূমিকায় লিখেছিলেন, “বাঙলা মহাভারতের মধ্যযুগের ঐতিহ্য, তার রূপ, তার ধর্ম, তার সত্যও জানতে চাই, বুঝতে চাই।” এই জানতে চাওয়ার মনটি নিয়েই যে বাঙালি ইংরেজি জানা দুনিয়ার কাছে এগোতে হবে, এই বোধ ভাষা-সংস্কৃতি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক এক বোঝাপড়ার পরিসর তৈরি করেছিল।

সামাজিক সংযোগের তাগিদে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি যত্নের এই আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন শিল্পবাণিজ্যের উদ্যোগীরাও। তার বহু চমৎকার নজির আছে বিজ্ঞাপনের বয়ানে। যেমন ধরা যাক আনন্দমেলা পত্রিকার প্রথম (১৯৭৫) ও দ্বিতীয় (১৯৭৬) বর্ষের সংখ্যাগুলির পাতায় নানা বিজ্ঞাপন। দেখলে মন ভরে যায়। একটি জুতো কোম্পানির বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি কী অসম্ভব মনোযোগ! গোড়াতেই ছিল ধাঁধা। ‘পাহাড় থেকে হাড় বাদ দিলে কী থাকে? খালি পা থাকে। কিন্তু পা থেকে হাড় বাদ দিলে? আবার সেই পাহাড়।’ বিজ্ঞাপনদাতা তখন ধাঁধার উত্তর জানান— ‘খুব সোজা। পায়ের পাতায় হাড় না থাকলে পা হয় অচল। পাহাড়ের আরেক নাম অচল।’ সব বিজ্ঞাপনই যে এমন হত তা নয়, তবে অনেকেই চেষ্টা করতেন। অন্তত এখনকার মতো ভুল, যত্নহীন, যথেচ্ছ ইংরেজি-হিন্দি বাক্যের অনুসারী বিজ্ঞাপন চোখে পড়ত না। সে-কালের পণ্য-বিক্রেতারাও বুঝেছিলেন, যে ক্রেতাগোষ্ঠী নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি যত্নশীল, তাঁদের কাছে পৌঁছতে গেলে বিজ্ঞাপনটি যথাযথ হওয়া চাই।

এই যত্নশীলতা এমন ভাবে হারিয়ে গেল কেন? ভাষার প্রতি এই অযত্ন এবং ঔদাসীন্য পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়-ব্যবস্থার পালাবদলের সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত বলে মনে হয়। গত শতকের সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়-ব্যবস্থার প্রতি মোটের উপর সাধারণ বাঙালির আস্থা ছিল। ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা যেমন আসত, তেমনই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ত একই বিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষাই ছিল তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের স্বাভাবিক মাধ্যম। আনন্দমেলা-র পাতাতেও তার ছবি ধরা পড়েছে। প্রতি সংখ্যাতেই থাকত ভাল ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুতির খবর। সেই খবরের মধ্যে বাংলা-মাধ্যমের প্রতি আস্থা ও প্রশান্তি ছিল। অন্য দিকে, এই পত্রিকার পাতায় তখন টিনটিনের অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, বিজাতীয়কে তার মেজাজ বজায় রেখে ঘরের করে তোলার সে এক অপূর্ব উদাহরণ। শঙ্খ ঘোষ কুন্তক ছদ্মনামে বাংলা ভাষা পড়াচ্ছেন। ইংরেজি ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করার চেষ্টাও চোখে পড়ছে কোনও কোনও লেখায়। বাংলা নিয়েই যে বিশ্বচারী হওয়া যায় তার প্রতিফলন পড়ছে জুতো কোম্পানির বিজ্ঞাপনে। ‘দিল্লী প্যারিস লন্ডন/ পায়ে দেব পল্টন’।

এই ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ল দু’টি ঘটনার সমাপতনে। সরকারি বামপন্থীদের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মনে হল, বিদ্যালয়-ব্যবস্থাকে ভদ্রলোক শ্রেণির বাইরে সম্প্রসারিত করার জন্য ‘মাতৃদুগ্ধ ও মাতৃভাষার সমীকরণ’-এর নবপ্রয়োগ দরকার। খেটে-খাওয়া পিছিয়ে পড়া পরিবারের পড়ুয়াদের সরকারি পরিসরে নিয়ে আসার জন্য বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজিকে বিশেষ এক শ্রেণি পর্যন্ত বাদ রেখে, এবং ইংরেজি পাঠ্যসূচি থেকে অনুবাদচর্চা, ব্যাকরণচর্চা সরিয়ে রেখে ‘প্রত্যক্ষ সংযোগ’-এর নামে ইংরেজি শিক্ষার যে নব পাঠ্যসূচি তৈরি হল, তা পিটুলি-গোলারও অধম। সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের মতো করে বিষয়টি ওই শিক্ষা-নিয়ামকরা ভাবেননি। তাঁরা দরিদ্রদের ‘দয়া’ দেখিয়েছেন, গড়ে তোলার হাত এগিয়ে দেননি। সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি তাঁদের আস্থা ছিল না। আশির দশকে এই শিক্ষানীতির প্রবেশের পরে-পরেই দ্বিতীয় ঘটনা— নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মুক্ত অর্থনীতির ভারতে আগমন। বাঙালি ভদ্রলোকরা দেখতে দেখতে সরকারি স্কুলের প্রতি বিমুখ হলেন এবং ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের দিকে চলে গেলেন। ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের বিদায়ের ফলে দরিদ্র মানুষও এই স্কুলগুলির প্রতি শ্রদ্ধা হারালেন। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির সম্মান দুর্বল হয়ে পড়ল।

অতঃপর? কৃষিকার্যে অনুপযুক্ত অশিক্ষিত মানুষকে দিয়ে যেমন ধান বোনা যায় না, তেমনই এখনকার অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মীকে দিয়ে বিদ্যালয়ে মানবজমিনে সোনা ফলানো অসম্ভব। কিন্তু বাঙালি ভদ্রলোকেরা কি সামাজিক পরিসরে ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে চেষ্টা করবেন? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সযত্ন মনোযোগ ফিরবে কি?

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy