Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
উৎসবের আলো আর বিষণ্ণতার কুয়াশা মেখে আসে শীতকাল
Winter

অলৌকিক হিমজ্যোৎস্না

এক লাইন নিশ্চিত হলেই পরের লাইন অনিশ্চিত, এমন একটি জীবনে শীতকাল এলেই পাহাড় ও বনের সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে। তেমনই বার বার মনে পড়ে এই উৎসবের কথা।

কত ছোট ছোট ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে শীতকালের চেনা উৎসব শুরু হয়।

কত ছোট ছোট ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে শীতকালের চেনা উৎসব শুরু হয়। ফাইল চিত্র।

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০৬
Share: Save:

বড়দিনের আগের বিকেলবেলা। গলির বাহান্ন পাক, ভুবনবিখ্যাত পুকুরপাড়, ধুলোর অসহ্য পতন এই সব কিছুকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি একতলা বাড়ি। বারান্দার গ্রিলে অজস্র তানপুরা। এমন ভাবে তানপুরার ছাঁচ বুনে বুনে বানানো সেই গ্রিল, হাত দিলেই মনে হয়, যখন তখন বেজে উঠবে। গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে বসে আছে এক বন্ধুর মা। দেহ্‌রাদূন রাইস আনবে বলে সেই কোন সকালে বেরিয়েছিল বন্ধুটি। আর বাড়ি ফেরেনি। বড়দিনের আগের দিনের শেষ আলোটুকু বন্ধুর মায়ের অল্প উঁচু কপালে ধাক্কা খেয়ে পায়ের সামনে পড়ে আছে। বাড়িতে আর তো কেউ নেই। মাসখানেক আগেই স্বামীকে হারিয়েছেন প্রৌঢ়া। তিন জনের সংসারের এক জন নেই। আর এক জন, ফিরে আসছে না। সম্ভবত, সেই কারণেই খামখেয়ালির মতো তাঁর পায়ের সামনে পড়ে আছে ওই আলো। এই উৎসবের মরসুমে সে অন্তত থেকে যাক আরও কিছু ক্ষণ। এই আলোটি যেন এক আবিষ্কার। চিহ্নহারা অন্ধকারে বারান্দাটি ডুবে যাওয়ার আগে বন্ধুর মা’কে পিঠ দিয়ে আগলে রেখেছে সে। বারান্দার গ্রিলের ও পারে আমরা কয়েক জন ক্লাস ফোর। যে বন্ধু তখনও ফেরেনি, সে আমাদের থেকে পাঁচ ক্লাস উঁচুতে। আমাদের দিকে তাকিয়ে, অতঃপর, বন্ধুর মা বলে ওঠেন: “দেহ্‌রাদূন রাইস খাবে বলে নিজেই আবদার করে কিনতে চলে গেল সকালে। আমারও তো ভাল লাগে দেহ্‌রাদূন রাইস, ও তো জানে। যাক, হয়তো ভাল বুঝেছে, তাই ফিরছে না।” মনে হল, ক্ষমার সূচনা হল বারান্দার ও পারে। যেটুকু শীত ছিল, তাও চলে গেল তার পর। কাল শীত পড়বে আবার। কাল উৎসব। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে অনেক কিছু— যার যা আছে, যার যা নেই।

এক লাইন নিশ্চিত হলেই পরের লাইন অনিশ্চিত, এমন একটি জীবনে শীতকাল এলেই পাহাড় ও বনের সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে। তেমনই বার বার মনে পড়ে এই উৎসবের কথা। কোন উৎসব? যেখানে বুনো স্যাক্সোফোনের মতো সমস্ত বাতাস জুড়ে খেলা করে ঝর্না এবং কাঁটায় উল বোনার শব্দ। লম্বা ঝকঝকে কাচের বোতলে অন্তঃসার পাতলা মধুর মতো টলটল করে বিচ্ছেদের স্মৃতি, শোনা যায় পুরনো বাড়ির উঠোনে দিদির সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে দশ বছরের বয়সের উচ্ছ্বাসে বলে ওঠা ‘লাভ অল’। সমস্ত আকাশ ঝেঁপে আসা উৎসব যখন আমগাছের পাতায় পড়ে, দুর্বিপাক অতিমারি পেরিয়ে ফোনে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, গোটা বছর ফুরিয়ে যাবে আর কয়েক দিনে, তার আগে, আরও এক বার শেষ বারের মতো দেখা করা যাবে কি না। মনে পড়ে ছোট-বড় মাপে ভেঙেছি অনেক কিছুই, তবে তার ফাটলের মধ্যে দিয়ে যেটুকু এল, সে প্রাপ্তিও গাছের মতোই।

কত ছোট ছোট ব্যাপারের মধ্যে দিয়ে শীতকালের চেনা উৎসব শুরু হয়। সফেদ সাবানগুঁড়োর মতো রোদে পুরনো লেপ-কম্বলের উপরে ধামসে পড়ে থাকে নতুন শৈশব। গায়ে দেওয়া যাবে এমন মোটা কাঁথার শেষ দিকে কেউ যত্ন করে নিজের নাম সেলাই করে লিখে রাখে: ‘পুতুল’। দোতলা বাড়িতে একা বসে নতুন আলুর ঝোলে রুটি ডোবাতে গিয়ে ঝোলের মধ্যে টিউবলাইটের প্রতিবিম্বের দোল খাওয়া দেখতে দেখতে মনে হয় বাটির ভিতরেই তৈরি হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট। হাওয়াই চটিগুলোর উপরে শিশির জমে থাকে— মনে হয়, এসেছে যখন থাকুক, বেশি দিন তো নয়— শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিতে ইচ্ছে করে না, শীতের অতিথি কোনও পতঙ্গ তার উপরে এসে বসলে একটা সুখী দেখতে ছবি তৈরি হয়ে যাবে বরং। ক্যারলের শব্দের পাশে একা দাঁড়িয়ে যারা স্নেহ দিল যারা ভালবাসা দিল, তাদেরও প্রতিদানে পূর্বজন্ম থেকে কিছু একটা দিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। পায়ে পায়ে শীত জড়িয়ে যায়। পিজি হাসপাতালের ফুটপাতে পৌঁছতে না পৌঁছতেই সংবাদ আসে রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত সমবয়সি আত্মীয়া। উৎসবমুখর নন্দন চত্বরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনেও পড়ে না, কী ক্লান্তি নিয়ে কেটে যাবে ঠিক উল্টো দিকের ফুটপাতের এই পাতালতিমিরের রাত।

আসলে, এই গরমের দেশে শীতকালে ঘাম কম হয় বলে বাঁচাটা সুন্দর। সুন্দর বলেই সেখানেও উৎসব। সূর্যের গনগনে আঁচ না থাকায় দুপুরবেলাগুলোতেও শহরে পাপ কম মনে হয়। আর সেই কারণেই বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় বার বার, হঠাৎ ফাঁকায় ছেড়ে দিয়ে চট করে নিজে হারিয়ে যাবে না কেউ! যে বিশ্বাস গোটা শীতকাল জুড়েই আমাদের প্রত্যেককেই এক দিনের ছোট উৎসব থেকে পরের দিনের বড় উৎসবের দিকে ঠেলে দেয়। কুয়াশায় চুবানো এক রকমের রোদ্দুর শেষ হয়ে আসে গোটা বাংলা জুড়ে। মানবতরঙ্গ ওঠে নামে। জল এসে ছুঁয়ে যায় সমস্ত সন্ধ্যারতি। পৌষ-মাঘের মানচিত্রের মধ্যে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাল টেনে দেয় গৌর মাঝি।

এর পাশাপাশি আরও একটি উৎসব আছে। ভরা শীতে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে থাকা এক বন্ধু এক বার বলেছিল তাকে দেওয়া এক বিশেষ শাস্তির কথা। একটা বড় হাঁড়িতে মেশানো রয়েছে চাল ও ডাল। তার কাজ ছিল, চাল থেকে ডাল অথবা ডাল থেকে চাল বেছে নিয়ে দুটো আলাদা আলাদা থালায় জমা করে রাখা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই বিশেষ শাস্তিটা থেকে কী শিখেছিলি তুই? তার উত্তরটি ছিল— দুপুর আর বিকেলকে আলাদা করতে শিখেছিলাম। কী ভাবে? কাছে একটা কারশেড ছিল। সেখান থেকেই কোনও মালগাড়ি ধীরে বেরিয়ে যেত। দীর্ঘ একঘেয়ে বিস্তীর্ণ শব্দ। সেই শব্দটা পুরোপুরি মুছতে মুছতেই রোদের তাত কিছু থিতিয়ে আসত। বিকেল। মনে হয়েছিল, কী অদ্ভুত জীবন! শীতের দুপুর কখন বিকেল হচ্ছে, এই জটিলতর সমীকরণের সমাধান করতে তাকে টানা দু’দিন একটা ঘরে বসে থাকতে হল! জীবনের বত্রিশটা বছর লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। সমস্ত স্মৃতি ও সংস্কার পেরিয়ে চাল-ডাল বাছতে বাছতে সে উল্টেপাল্টে দেখতে শিখল একটা ঋতুর ছাঁদকে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় যেতে হল না!

শেষে তো পড়ে থাকে আমাদের এই সব দেখাই। আর, দেখতে শেখার উৎসব। এই দেখার লড়াইটা শীতে তীব্র হয়। একটু কসরত করতে হয়। কুয়াশা খিমচে তার ভিতর থেকে বার করে আনতে হয় গোটা দিনের বিভিন্ন অংশকে। আরও একটা ব্যাপার আছে। অতি পরিচিত এবং সেলিব্রেটেড দেখাগুলো ঘন সর হয়ে পড়ে থাকে সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। সেটা ভেদ করে তুলে আনতে হয় নতুন কিছু দেখা বা নতুন ভাবে দেখা। শীত অধিকাংশ সময়েই মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসে। তবে, কখনও কখনও মানুষও তো চলে যায় শীতের দিকে। রাগী, জেদি, একগুঁয়ে মানুষ। প্রত্যেক দিন কাজ থেকে ফিরে এসে নিজের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির জানলার সামনে বসে কফি খেতে খেতে উল্টো দিকের কবরখানার দিকে চেয়ে থাকে কেউ। ঘরের আলো জ্বালায় না। দীর্ঘ নির্যাতনের গভীর ভাস্কর্য তার শরীর জুড়ে। তার সর্বাঙ্গে তখন আগুনবেড় শীত ও তার উৎসব। এখানে কমলালেবু নেই, এখানে টেস্ট ক্রিকেট নেই, এখানে চিড়িয়াখানা নেই, এখানে বারবিকিউও নেই। শীতের যা কিছু সেলিব্রেটেড ব্যাপার, তার কিছুই নেই। তবে, উৎসবটি আছে। তবু, উৎসবটি আছে। অনেকগুলো সর সরিয়ে নিজের দেখার সেই উৎসব। অলৌকিক বহু হিমজ্যোৎস্না সরিয়ে নিজেকে দেখে নেওয়ার উৎসবও বটে।

নির্জন ঘাটের পথে নেমে যাওয়া একের পর এক সিঁড়ির দিকে নির্বিকার চেয়ে আছে হাফ হাতা সোয়েটার পরা রোগাটে যুবক। পিছনে কালীবাড়ি। পাঁচ ফুটের মধ্যে জোয়ারের গঙ্গা। কোনও কারণে তার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই আজ। অথবা, বাড়ি থেকে পালিয়েই এসেছে সে। কোথায় যাবে তা সে জানে না। তবে কোথায় তাকাতে হবে, তা জানে সে। তার তাকানোটা ঘাটের সিঁড়ি থেকে সরে যায় উৎসবের আলোকিত হাওড়া ব্রিজের দিকে। হাওড়া ব্রিজের উপরে চুপি চুপি উঠে যাওয়া মানুষটি দেখেন, গঙ্গার উপর দিয়ে ম্লান ভেসে যায় নৌকা। ছুটোছুটি, হুল্লোড়, কান্না, ভয় নিয়ে যানজট ও হ্যালোজেনের খেলার মধ্যে দিয়ে সুবিধাজনক ভিড় তৈরি করে নিচ্ছে মানুষ। চোখের অনেক গভীরে চলে যাওয়া মনটিকে একজোট করে তিনি ব্রিজের টঙে উঠে চেয়ে থাকেন এ-মাথা ও-মাথা ছড়িয়ে থাকা জোনাকিময় উৎসবের গৌরবের দিকে।

যে ভাবে ছেলে দেহ্‌রাদূন রাইস নিয়ে আসবে বলে বড়দিনের আগের বিকেলে বারান্দায় বসে বাইরে চেয়েছিল সেই বন্ধু’র মা… সেই বন্ধু আর ফেরেনি কখনও। ওই বারান্দায় বেশ কয়েক দিন টানা বসেছিল তার মা। গির্জায় শুরু হয়েছিল বড়দিনের গান। দেহ্‌রাদূন রাইস তখন আটচল্লিশ টাকা কিলো।

শীতকাল আসে। আমাদের বুকের মধ্যে গির্জার গানের আকাশ হারিয়ে যায়। আর মনে পড়ে, এই এক উৎসব। কত দেখা ও না-দেখা নিয়ে যে পুড়েছিল! টুইডের জ্যাকেট কিংবা আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে সারাজীবন পুড়েছিল!

অন্য বিষয়গুলি:

Winter christmas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy