—প্রতীকী চিত্র।
দুনিয়ার ধনীতম কয়েক জন মানুষ যেন একটা গেম শো-র হট সিটে বসে রয়েছেন— ‘কৌন বনেগা ট্রিলিয়নেয়ার’। ট্রিলিয়ন, অর্থাৎ এক লক্ষ কোটি ডলারের মালিক। খেলার শেষ লগ্ন উপস্থিত, এ বার জানা যাবে, কে হবেন এ গ্রহের প্রথম লক্ষ-কোটিপতি?
জন জেকব অ্যাস্টর নামে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের এক জার্মান-আমেরিকান ব্যবসায়ী— পশম ও ভূসম্পত্তির ব্যবসায়ী, এবং আফিম পাচারকারী— হয়েছিলেন আমেরিকার প্রথম মিলিয়নেয়ার বা দশ লক্ষ ডলারের মালিক। এক শতাব্দী পরে, ১৯১৬ সালে, দুনিয়ার প্রথম বিলিয়নেয়ার বা ১০০ কোটি ডলারের মালিক হন জন ডি রকফেলার। তার পর দুনিয়ার প্রথম সেন্টি-বিলিয়নেয়ার অর্থাৎ ১০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে বিল গেটস-এর সময় লাগল আরও ৮৩ বছর। ২০২৩ সালে ফোর্বস-এর তালিকায় বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ছিল ২,৬৪০। এখন ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার দৌড় চলছে।
১-এর পিঠে ১২টা শূন্য বসাতে হয় এক ট্রিলিয়ন লেখার জন্য। কত টাকা সেটা? পৃথিবীর মাত্র ১৯টা দেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এক ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে ম্যাকডোনাল্ড, পেপসিকো, কোকাকোলার মতো সংস্থার সমস্ত শেয়ার কেনার পরেও থেকে যাবে অনেকটা অর্থ, যা দিয়ে কেনা যাবে রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, বায়ার্ন মিউনিখের মতো দুনিয়ার সেরা ছ’টা ফুটবল দল, সেই সঙ্গে সমস্ত আইপিএল টিম, সব এনএফএল দল, এবং আরও অনেক কিছু। হাজার ডলারের নোটের পাঁজা চার ইঞ্চি পরিমাণ উঁচু হলে হবে এক মিলিয়ন। আর এক ট্রিলিয়ন হলে সেই নোটের পাঁজা হবে ৬৭ মাইল উঁচু।
কে হবেন দুনিয়ার প্রথম লক্ষ-কোটিপতি? ২০১৭-তে আমেরিকান বিলিয়নেয়ার মার্ক কিউবান ভবিষ্যদ্বাণী করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা কোনও উদ্যোগপতিই হবেন দুনিয়ার প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার। সাম্প্রতিক কালের অতি-ধনীদের অনেকেই অমিত-সম্পদশালী হয়েছেন জ্ঞান, ধারণা, অনুমান, ঝুঁকি, এবং বিনিয়োগকে সম্বল করে। আজ সৃজনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব এবং জীবনের প্রায় সর্ব ক্ষেত্রে এআই-এর বিজয়কেতন দেখে মনে হয়, কিউবান হয়তো ঠিক অনুমানই করেছেন।
গোড়ায় অনেকেই ভাবতেন, বিল গেটস-ই হতে চলেছেন প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার। তার পর সেই জায়গাটা নিলেন অ্যামাজ়নের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজ়োস। তার পর আসরে প্রবল ভাবে অবতীর্ণ হলেন বৈদ্যুতিন গাড়ি নির্মাতা টেসলা-র সিইও ইলন মাস্ক। ২০২১-এ মর্গান স্ট্যানলি-র বিশ্লেষকরা বললেন যে, ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার হতে চলেছেন মাস্ক-ই। এবং তা নাকি মাস্কের মহাকাশযান সংস্থা ‘স্পেসএক্স’-এর রমরমার পথ ধরেই। অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়া তখন হাঁসফাঁস করছে, কিন্তু অতি-ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ থেকে এ পর্যন্ত দুনিয়ার সেরা পাঁচ ধনীর— অর্থাৎ ইলন মাস্ক, বিলাসবহুল পণ্য সংস্থা লুই ভিতঁ-র বার্না আর্নো, জেফ বেজ়োস, ওরাকল-এর প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন, এবং বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফে— সম্পদ হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৯ থেকে মাস্কের নিজস্ব সম্পদ বেড়েছে গড়ে বছরে ১৬২%! ‘টিপালটি অ্যাপ্রুভ’ নামক সংস্থার ২০২২-এর এক সমীক্ষায় বলা হল, দুনিয়ার যে ২১ জনের ট্রিলিয়নেয়ার ক্লাবের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ইলন মাস্ক। এবং সেটা হবে ২০২৪-এর মধ্যেই। সম্ভাব্য লক্ষ-কোটিপতিদের তালিকায় নাম ছিল গৌতম আদানি এবং চিনা উদ্যোগপতি ঝ্যাং ইয়িমিং-এর; বিল গেটস, মার্ক জ়াকারবার্গ, বেজ়োস, মুকেশ অম্বানীরও।
২০২৪ কিংবা ২০২৬-এর মধ্যে দুনিয়া যে কোনও ট্রিলিয়নেয়ার পাচ্ছে না, সেটা এখন নিশ্চিত। তবে, অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছে, অতি-ধনীদের আলিবাবার রত্নগুহা ফুলে-ফেঁপে ওঠার হার যদি অক্ষুণ্ণ থাকে, তবে এক দশকের মধ্যেই তৈরি হবে ট্রিলিয়নেয়ার। মাস্ক নাকি ট্রিলিয়নেয়ার হতে পারেন ২০৩২-এ। তার পরের বছর আর্নো, ২০৩৪-এ বেজ়োস, ২০৩৫-এ এলিসন, আর ২০৩৬-এ বাফে।
তবু, অনেকের কাছে ‘ট্রিলিয়নেয়ার’ শব্দটা অসহ ঠেকে, বিশেষত যে দুনিয়ায় ক্ষুধা, অনাহার, বাসস্থানের অভাব, উপযুক্ত স্বাস্থ্য-পরিষেবার অভাব, শিক্ষার সুযোগের অভাব প্রবল ভাবে বিদ্যমান। দুনিয়ায় অসাম্য বাড়তেই থাকে। ও দিকে আমেরিকান বিলিয়নেয়াররা করের পয়সা না দিয়েই বছরের পর বছর তাঁদের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের বিপরীতে ধার নিতে পারেন, ফলে সাধারণ আমেরিকানদের তুলনায় তাঁদের করের হার হয় কম, এ কিন্তু হোয়াইট হাউসের ২০২২-এর বক্তব্য।
আমেরিকার বামপন্থী রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স তাঁর ২০২৩-এর বই ইট’স ওকে টু বি অ্যাংরি অ্যাবাউট ক্যাপিটালিজ়ম-এ স্যান্ডার্স এক বৈপ্লবিক ধারণা ব্যক্ত করেছেন— কোনও আমেরিকান ৯৯৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি রোজগার করলে সরকারের উচিত তাঁর পুরোটাই বাজেয়াপ্ত করা! অর্থাৎ বিলিয়নেয়ার থাকাই উচিত নয়। ট্রিলিয়ন তো আবার বিলিয়নের হাজার গুণ। মজার কথা হল, পুরোটা না হলেও এই ধারণার আংশিক শরিক অনেক অতি-ধনীও। ডাভোসে ২০২৪-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর সামাবেশে ২৬০ জন অতি-ধনী স্বাক্ষর করেছেন একটা চিঠিতে— বিশ্বনেতাদের তাঁরা বলছেন অতি-ধনীদের করের হার বাড়াতে। সম্প্রতি অতি-ধনীদের কর বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন বিল গেটসও।
এটা প্রায় নিশ্চিত যে, এ গ্রহের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার হবেন এক জন আমেরিকান পুরুষ, যিনি ইতিমধ্যেই রয়েছেন সেরা ধনীদের তালিকায়। গেম শো-তে খেলতে থাকা এই খেলোয়াড়দের রয়েছে বেশ কয়েকখানা জবরদস্ত ‘লাইফলাইন’ও: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অতিমারি, যুদ্ধ, ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো আর্থিক পুনরুত্থান— যা এই অতি-ধনীদের সঙ্গে বাকিদের ফারাক বাড়াতেই থাকে।
আমরা ভাবি, মোট সম্পদ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শূন্যে পৌঁছলে, তার পর সম্পদের অঙ্কের সংখ্যাগুলি হয়তো ক্রমবর্ধমান বিমূর্ততার নির্দেশক— তা নিরাপত্তা, জীবনধারা বা জীবনযাপনের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কী জানি! ধনীতর হয়ে ওঠার খেলা কিন্তু চলতেই থাকে। এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে দুনিয়ার অর্থনীতি আর সমাজকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy