কাকতালীয়! পাশাপাশি দুই রাজ্যে একই দিনে দুই ঘটনা। আপাত ভাবে কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু রাজনৈতিক আতশকাচের তলায় ফেললেই অদ্ভুত মিল। সোমবার কলকাতায় বিজেপির বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হলেন। ওই দিনই অসমে হিমন্তবিশ্ব শর্মা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন।
দুই নেতাই ‘দলবদলু’। এক জন কংগ্রেস, অন্য জন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে এসেছিলেন। কিন্তু কেউই বিজেপির মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিজেপিতে যোগ দেননি। যোগ দিয়েছেন ক্ষমতার জন্য। কংগ্রেসে থাকাকালীন হিমন্ত যখন দেখেন যে, তাঁর মেন্টর তরুণ গগৈ নিজের ছেলে গৌরবকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী করে তোলার চেষ্টা করছেন, সেই সময়ই তিনি বিদ্রোহ করেন। একই ভাবে শুভেন্দু যখন বুঝতে পেরে যান, তৃণমূলের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই যাবে, তখন থেকেই তাঁর ক্ষোভের শুরু।
কিন্তু, আসল মিল হল, দুই ক্ষেত্রেই বিজেপি তথা আরএসএস কার্যত বাধ্য হয়েই হিমন্তবিশ্ব ও শুভেন্দুকে মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার আসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নিল। পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাবনা, সর্বোপরি আদি ও নব্য বিজেপির সংঘাত সরিয়ে রেখে। বিজেপির ঘোষিত লক্ষ্য কংগ্রেস তথা বিরোধী-মুক্ত ভারত। সেই বিজেপিতেই পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিঃশব্দে কংগ্রেস ও বিরোধী শিবির থেকে আসা দুই প্রভাবশালী নেতার হাতে চলে গেল। বিজেপিই কংগ্রেস তথা বিরোধী-মুক্ত হয়ে থাকতে পারল না।
মতাদর্শ নয়, রাজ্যে রাজ্যে প্রভাবশালী নেতাদের উপরে এই নির্ভরতা বরাবর কংগ্রেসের প্রাণভোমরা। দীনদয়াল উপাধ্যায় মনে করতেন যে, সেখানেই কংগ্রেসের দুর্বলতা। পঞ্চাশের দশকে জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেস ‘ক্ষণিকের অতিথি’। কারণ তার জোরালো কোনও নীতি বা মতাদর্শ নেই। সেই তুলনায় জনসঙ্ঘ সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ নিয়ে চলা ক্যাডার-নির্ভর দল। কংগ্রেস সম্পর্কে সঙ্ঘ নেতাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত— আজকের প্রায় ভঙ্গুর দশায় আসতেও কংগ্রেসের কয়েক দশক লেগেছে। কিন্তু এই সময়কালে গোটা দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে বিজেপি কার্যত কংগ্রেসের পথই নিয়েছে।
দীনদয়াল যাকে কংগ্রেসের দুর্বলতা বলে মনে করতেন, অমিত শাহ ঠিক তাকেই শক্তি মনে করে বিভিন্ন রাজ্যের প্রভাবশালী নেতাদের উপরে ভরসা করেছেন। তাঁদের বিজেপিতে টেনে এনেছেন। অমিত শাহের হাত থেকেই হিমন্ত ও শুভেন্দুর বিজেপিতে যাওয়ার ‘ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি’ লাভ। কিন্তু তাতে দুই রাজ্যেই আদি ও নব্য বিজেপির মধ্যে সংঘাত স্পষ্ট। অসমে বিজেপি জিতে ফের ক্ষমতায় ফিরেছে বলে আদি ও নব্য বিজেপির সংঘাত সামনে আসেনি। কিন্তু হিমন্ত যে মন্ত্রিসভা সাজিয়েছেন, তাতে পুরনো কংগ্রেসি বা পুরনো অসম গণ পরিষদের নেতারাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ব্যর্থ হতেই বিজেপির আদি নেতারা নব্য বিজেপিদের তৃণমূলের আবর্জনা বলে তকমা দিয়েছেন।
অসম বা পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য প্রথম নয়। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের জমানার বিজেপিতে দেখা গিয়েছে, বহু রাজ্যেই কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দল থেকে আসা নেতারাই বিজেপির প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন। কারণ হয়তো দুটো। এক, অমিত শাহের সামনে কোনও উপায় ছিল না। সংশ্লিষ্ট রাজ্যে বিজেপিতে দক্ষ প্রশাসক, সাংসদ-বিধায়ক হয়ে ছাপ ফেলার মতো নেতার অভাব ছিল। ফলে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যে রাজ্যে সরকার গড়ার জন্য জনসমর্থন পেলেও বিজেপিতে মন্ত্রী-বিধায়কের দরকার পড়তই। দুই, অমিত শাহেরা হয়তো এখনও ভাবছেন, হিমন্ত-শুভেন্দুরা মানুষের কাছে বিজেপির মুখ হয়ে উঠতে পারেন— কিন্তু, সংগঠনের আসল নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুরনো আরএসএস নেতৃত্বের হাতেই।
কিন্তু হিমন্ত ও শুভেন্দুর মধ্যে আরও একটি মিল আছে। দু’জনের কেউই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকেননি। বরং ভোটপর্বে সেই মাপকাঠিতে তাঁরা বিজেপির পুরনো নেতাদেরও পিছনে ফেলে দিয়েছেন। হিমন্ত ভোটে লড়তে নেমেছিলেন পাঁচ বছর অসমের বিজেপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, শুধুমাত্র উন্নয়নের ভরসায় ভোটে জেতা যায় না। শুভেন্দুর প্রধান অস্ত্র ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও দুর্নীতির অভিযোগ। কিন্তু তিনিও সেখানেই আটকে থাকেননি।
সময় যত এগিয়েছে, হিমন্ত ও শুভেন্দু, দু’জনেরই প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে মুসলিম-বিরোধিতা। মুখে তাঁরা বিরোধীদের ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর কথা বলেছেন। বাস্তবে মুসলিমদেরই সরাসরি নিশানা করেছেন। শুভেন্দু প্রথম থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মমতা বেগম’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেন। ফের মমতার সরকার ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গ ‘মিনি-পাকিস্তান’ হয়ে উঠবে বলে প্রচারে যান। মমতার নির্বাচনী এজেন্টকে দাউদ ইব্রাহিম বলতেও ছাড়েননি। পাশের রাজ্য অসমে হিমন্ত সরাসরিই বলেছিলেন, তিনি চান না অসমের মিয়া মুসলিমরা তাঁকে ভোট দিন। কারণ তিনি বাংলাদেশ থেকে আসা এই বহিরাগত, অসমিয়া সংস্কৃতির বিরোধী এই সম্প্রদায়ের ভোটে জিতে বিধায়ক হতে চান না।
হিমন্ত ও শুভেন্দু— দু’জনেরই লক্ষ্য ছিল মুখ্যমন্ত্রীর গদি। হিমন্ত সফল। শুভেন্দু নন। কিন্তু দু’জনেই একটি কাজে সফল। তা হল, রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ। শুভেন্দু তথা বিজেপি ভোটে হারলেও পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু তোষণ, বা স্পষ্ট ভাবে বললে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণকে বাংলার রাজনীতির একেবারে মূল স্রোতে এনে ফেলেছেন। যাতে ভর করেই বিজেপি আগামী দিনে বিধানসভার তিন বিধায়ক থেকে সাতাত্তর হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে এগোতে চাইবে।
অসমেও বিজেপি নিজের সংগঠন গড়ে তোলার জন্য অপেক্ষা না করে প্রথমে সর্বানন্দ সোনোয়ালের মতো অসম গণ পরিষদ থেকে আসা নেতাদের উপরে ভরসা করেছিল। তার পরে কংগ্রেস থেকে আসা হিমন্ত। তাঁদের হাত ধরেই ‘বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী’ বিরোধিতা থেকে ‘বহিরাগত পরিযায়ী শ্রমিক’ বিরোধিতা থেকে অসমে বিজেপির রাজনীতি ‘বহিরাগত মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’ বিরোধিতায় পৌঁছে গিয়েছে। হিমন্ত ও শুভেন্দু শুধু বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছনোর বোড়ে হয়ে উঠেছেন, তা নয়। বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শগত লক্ষ্যকেও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। বিজেপিতে বহিরাগত হয়েও।
দিনের শেষে একটাই প্রশ্ন পড়ে থাকে। তা হল, কোনটা তবে আসল বিজেপি? শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-দীনদয়াল উপাধ্যায়, বাজপেয়ী-আডবাণীদের বিজেপি? না কি অমিত শাহ-কৈলাস বিজয়বর্গীয়, শুভেন্দু অধিকারী-হিমন্তবিশ্ব শর্মাদের বিজেপি? আসল-নকলের এই বাছবিচারের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, এ এমন এক বিজেপি, যার শীর্ষে প্রবল জনপ্রিয় এক নেতা। নিচুতলায় আরএসএস-এর ক্যাডার বাহিনী। মাঝের স্তরে বিজেপির নিজস্ব বা অন্য দল থেকে আসা স্থানীয় স্তরে প্রভাবশালী নেতারা। মতাদর্শগত ভাবে আলাদা হলেও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে কেউই পিছিয়ে নেই। বলা চলে, এই তিনের সংমিশ্রণে বিজেপি এখন এক অভূতপূর্ব ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক যন্ত্র। যেখানেই এই যন্ত্রের তিনটি চাকা এক সঙ্গে কাজ করবে, সেখানে বিজেপিকে রোখা মুশকিল হবে।
বাংলায় ভোটের ফল দেখে বিজেপি-বিরোধীরা আপাতত উৎফুল্ল হতেই পারেন। কিন্তু ভবিষ্যতে বিজেপির তিনটি চাকাই এক সঙ্গে কাজ করলে, তাঁদের দুশ্চিন্তার কারণ আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy