—ফাইল চিত্র।
হচ্ছেটা কী! এটা আজ শুধু প্রশ্ন নয়। এক বিপন্ন বিস্ময়। তাতে আমি-আপনি-আমরা-তোমরা সবাই আক্রান্ত। এ বার সাত দফা ভোটের শেষ দিকে তারই বিবিধ লক্ষণ ফুটে
বেরোচ্ছে। তাতে কখনও বিপন্নতা বাড়ছে, কখনও বিস্ময়। অপেক্ষা আরও দু’দফার।
প্রথমে বলি, খুন-জখমের ভোট আমরা অনেক দেখেছি। ভোটে সাম্প্রদায়িক উস্কানি, জাতপাতের লড়াই, কুকথার প্লাবন, জাল-জালিয়াতি, টাকার খেলা, পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা ইত্যাদি সব আমাদের চেনা উপকরণ। কিছুতেই এ সব এড়ানো যায় না, অন্তত এই রাজ্যে।
এ বার আরও এগিয়ে সাধু-সন্তদের গেরুয়াতেও ‘টান’ পড়ল! এটা ঠিক, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি ‘রাজনীতি’ (বিজেপি) করার অভিযোগ তুলেছেন রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রমের নির্দিষ্ট ‘দু-এক জন’ সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে। সংগঠনগুলিকে সামগ্রিক ভাবে জড়াননি। কিন্তু বাস্তবে তাঁর বক্তব্যের অভিঘাত ওই ধর্মীয় সংগঠনগুলির বৃহত্তর পরিমণ্ডলে পৌঁছে গিয়েছে। ওই ধরনের ধর্মীয় তথা সেবামূলক সংগঠনের নাম জড়িয়ে এ জিনিস আগে কখনও হয়েছে বলে জানা নেই। প্রচারের শেষ লগ্ন পর্যন্ত রাজনীতির মঞ্চে এগুলি উচ্চারিত হবে। এটাই বিপন্নতা।
ক’দিন আগে আবার জজগিরি ছেড়ে আসা এক বিজেপি প্রার্থী রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে প্রকাশ্য সভায় কুৎসিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছিলেন, “মমতা, তোমার রেট কত!” জানি না আরও কী কী বাকি। তবে পতাকার রং যার যা-ই হোক, বিপন্নতার সওদাগরেরাই যে আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা, তাতে কোনও সন্দেহ রাখলে চলবে না।
সাধারণত রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের যে কোনও পদক্ষেপ ঘিরে সব সময়ই বিতর্ক হয়। সমর্থন, বিরোধিতা দুই-ই থাকে। এটাই তো স্বাভাবিক। মমতা তাতে কোনও ব্যতিক্রম নন। তবে মমতার বক্তব্য অধিক নজর কাড়ে, তিনি মমতা বলেই।
তাঁর মতো দুঁদে রাজনীতিক নেহাত অহেতুক কিছু কথা বলে ফেলছেন ভেবে নিলেও হয়তো ভুল হতে পারে। বরং এটাই ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে, তিনি তাঁর মতো করে আগাম ভেবেচিন্তে যখন যেমন ‘বার্তা’ প্রকাশ্যে দিতে চান, তেমনটাই দেন। অর্থাৎ মিশন বা সঙ্ঘের গেরুয়াধারীদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন, তা তাঁর দিক থেকে যতটা ‘পরিকল্পিত’, বিরোধী-জোট নিয়ে যখন বলেন, সেটিও ততটাই। ভেদ শুধু বিষয়ে।
অধিকাংশ বিশ্লেষক এটাও মানেন যে, ‘কূটনৈতিক’ চাতুর্যে বা মারপ্যাঁচে মমতা দেশের শীর্ষনেতাদের কারও চেয়ে কম যান না। কখন কী ভাবে কোন পরিস্থিতিকে ‘কাজে’ লাগাতে হয়, রাজনৈতিক জীবনে অনেক বার তিনি সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। কখনও সফল হয়েছেন। কখনও নয়। তবে দিনের শেষে নিজের ‘বোঝা’ বুঝে নিতে মমতা সর্বদা দ্বিধাহীন। এবং তার জন্য যে ভাবে, যত দূর গিয়ে যা করার, নিজের ছকে তা শেষ অবধি তিনি করে চলেন। এটা, তাঁর রাজনীতির অন্যতম ‘কার্যকর’ উপাদান।
শুনেছি, যে সাধুদের নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ শাণিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু দিন ধরেই নাকি তাঁর কাছে অভিযোগ আসছিল। সে সব অভিযোগের সত্যাসত্য আমাদের জানার কথা নয়। কেন তিনি ঠিক এই সময়েই বিষয়টি প্রকাশ্যে আনলেন, সেটাও বলা কঠিন। তবে পরিস্থিতি অনুভব করেই মিশন, সেবাশ্রম, ইসকন ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা মমতা এখন বার বার তুলে ধরছেন। এবং লক্ষণীয়, ভারত সেবাশ্রমের সঙ্ঘপ্রধান জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের সংশ্লিষ্ট সন্ন্যাসীর ভূমিকা ও বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্ঘের কোনও যোগ নেই।
এ তো গেল সাধু-সমাচার। বিরোধী জোটে তাঁর ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা হঠাৎ ভোট-পর্বের মধ্যে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ গোছের অবস্থান নিতে চাইছেন কেন, এটি আরও বড় এবং বিস্ময় জাগানো প্রশ্ন। তিনি আজ দেশের রাজনীতিতে এক অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। জাতীয় স্তরে নিজেকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক বলে দাবি করছেন তিনি। সর্বোপরি আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ধাপে ধাপে নিজের অবস্থান যে ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, তাতে তাঁকে বৃহৎ বৃত্তের বাইরে রেখে এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির হিসাব কষা মুশকিল।
সেই মমতা যদি বলে বসেন, বিরোধী জোটের সরকার হলে তিনি বাইরে থেকে সমর্থন দেবেন, তা হলে সেই কথার তাৎপর্য বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। তাঁর ‘কৌশল’ ঘিরেও তাই চর্চা চলছে।
একটি ধারণা প্রথমেই ছড়িয়ে পড়েছে যে, মমতা মূলত বিজেপি-কে ‘বার্তা’ দিতে চাইছেন। যাঁরা এটা বলছেন, তাঁদের মতে, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সরকারকে তৃণমূল নেত্রী বাইরে থেকে সমর্থন দেবেন বলার অর্থ হল, তিনি যে কোনও সময় ‘পিছিয়ে’ আসার পথটি খোলা রেখে বিজেপি-কে বোঝাতে চান, তৃণমূল জোট-নিরপেক্ষ ‘স্বাধীন’ দল হয়ে ভোট-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে। এটাকে তাঁরা মমতার ‘ভারসাম্যের কৌশল’ বলেও ব্যাখ্যা করছেন।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা কত দূর বাস্তবসম্মত? এক-এক করে দেখা যাক। প্রথমত, বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ যদি ক্ষমতায় ফেরে, তাদের কি তখন মমতার সমর্থন আদৌ প্রয়োজন হবে? দ্বিতীয়ত, বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের যে অবস্থান থেকে মমতা ভোট করছেন, তাতে বাংলায় তিনি যত আসনই পান, তাঁর বা বিজেপির কারও পক্ষে কি রাতারাতি ভোল বদলে খোলাখুলি সমর্থন দেওয়া-নেওয়ার মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপ করা সম্ভব? এই সরকার ফিরে এলে দিল্লির সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক কোন খাতে কী ভাবে বইবে, সে সব পরের ব্যাপার। তার সঙ্গে আরও অনেক গূঢ় বিষয় জড়িত। ফলে সেই রসায়ন আলাদা।
তাই মনে হয়, মমতার এই বার্তার আসল লক্ষ্য বিজেপি নয়, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বড় শরিক কংগ্রেস। বিরোধী জোট জিতলে তৃণমূল মন্ত্রিত্বে যাবে না, এই ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হল কংগ্রেসের উপর কিছুটা চাপ রাখা। সেই সঙ্গে অখিলেশ, তেজস্বী যাদব, স্ট্যালিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দলনেতাদের ‘সচেতন’ করা।
‘ইন্ডিয়া’ জোট যে এই রাজ্যে দানা বাঁধছে না, সেটা তো ভোটের অনেক আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে এই রাজ্যের কংগ্রেসের সঙ্গে মমতাদের অহি-নকুল সম্পর্কও বিশদে বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্য দিকে, ভোট পর্বের গোড়ার দিকেও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মমতার এক প্রকার ঠান্ডা দূরত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল।
তবে দ্বিতীয় দফার ভোট হয়ে যাওয়ার পর থেকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রধান শরিক কংগ্রেস ‘সক্রিয়’ হয়ে জোট-নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে সচেষ্ট। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও তাঁদের কথা হয়। হতেই পারে, ভোটের সামগ্রিক প্রবণতায় তাঁরা সবাই ‘উৎসাহিত’। বিজেপি-জোটের চারশো আসন জেতা নিয়েও সংশয় বেড়েছে। সব ঠিক। তবু প্রকৃতপক্ষে ফল কী হবে, তা তো কেউ বলতে পারে না।
মমতা সেখানে বিস্ময় জাগিয়ে সরকারে যোগ না দেওয়ার আগাম ঘোষণা করে দিলেন কেন? নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, “বাংলা থেকে বেশি আসন পেলে দিল্লিতে আমাদের দর বাড়বে।” এখানেই নাটকের আসল মোচড়!
মনে আছে, আশির দশকের প্রথম দিকে কিছুকাল প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। তাঁকে কোনও প্রশ্ন করলেই তিনি মুচকি হেসে বলতেন, “মাসির গোঁফ গজালে কী হবে, তা কি আগে বলা যায়!”
মমতা কিন্তু তাঁর কথা আগেই বলে রাখলেন। ভুললে চলবে না, তিনি আঞ্চলিক দলগুলির আধিপত্য চান। যদি বিজেপি-কে হারিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ ক্ষমতায় আসে, তা হলে ‘দর’ বাড়ানোর সুযোগও মমতার থাকবে। সরকারে যেতে চাই না বলে দর কষাকষির সেই পথটি তিনি খোলা রাখলেন। বাকিটা ‘মাসির গোঁফ’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy