Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ২০২৪: দুই দিকেই সঙ্কট
USA Presidential Election

অবাঞ্ছিত বিকল্পের সামনে

ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেন দুই জনে অবশ্য খুব আলাদা দুই কারণে নিজেদের পার্টির নেতা হতে চলেছেন। বর্তমান শাসক হিসেবে বাইডেন মোটের উপর সফল, অনেক রকম চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এসেছেন, পেরোচ্ছেন।

An image of the meeting

মিত্রসঙ্গ: হোয়াইট হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ওয়াশিংটন ডিসি, ২৩ জুন। ছবি: পিটিআই।

শশী তারুর
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৩ ০৫:৪৩
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফর নিয়ে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে এত হইচই, এর মধ্যে একটা ভারী গুরুতর কথা দেখছি সমানেই বাদ পড়ে যাচ্ছে: আমেরিকা কিন্তু তার নিজের মাটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। জোরালো প্রচার চলছে চার দিকে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এপ্রিল মাসেই ঘোষণা করলেন— তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনে আবার প্রার্থী হতে চলেছেন। এবং, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কট্টর রিপাবলিকানদের মধ্যে যে-হেতু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জনপ্রিয় আর কেউ নন, সুতরাং আবারও হয়তো ট্রাম্প-বাইডেন ফিরতি ম্যাচ-ই হতে চলেছে পরের বছর ওদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

মজার ব্যাপার, গত ছয় মাসে নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ঠিক এটাই অধিকাংশ আমেরিকান মানুষ দেখতে চান না আর— তবু এটাই আবার হতে চলেছে! এক দিকে এক জন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, যিনি ইতিমধ্যেই নির্বাচনে হেরে গিয়েও কোনও না কোনও ভাবে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার তাগিদে নিজের দেশেরই পার্লামেন্টের উপর হামলা ‘পরিচালনা’ করেন। আর অন্য দিকে, এক জন আশি-ঊর্ধ্ব প্রেসিডেন্ট, যাঁর ভদ্রতা-সভ্যতা সব সমালোচনার উপরে হলেও যাঁর মানসিক সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন-সমালোচনা দুই-ই বেশ ভাবানোর মতো। বেশির ভাগ আমেরিকানই চেয়েছিলেন, ভোটের মাঠে এ বার অন্য কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নামুন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেন দুই জনে অবশ্য খুব আলাদা দুই কারণে নিজেদের পার্টির নেতা হতে চলেছেন। সব দিক খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বর্তমান শাসক হিসেবে বাইডেন মোটের উপর সফল, অনেক রকম চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এসেছেন, পেরোচ্ছেন। এবং সেই কারণেই তাঁকে সরতে হওয়ার বা সরাতে হওয়ার কোনও প্রত্যক্ষ কারণ নেই। অনেক ডেমোক্র্যাট হয়তো তাঁর মতো বয়স্ক, বিস্মরণপ্রবণ নেতাকে পছন্দ করেন না। এই যেমন, কিছু কাল আগেই যখন এক শিশু তাঁকে জিজ্ঞেস করে যে, শেষ কোন দেশ সফর করে এসেছেন তিনি, প্রেসিডেন্টকে মনে করে বলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল যে মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই আয়ার্ল্যান্ড গেছেন তিনি, সেটাই তাঁর শেষ বিদেশ সফর। কিন্তু আমেরিকায় কোনও পার্টিই এক জন মোটামুটি সফল বর্তমান নেতাকে বাতিল করে ভবিষ্যৎ নেতা হিসাবে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রথায় বিশ্বাস করে না: ১৯৮০ সালে জিমি কার্টারকে সরিয়ে সেনেটর টেডি কেনেডি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চেয়ে সেটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। সে দেশের ইতিহাসে একমাত্র এক বারই হয়েছিল যখন কোনও প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয় বার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি— সেটা ১৮৫৬ সালে। আর চার বার এমন হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হয়েছে বলে যিনি মধ্যবর্তী-কালীন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি পরের বার মনোনয়ন পর্বে জিততে পারেননি। বাইডেনের ক্ষেত্রেও— বয়স, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা এবং কখনও কখনও এলোমেলো কথা বলার প্রবণতা যদি বাদ দেওয়া যায়, তা হলে তাঁকে আর এক বার মনোনয়ন না দিতে চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এক জন বাদে তাঁর সব পূর্বসূরিরাই দুই বার মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনিই বা বাদ যান কেন।

উল্টো দিকে, প্রতি দশ জনের মধ্যে চার জন রিপাবলিকান সমর্থক চান না যে ট্রাম্প আবার মনোনয়ন পান— যে ট্রাম্প, এক সমালোচকের ভাষায়, নিজের দেশ ইউনাইটেড স্টেটস-এর বিরুদ্ধেই ‘সহিংস দেশদ্রোহ’ ঘোষণা করেছেন! যাকে বলা হয় ‘দ্য গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ (জিওপি), তা যেন সম্প্রতি কালে ট্রাম্পকে ঘিরে ব্যক্তিপূজা-কেন্দ্রিক এক চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর স্তরে নেমে এসেছে: পরিস্থিতি এমনই। ঠিক যেমনটা দেখা গেছে ব্রাজ়িলে, বোলসোনারোর নেতৃত্বের মধ্যে। পার্টির গোটা প্রতিষ্ঠান, তার নির্বাচন পরিচালনার পদ্ধতি, মনোনয়ন পর্ব— সবই এখন চরম ট্রাম্পপন্থীদের কুক্ষিগত। তাদের কট্টরপনা যতই যুক্তিহীন হোক, তাদের প্রবল দাপটে গোটা পার্টিকে হাতে রাখার জন্য যত ভোট দরকার, সবটাই ট্রাম্প পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে মনোনয়ন পর্বে ট্রাম্পকে হারিয়ে অন্য কোনও রিপাবলিকান প্রার্থীর উঠে আসার কাজটা সহজ নয়। সেই বিকল্প প্রার্থীকে ‘ফ্যানাটিক’ বা উদ্দাম-উন্মত্ত দক্ষিণপন্থীদের বাধায় নাকাল হতে হবে, যারা আজ জিওপি-র সাধারণ সমর্থক সমাজের টিকিটি ধরে আছে। একমাত্র আদালতে যে সব মামলা ঝুলছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে, সেগুলো দিয়েই তাঁর মনোনয়নের পথে আইনগত বা রাজনীতিগত বাধা তোলা যেতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনাও অতি ক্ষীণ, কেননা দেখাই যাচ্ছে এ সব মামলায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে আরওই বেড়ে চলেছে, প্রতি দিন। সুতরাং মনোনয়ন পর্বের সুতোটা আপাতত তাঁরই হাতের মুঠোয় ধরা।

এ সবে ভারতীয়দের তেমন কিছু এসে যাওয়ার কথা কি? বাইডেন এবং ট্রাম্প দু’জনেই ব্যক্তিগত স্তরে ও রাজনীতিতে ভারত-বন্ধু, এবং ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ চিনের শত্রু, বলা যেতেই পারে। তবে যেটা কৌতূহল জাগায়, তা হল বাইডেন কমলা হ্যারিসকে নিজের ‘রানিং মেট’ বা সম্ভাব্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে ভারতীয়দের থেকে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন লাভ করার সম্ভাবনা। নানা সমীক্ষায় বাইডেন-এর জনপ্রিয়তার অঙ্ক বেশ তলানির দিকে, বাস্তবিক, কোনও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের পক্ষে এত নীচের দিকে ওই অঙ্ক রাখা খুব সুলভ ঘটনা নয়! তবে কিনা কমলা হ্যারিস তাঁকেও টপকে গেছেন, কেননা কোনও ক্ষমতাসীন ভাইস-প্রেসিডেন্টের পক্ষে এমন অ-জনপ্রিয় হওয়ার নমুনা আগে কেউ দেখাতে পারেননি! কমলা হ্যারিসকে সব মিলিয়ে এক জন অকর্মণ্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলাই যেতে পারে, যাঁকে আগে থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে না রাখলে ভুলভাল করবেন এটা ধরে নেওয়া যায়। অত্যন্ত অদক্ষ ভাবে তিনি পরিচালনা করেন নিজের দফতরকে, এবং দফতরের মানুষজনকে। বিষয়টা যথেষ্ট চিন্তার। কেননা, এক জন বয়স্ক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করবেন, তেমন কোনও অঘটনের ক্ষেত্রে তাঁকে যে দায়িত্ব নিতে হতেই পারে, এটা অনেকেই অনুমান করে নেবেন। এবং সে দায়িত্ব তাঁর হাতে গেলে তিনি যে খুব ভাল ভাবে তা পালন করতে না-ও পারেন, সে আশঙ্কাও অনেকের মনে থেকেই যাবে! নিউ জার্সির পূর্বতন গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি সমেত অনেকেই আজকাল খোলাখুলি একটা কথা বলছেন। যদি আবার বাইডেন বনাম ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তাঁরা ভোটই দেবেন না এ বার।

তবে ওই আর কী, ভোটদানে বিরত থাকাটা তো গণতন্ত্রে কোনও সমাধান নয়। নিজের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব থেকে সরে থাকাটা কোনও দায়িত্বসূচক কাজ হতে পারে না। এটা যাঁরা বলছেন, এবং ভাবছেন, তাঁরা আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আমেরিকার আগামী বছরের ভোটারদের সামনে ‘বিকল্প’গুলি কতটাই বেশি সমস্যাজনক, অবাঞ্ছনীয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE