গল্পটা প্রাচীন। বিষ্ণুশর্মা প্রণীত পঞ্চতন্ত্র-এ পড়া। এক পুরুত বামুন ধনী যজমানের বাড়িতে পুজোআচ্চা করে দক্ষিণা-স্বরূপ একটি নধর পাঁঠা লাভ করেন। হৃষ্টচিত্তে ঠাকুরমশাই পাঁঠাটিকে মাথায় চাপিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। মাঝে এক জঙ্গল। সেখানে তিনটি ঠগ লুকিয়ে এই দৃশ্য দেখে, পুরুতের কাছ থেকে পাঁঠাটা বাগাবার ফন্দি আঁটে। ঠগদের প্রথম জন এগিয়ে এসে বলে, “এ কী! আপনার মতো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ একটা অশুচি কুকুর মাথায় চাপিয়ে যাচ্ছেন!” শুনে বামুন তো রেগে কাঁই— “চোখের মাথা খেয়েছ! দেখছ পাঁঠা, বলছ কুকুর!” বামুন খানিক দূর যেতে দ্বিতীয় ঠগের আবির্ভাব। সেও একই কথা বলল। এ বার বামুনের একটু সন্দেহ হল। তবে কি যজমান তাঁকে ঠকাল? আরও খানিকটা পর তৃতীয় ঠগ যখন একই কথার পুনরাবৃত্তি করল, তখন পুরুতের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হল। পরম ঘৃণায় পাঁঠাটিকে মাথা থেকে নামিয়ে তিনি বাড়ির দিকে দে-দৌড়! ঠগরা অতঃপর ভূরিভোজের আয়োজন সারল।
বার বার একই মিথ্যা/অর্ধ-সত্য শুনতে শুনতে চরম আত্মবিশ্বাসীও ‘মিথ্যা-কেই’ সত্য জ্ঞান করে— খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা নীতি-গল্পের এই সারকথাটি যুগে যুগে রাজনীতির কারবারিরা নানা ভাবে ব্যবহার করে চলেছেন। মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের সেনাপতি দ্রোণকে ‘সত্যনিষ্ঠ’ যুধিষ্ঠির উচ্চকণ্ঠে ‘অশ্বত্থামা হত’ শুনিয়ে চাপা গলায় ‘ইতি গজ’ বললে যখন স্নেহশীল পিতা দ্রোণ বাক্যের প্রথম অংশটুকু শুনে অস্ত্রত্যাগ ও ফলত মৃত্যুবরণ করেন, তখন বিষ্ণুশর্মার গল্পের মর্মকথাটির শক্তি বোঝা যায়। বারংবার প্রচারে মিথ্যা/অর্ধসত্যকে ‘পূর্ণ সত্য’-এ রূপান্তরিত করার ব্যাপারটিকে এ-কালে আর্টে পরিণত করেন অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর প্রচারমন্ত্রী গোয়েবেলস্। নাৎসি জার্মানির ‘অভূতপূর্ব সাফল্য’-এর (অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা) প্রচার, মিত্র এমনকি শত্রুপক্ষের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ করে তুলতে সিদ্ধহস্ত গোয়েবলস্ বিশ্বাস করতেন, মিথ্যা যদি বলতেই হয় তবে তাকে আকারে এমন ‘বৃহৎ’ হতে হবে যে, সেই ‘বিগ লাই’ সবাই বিশ্বাস করবে। ‘হিটলার ও জার্মানি অজেয়’ বলে তাঁরা এমন প্রচার করেন যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্বে বার্লিনের পতন ও হিটলারের মৃত্যুর খবরও বহু জার্মান বিশ্বাস করতে পারেননি। আবার ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়ও দেখা গিয়েছে, আমেরিকা ও রাশিয়ার দ্বৈরথের আবহাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সত্য-মিথ্যার ককটেলে তৈরি করে অপর পক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার ‘মাইন্ড গেম’।
এ বার বঙ্গীয় বিধানসভা নির্বাচনেও কি অনেকটা এমনই ঘটেছিল? বাংলা ‘দখল’ করার তীব্র তাগিদে বিজেপি চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক ‘মাইন্ড গেম’ খেলতে গিয়ে কি তাদের সমর্থকদের মধ্যে তো বটেই, মিডিয়া থেকে সাধারণ মানুষ, এমনকি সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের মনেও যে শঙ্কা তৈরি করতে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছিল, তার দরুন ফল ঘোষণার পর তৃণমূল সমর্থকদের জন্য রইল বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দ, আর তাদের প্রতিপক্ষের নেতা থেকে কর্মী-সমর্থকদের মনে হৃদয়ভাঙা হতাশা? সংখ্যার নির্মোহ বিচারে অবশ্য এমনটা হওয়ার কথা নয়। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি ছিল তিন, হয়েছে ৭৭। এর মধ্যে দু’জন সাংসদ পদ ধরে রাখার জন্য বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করায় সংখ্যাটা এখন ৭৫। তবে সেটাও আগের বারের ২৫ গুণ! কিন্তু তবু বিজেপির ‘চিত্তে সুখ নেই’, কেননা, ভোটে হারার পর মনকে প্রবোধ দিতে ২০১৬-র সঙ্গে তুলনা করলে কী হবে, গোটা নির্বাচনী পর্বে তারা ‘নিশ্চিত জয়’-এর আখ্যান গড়ে তুলতে যে পরিসংখ্যান খাড়া করতে চেয়েছে, সেটা ২০১৬-র বিধানসভার ফল নয়, ২০১৯ সালের লোকসভায় ১৮টি আসনের অঙ্ক, বিধানসভা-ওয়ারি হিসেবে যা ১২১, তারই ভিত্তিতে।
এই সংখ্যাটিকে সামনে রেখেই বিজেপির প্রচারে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নানান সদস্য, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রী (বিশেষত যোগী আদিত্যনাথ), দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডার মতো নেতারা তো ছিলেনই, তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন মন্ত্রিসভার ‘নাম্বার টু’, নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে ‘বিশ্বস্ত’ সহকারী ও ‘বিজেপির চাণক্য’ বলে খ্যাত শ্রীযুক্ত অমিত শাহ। অগুনতি সভা থেকে রোড শো’তে সদম্ভ রণহুঙ্কার দিয়ে তিনি যখন বলছিলেন, ‘ইস বার, দোসো পার’, তখন তাঁর বঙ্গীয় সমর্থককুল যেমন উল্লাসে ফেটে পড়েছে, তেমনই অতি-বড় তৃণমূল সমর্থক থেকে বহু নেতাও আশঙ্কায় ভুগেছেন— ভেবেছেন, এত গর্জনের কিছুটা ‘বর্ষণ’ হলেও তো বিজেপি প্রায় কেল্লা ফতে করবে! আশঙ্কা আরও বেড়েছে, যখন পঞ্চম দফার ভোট শেষে ‘চাণক্য’ দাবি করেন েয, তাঁরা ‘জিতেই গিয়েছেন’! এই প্রচারে তাল দিয়ে প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ভাঙা বাংলায় (অমিত শাহ এই ধার মাড়াননি) তৃণমূলের উদ্দেশে বলেছেন ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’, বা ‘এ বার পদ্মে ছাপ/দিদি সাফ’।
প্রকৃত অবস্থা এর বিপরীত ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন জয়ের প্রশ্নে আত্মবিশ্বাসী। তবু, গোড়ার দিকে শাহমশাইয়ের অমিত-দাবি নিয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি যখন বলেছিলেন, “আমি কী করে সংখ্যা বলব, আমি কি ভোট-মেশিনের ভিতরে ঢুকেছি? তবে আমরা খুব ভাল করছি।” তখন বিজেপির বিশ্বখ্যাত আইটি সেল, ট্রোল বাহিনী এবং কিছু কিছু বৈদ্যুতিন মাধ্যম নেত্রীর কথার প্রথমাংশ উদ্ধৃত করে প্রচার করে যে, পরোক্ষে মমতা স্বয়ং মেনে নিয়েছেন তাঁরা জয় নিয়ে নিশ্চিত নন। তার পর থেকে অবশ্য ‘দিদি’ বলতে থাকেন ‘প্রত্যেকটিতেই আমরা জিতছি’, কিন্তু বিজেপির সর্বাত্মক ও লাগাতার প্রচারে তাঁর অনুগামীরা, বিষ্ণুশর্মার গল্পের পুরুতের মতোই, বিভ্রান্তই থেকেছেন! একটি সমীক্ষায় ‘কাকে ভোট দেবেন?’ প্রশ্নে যাঁরা তৃণমূলের কথা বলেছেন, তাঁদের অনেকে ‘কে জিতবেন?’-এর জবাবে বিজেপির কথা বলেছেন!
যে সব ‘যুক্তিবাদী’ ২০০ পাওয়ার দাবিকে অসম্ভব ভেবেছেন, তাঁদের জন্য বিজেপি অন্য ‘ন্যারেটিভ’ ফেঁদেছে (এতে বিজেপি, মিডিয়ার বহুলাংশ, এমনকি তৃণমূলের অনেক নেতাও বিশ্বাস করেছেন)— বিজেপি যদি ১২০ থেকে ১৩৫ পায় এবং তৃণমূল ১৪৮ থেকে ১৬০, তবুও শেষ বিচারে তারাই সরকার গড়বে, কেননা, তৃণমূলের বেশ কিছু নির্বাচিত প্রতিনিধি তখন দল ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবেন! এই প্রচারই শেষ পর্যন্ত বহু তৃণমূল ও অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সদ্য বিজেপিতে যাওয়া তৃণমূল-ত্যাগী, এক কালের এক দুর্দান্ত ছাত্র নেতা, আমাকে নাম ধরে-ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের সম্ভাব্য তৃণমূল প্রার্থীদের কথা বলেছিলেন, যাঁরা আসলে তৃণমূলের গর্ভে ‘বিজেপিরই লোক’! একটা সময় মমতাও এই সম্ভাবনার কথা বলে দু’শো-র কাছে আসন চাইলে পরোক্ষে নির্বাচনোত্তর দলবদলের সম্ভাবনাতেই সিলমোহর পড়ে। এই প্রচারের ধাক্কায় আকৈশোর-চেনা এক প্রিয় সাংবাদিক বন্ধু ‘বিজেপি বোধ হয় এ বার পারল না’, আমার এই মন্তব্যকে ফুৎকারে উড়িয়ে বলেছিলেন, “না গো, হাওয়া বইছে চারিদিকে, বিজেপির হাওয়া!”
‘হাওয়া’ বাংলায় সত্যিই বইছিল। বিজেপি-বিরোধী হাওয়া, চাপা কিন্তু তীব্র, যা সাংবাদিককুল থেকে বিজয়ী-বিজিত রাজনৈতিক দলের সদস্য, এমনকি বহু তথাকথিত ‘ভোট বিশেষজ্ঞ’ বুঝতে পারেননি! তবে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এত দিনে বুঝেছেন যে, চুলদাড়ি বাড়িয়ে বিচিত্র উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওড়ালেই ‘বাঙালি’ হওয়া যায় না। তিনি যেন কবির এই লাইনটাও জেনে নেন— ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’!
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy