পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব যেমন ঘটনার ঘনঘটায় আচ্ছন্ন ছিল, তার সমাপ্তিও হল যথেষ্ট নাটকীয় ভাবে। আসলে এ বারের নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলের নির্ধারক হিসেবে অনেকগুলো উপাদান ছিল, যাদের নিট ফল কী হবে, আগে থেকে বোঝা দুঃসাধ্য ছিল।
এক দিকে ছিল ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া; আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের শ্লথ গতির সঙ্গে মিশেছিল দুর্নীতি ও গা-জোয়ারির অভিযোগ। সেই সঙ্গে কন্যাশ্রী বা স্বাস্থ্যসাথীর মতো জনমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা সমর্থকভিত্তি গড়ে উঠেছে, বিশেষত নারীদের মধ্যে, সেটাও অনস্বীকার্য। বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে ঝাঁপিয়েছিল, যার প্রমাণ প্রচারে আগাগোড়া নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতি। তার দুটো কারণ। ঐতিহ্যগত ভাবে বাম-ঘেঁষা, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত ভাবে অগ্রসর বলে পরিচিত একটি রাজ্যকে যদি গেরুয়া পতাকার তলায় এনে ফেলা সম্ভব হয়, জাতীয় স্তরে তার তাৎপর্য হবে সুদূরপ্রসারী; আর ভারতের জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম ছ’টি রাজ্যের তিনটি (উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশ) বিজেপির নিয়ন্ত্রণে, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু নয়— এ দিক থেকেও জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির রাজ্যজয় উল্লেখযোগ্য হত। বিজেপির অনেক প্রার্থীই তৃণমূল ছেড়ে এসেছেন, ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়াকে যা খানিক দুর্বল করেছে। আবার ধর্মপরিচয়-ভিত্তিক ও জাতপাতের রাজনীতিরও নির্বাচনে বড় ভূমিকা ছিল।
ও দিকে রাজ্য রাজনীতিতে প্রথাগত ভাবে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বামফ্রন্ট ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং তার সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত আইএসএফ জোট বাঁধায় ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়। দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটারদের সিদ্ধান্ত হল, হয় নিজের পছন্দের দলকে ভোট দেওয়া, নয় পরিবর্তন চেয়ে ভোট দেওয়া। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটারদের কাজ আরও শক্ত, কারণ তাঁদের প্রাথমিক পছন্দের দলটি আর বাকি দু’টি দলের মধ্যে কোনটি বেশি অপছন্দ, এবং তাদের মধ্যে কার জেতার সম্ভাবনা বেশি এই সব ক’টা উপাদান মিশে সিদ্ধান্তগ্রহণের কাজ জটিলতর হয়ে দাঁড়ায়, আর তাই নির্বাচনী ফল অনুমান করা আরও শক্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে অতিমারির প্রকোপ বাড়তে থাকায় অনিশ্চয়তারও সৃষ্টি হয়।
তৃণমূল প্রত্যাশার বেশি ভোট (৪৮%) ও আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠা পায়, এই নির্বাচনে ৩৯% ভোট ও ৭৭টি আসন পেয়ে সেই অবস্থান তারা বজায় রেখেছে। বামজোট পেয়েছে মোট ভোটের ৯%, আসন মাত্র একটি, সেটিও পেয়েছে আইএসএফ। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার গড় করে জানিয়েছিল, তৃণমূলের প্রত্যাশিত আসন ছিল ১৩৬, বিজেপির ১৩৮ ও বামজোটের ২০। তৃণমূল প্রত্যাশার থেকে ভাল ফল করেছে, বিজেপি খারাপ; সবচেয়ে হতাশাজনক ফল বামজোটের।
জনমত সমীক্ষা যদি ছেড়েও দিই, গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের অংশ ও আসন সংখ্যা যথাক্রমে ছিল ৪৫% ও ২১১, বিজেপির ১০% ও ৩, আর এ বারের বামজোটের প্রধান দলগুলির সার্বিক ভোটের অংশ ছিল ৩৯% ও আসন ৭৬। অর্থাৎ, এই নির্বাচনে বিজেপির যত লাভ হয়েছে, বামজোটের সেই অনুপাতে লোকসান হয়েছে। এই নির্বাচনের সার্বিক ফলের পরিসংখ্যান থেকে তাই দুটো মূল তথ্য উঠে আসছে: প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের আপেক্ষিক অবস্থার উন্নতি; এবং, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বামজোটকে সরিয়ে বিজেপির উঠে আসা।
তবে এই সার্বিক চিত্র থেকে এক দল থেকে অন্য দলে আসন পরিবর্তনের প্রকৃতি পুরোপুরি বোঝা যায় না। যেমন, আসন পরিবর্তনের আঞ্চলিক চিত্রটা দেখলে দেখা যাবে যে, উত্তর-মধ্য বঙ্গ এবং কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতা অঞ্চলে বামজোটের লোকসান থেকে লাভ করেছে তৃণমূল ও বিজেপি, দুই দলই। আবার রাজ্যের অন্য অঞ্চলগুলিতে বিজেপির আসনলাভ হয়েছে বামজোট ও তৃণমূল (বিশেষত উত্তরবঙ্গে) দুই পক্ষ থেকেই। তাই বামজোটের গত বারের সব ভোট এ বারে বিজেপি পেয়েছে, এমন সরলীকৃত সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে। গত বারের বামজোটের কিছু ভোট এ বারে তৃণমূলও পেয়েছে, আর তৃণমূলের কিছু ভোট গিয়েছে বিজেপির দিকে। ক্ষমতাসীন দল-বিরোধী হাওয়া অবশ্যই আংশিক ভাবে উপস্থিত ছিল, যা থেকে বিজেপি লাভবান হয়েছে। আবার একই সঙ্গে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে পুরনো বিরোধী দলের (অর্থাৎ বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস) থেকে সরে খানিক ক্ষমতাসীন দলের দিকে আর খানিক নতুন বিরোধী দলের (অর্থাৎ বিজেপির) দিকেও গিয়েছে। তাই অনুমান করা যায়, এখানে ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়ার বিপরীতে খানিকটা বয়েছে ক্ষমতাসীন দল-অনুকূল হাওয়াও, যা বিরোধী ভোট ভাগ করে, বামজোটের ভোট কমিয়ে, বিজেপি-বিরোধী দিকে বয়ে ক্ষমতাসীন দলকে সাহায্য করেছে। এর নিট ফল, প্রাক্-নির্বাচনী পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়া থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের ভোট ও আসন বৃদ্ধি।
এর কারণ কী? যে কোনও নির্বাচনের ফল নির্ধারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান কাজ করে। এই পর্যায়ে ভোটবিন্যাস (শুধু আসনভিত্তিক নয়, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক) নিয়ে অপ্রতুল ও অসম্পূর্ণ তথ্য হাতে থাকায় এই প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভাব্য কিছু কারণ আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমে খেয়াল করা উচিত, ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়া শুধু রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না, কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধেও ছিল। অর্থনীতির দিক থেকে দেখুন। এ কথা সত্যি যে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নিরিখে রাজ্যের রেকর্ড সারা দেশের সঙ্গে এবং আগের দশকের তুলনায় পিছিয়ে আছে। কিন্তু যদি ক্ষেত্র ধরে বৃদ্ধির হার বিচার করি, তা হলে লক্ষণীয় একটা তথ্য— পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে গত দশকে বৃদ্ধির হার (৩.৩%) সারা দেশের তুলনায় (১.৬%) উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি, যা তার আগের দশকের ক্ষেত্রে সত্যি নয়। আরও উল্লেখযোগ্য, দেশের সঙ্গে বৃদ্ধির হারের এই তফাত মূলত গত পাঁচ বছরে তৈরি হয়েছে, তার আগের পাঁচ বছর দেখলে (অর্থাৎ, তৃণমূল জমানাতেই) দেশের রেকর্ড রাজ্যের থেকে ভাল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে রাজ্যের রেকর্ড যে সারা দেশের তুলনায় এগিয়ে, সেটা অন্য নানা সূচকেও ধরা পড়বে। যেমন সারা দেশে এবং রাজ্যে গত দশকে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক বেকারির হার বেড়েছে, কিন্তু রাজ্যে বেড়েছে তুলনায় কম। আরও উল্লেখযোগ্য, গ্রামাঞ্চলে নারীদের বেকারত্বের হার গত এক দশকে সারা দেশে বাড়লেও, রাজ্যে খানিকটা হলেও কমেছে। আরও দুটো সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য— গ্রামীণ অঞ্চলে মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয় বৃদ্ধির হার গত দশ বছরে সারা দেশের তুলনায় বেশি, যা তার আগের দশকের ক্ষেত্রে সত্যি নয়; এবং, দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত সারা দেশে অল্প হলেও বেড়েছে, কিন্তু রাজ্যে কমেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়েছে এবং বিজেপি এলে উন্নয়নের জোয়ার আসবে, এই আখ্যানের দুটো সমস্যা: দেশের অর্থনীতির হাল, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতির হাল কোভিডের আগে থেকেই ভাল নয়; এবং রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির হাল তুলনায় মন্দ নয়। তাই রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়া খানিক প্রশমিত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির আপেক্ষিক রেকর্ডের কারণে, এই হাওয়া কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধেও ছিল বলে।
দ্বিতীয়ত, কন্যাশ্রী ইত্যাদি নানা প্রকল্পের সদর্থক প্রভাব আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু শুধু খয়রাতির রাজনীতি করেই ভোটারদের মন জয় করা হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। একাধিক সমীক্ষার ফল দেখাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কিছু সাবেক প্রকল্পের প্রয়োগেও রাজ্যে উন্নতি হয়েছে, যেমন কর্মসংস্থান সুরক্ষা (মনরেগা) এবং রেশন ব্যবস্থা (পিডিএস)।
তৃতীয়ত, ব্যক্তিসত্তামূলক রাজনীতির সমস্যা হল, তা ব্যবহার করতে গেলে অনেক সময় উল্টো ফল হয়। এ বারে বিজেপির ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে মনে হয়। সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গিয়েছে, কারণ মেরুকরণের রাজনীতিতে তাঁরা নিজেদের ভোট আর কাউকে দিয়ে নষ্ট না করে বিজেপির মূল প্রতিপক্ষকে দিয়েছেন। শহরাঞ্চলেও তৃণমূলের ভোট বাড়ার একটা কারণ বিজেপিকে ভোট না দিতে লাগাতার অনলাইন প্রচার, যার আবেদন শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। আরও দুটো উপাদান আছে। মহিলাদের ভোট তৃণমূলকে সাহায্য করেছে, তার পিছনে নানা প্রকল্পের অবদান যেমন আছে, তেমনই এক মহিলা একা লড়াই করছেন, এই ভাবমূর্তির অবদানও আছে। বিজেপির প্রচারে গ্রহণযোগ্য স্থানীয় নেতৃত্বের অভাব ছিল। আর নির্বাচনী প্রচারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাদপ্রদীপের আলো দখল করে রাখা, বাঙালি বনাম অবাঙালি, স্থানীয় বনাম বহিরাগত এই বিভাজনকে সাহায্য করে থাকতে পারে।
এই নির্বাচনী ফলাফল কিছু প্রশ্নকে অমীমাংসিত রাখল, কিছু নতুন প্রশ্নের জন্মও দিল। দুর্নীতি নিয়ে যে বিক্ষোভ, তা প্রশমিত করার কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় কি না; বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি কী নীতি অবলম্বন করবে; বাম ও কংগ্রেস কী করবে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা চলবে।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy