সম্প্রতি কেন্দ্র এবং দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ঘরবন্দির কারণে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রয়োজন মাফিক খাবার জোগান দিতে হবে এবং যাঁরা বাড়ি ফিরতে চান তাঁদের ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। আদালত এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, কেউ পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলেও খাবার পাবেন। এই নির্দেশ এসেছে সামাজিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। কেন্দ্রীয় সরকার এই আবেদনের বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছিল যে, বিভিন্ন রাজ্য সরকার অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করছে, তা ছাড়া সম্পূর্ণ লকডাউনও এ-বার হয়নি, সুতরাং ‘টুকিটাকি সমস্যা’ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই, এখন অতিমারির সঙ্গে বৃহত্তর লড়াই করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট এ-সব শেয়ালের যুক্তি মানেনি, বিচারপতিরা বলেছেন তাঁরা বিভিন্ন রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ সংগ্রহ করবেন, আপাতত রাজধানী ও সন্নিহিত এলাকায় বিপন্ন অভিবাসীদের জন্য তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থার নির্দেশ দিচ্ছেন। সরকারের প্রতি তাঁদের তীব্র ও তীক্ষ্ণ প্রশ্ন: টাকাকড়ি এবং কাজকর্ম না থাকলে পরিযায়ীরা বাঁচবেন কী ভাবে?
গত বছর এপ্রিল মাসে, অতিমারি এবং লকডাউনের প্রথম পর্বে বিপন্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সরকারি সাহায্যের দাবিতে দাখিল করা এমনই এক আবেদনের জবাবে শোনা গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সেই অবিস্মরণীয় জিজ্ঞাসা: সরকার যখন পরিযায়ীদের খাবার ব্যবস্থা করছে, তখন ওঁদের আর খাবারের জন্য টাকা দিতে হবে কেন? এক বছরের ব্যবধানে উচ্চারিত সর্বোচ্চ আদালতের দু’টি প্রশ্ন যদি দুই মেরুর কথা মনে পড়িয়ে দেয়, মহামান্য বিচারালয় নিশ্চয়ই অপরাধ নেবেন না।
সব বছর নয় সমান। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের দূরত্ব ক্যালেন্ডারে মাপবার নয়। এই কালপর্বে আমরা এমন অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, এমন অনেক দৃশ্য দেখেছি, যা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সেই অ-সম্ভব অভিজ্ঞতাগুলি যদি আদালতের বিচারে ছায়া ফেলে থাকে, তা কেবল স্বাভাবিক নয়, ভরসার কথাও বটে। জরুরি ভরসা। তার কারণ, এমন বিপর্যয়েও দেশের শাসকদের মনে একটুও টোল পড়েনি, সরকারি কৌঁসুলি আদালতে দাঁড়িয়ে আজও অম্লানবদনে বলতে পেরেছেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকরা তেমন কোনও সমস্যায় নেই, সমাজকর্মীরা আদালতে নিজেদের মনগড়া কথা বলছেন! রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি উপন্যাসে রাজা গোবিন্দমাণিক্য বলেছিলেন, “হৃদয় যার কঠিন হইয়া গিয়াছে দেবীর কথা সে শুনিতে পায় না।” আমাদের বর্তমান রাজাদের হৃদয় বজ্রাদপি কঠিন। আদালতের ভরসাটুকু তাই অত্যন্ত মূল্যবান।
আমরা অবশ্যই চাইব, আদালত সরকারি অন্যায় এবং অবহেলার প্রতিকার করতে সজাগ ও সক্রিয় থাকবে, প্রশাসনকে কর্তব্যপালনে বাধ্য করতে তার ন্যায়দণ্ড সচল থাকবে মাঝে মাঝে নয়, সর্বদা, সর্বক্ষেত্রে। কিন্তু, বের্টোল্ট ব্রেশ্টের কথা ঈষৎ পাল্টে নিয়ে বলা যায়, দুর্ভাগা সেই গণতন্ত্র যাকে আদালতের ভরসায় থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক— প্রজা নয়, নাগরিক— হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। অতিমারি এবং তার সঙ্গী আর্থিক বিপর্যয় একটি বুনিয়াদি সত্যকে খুব স্পষ্ট করে দিয়েছে। সেটা এই যে— সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ও জীবিকার মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। এটা সত্যিকারের গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। এই শর্ত অস্বীকার করে যে শাসকরা সামাজিক কল্যাণের দায়দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে চায় তারা সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণির স্বার্থরক্ষী হিসেবে অতি উৎকৃষ্ট হতে পারে, কিন্তু তাদের শাসনে জনস্বার্থ বিপন্ন, সুতরাং গণতন্ত্রও। আইন-আদালতের বিচারে সরকারের দায়িত্ব কতখানি, সেটা এখানে নিতান্ত গৌণ প্রশ্ন। এটা আইন বা সংবিধানের কথাই নয়, নৈতিকতার কথা, গণতন্ত্রে যে নৈতিকতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে জনসমাজ, নির্ধারণ করে তার দৈনন্দিন বিচার, উপলব্ধি এবং সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। যাকে মানুষের অধিকার বলা হয়, তার মূলে আছে এই নৈতিকতার ধারণা।
‘স্বাভাবিক অবস্থা’য় এই ধারণা সচরাচর আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট থাকে না, বিশেষ করে বাজার অর্থনীতির সর্বময় প্রচারযন্ত্র যখন অমৃতের পুত্রদের কান কামড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ‘সরকার যত কম, তত ভাল’। কিন্তু বড় রকমের বিপর্যয় ঘটলে আমরা টের পাই, ওই মন্ত্রটি রাষ্ট্র আপন দায় এড়ানোর কুমন্ত্রণা হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। তখন রব ওঠে: সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের জন্য সাহায্য করতে হবে। অর্থনীতিবিশারদরা সমস্বরে বলেন: বাজেট ঘাটতির কথা না ভেবে সরকার টাকা খরচ করুক, এমন ভাবে সেই খরচ হোক যাতে তা গরিবের হাতে পৌঁছয়। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির চাপে নানা দেশে, নানা রাজ্যে পরিত্রাণের অল্পবিস্তর আয়োজন হয়। আবার কোথাও কোথাও রাষ্ট্রের চালকদের হৃদয় এমনই কঠিন হয়ে গেছে যে অতি বড় সঙ্কটেও তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত বক্তৃতা (এবং দু’এক পশলা চোখের জল) ছাড়া আর কিছুই মেলে না। ক্রমে সঙ্কটের মাত্রা কমে আসে, পৃথিবী আবার পুরনো নিয়মে ফিরে যায়, বিপর্যস্ত মানুষ আবার টিকে থাকার প্রাণান্তকর ব্রত পালনে মগ্ন হয়, বাজার অর্থনীতি আবার তার মন্ত্রণা চালু করে: সব কিছু বেসরকারি হলেই ভাল হবে।
এই দুষ্টচক্র যদি ভাঙতে হয়, এখনই তার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগের মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন, অসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী, সচেতন ব্যক্তিনাগরিক— সমস্ত স্তরে স্পষ্ট ভাবে এবং জোরের সঙ্গে এই দাবি তোলা দরকার যে, সরকারকে তার দায়িত্ব স্বীকার করতে হবে এবং সেই দায়িত্ব পালনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এ নিয়ে কোনও টালবাহানা চলবে না, ছেঁদো কথা চলবে না, কান্নাকাটির সস্তা নাটক চলবে না। কী ভাবে সেই দায়িত্ব পালন করা হবে, তার টাকা কোথা থেকে আসবে, সেই টাকা কী ভাবে খরচ করা হবে, তা নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা হোক, যথার্থ গণ-আলোচনা। সদিচ্ছা থাকলে টাকার অভাব যে হবে না, সে-কথা এমনিতেও জানা আছে, তদুপরি অতিমারির মোকাবিলায় আর্থিক শক্তিতে ভারতের সমকক্ষ অনেক দেশের এবং ভারতেরই একাধিক রাজ্যের সরকারি উদ্যোগের সাফল্য থেকেই সেটা পরিষ্কার। আমরা বিলক্ষণ জানি যে, সেন্ট্রাল ভিস্টা ইত্যাদি অপচয় বন্ধ করলেই অনেক টাকা আসে, পেটোয়া ব্যবসায়ীদের বিপুল মুনাফার ওপর সামান্য কর বসালেও টাকার জোগাড় হয়। অভাব টাকার নয়, ইচ্ছার। সেই ইচ্ছা শাসকদের নেই, তাই তাঁদের চাপ দিতে হবে, বাধ্য করতে হবে।
আশার কথা, দাবি উঠছে। তার জোরটাও ক্রমশ বাড়ছে। অতিমারির প্রথম পর্বে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে সহৃদয় সামাজিক উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল, দ্বিতীয় পর্বেও তা হারিয়ে যায়নি, বরং আরও সংগঠিত হয়েছে, কিন্তু তার পাশাপাশি চোখে পড়ছে রাষ্ট্রের কাছে অধিকারের দাবিগুলোকে পেশ করার তাগিদ এবং তৎপরতা। স্বাভাবিক ভাবেই এই মুহূর্তে দু’টি জিনিসের কথা সবচেয়ে বেশি বলা হচ্ছে: খাদ্য এবং প্রতিষেধক। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রয়োজনগুলিকে কেন্দ্র করেই উঠে আসছে বৃহত্তর অধিকারের প্রশ্নগুলিও: সকলের খাদ্য নিরাপত্তা, সকলের কাজ, সকলের জন্য স্বাস্থ্য। সকলের জন্য শিক্ষার কথা তুলনায় কম শুনছি, তার জন্য দায়ী এক দিকে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে দূরদৃষ্টির অভাব এবং অন্য দিকে শিক্ষার পরিসরে বিপুল বৈষম্য— যাদের দাবি জানানোর জোর আছে তাদের সন্তানের লেখাপড়া চালু আছে আর যাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের সেই জোর নেই।
কর্মসংস্থান, খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং এমন নানা মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর অধিকার সকলের, সুতরাং সকলের জন্য এই সমস্ত আয়োজন করতে হবে, এবং অবিলম্বে করতে হবে— এই দাবি নিয়েই এখন যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলার সময়। আট বছর আগে, ইউপিএ জমানার অন্তিম পর্বে, প্রকাশিত হয়েছিল জঁ দ্রেজ এবং অমর্ত্য সেন লিখিত অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস। সেই বইয়ের শেষ অধ্যায়টির নাম: দ্য নিড ফর ইমপেশেন্স। লেখকরা সেখানে বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ও জীবিকার মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর দাবিতে আমাদের এখন অধৈর্য হওয়া দরকার। আমেরিকান লেখক অ্যামব্রোস বিয়ার্স-এর একটি কথা উদ্ধৃত করে তাঁরা লিখেছিলেন: ‘ধৈর্য ব্যাপারটা হতাশার একটা ছোটখাটো রূপ, যা সদ্গুণের ছদ্মবেশে থাকে।’ আজ, মোদী সরকার এবং অতিমারির যুগ্ম আক্রমণে বিপন্ন ভারতে ধৈর্যকে আর কেবল হতাশার ছোটখাটো রূপ বলার জো নেই, এখনও ধৈর্য ধরে থাকাটা মারাত্মক অপরাধের শামিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy