তারাপদ রায় তাঁর কবিতায় দারিদ্ররেখাকে যতই ‘ঝকঝকে লম্বা লাইন’ বলুন না কেন, এই রেখা আসলে খুবই ঝাপসা একটা ফিতে, যা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। প্রথমত, দারিদ্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সহজ কাজ নয়। সংজ্ঞা যদি বা স্থির করা যায়, তার পরের সমস্যা হল, দেশের জনসংখ্যায় সেই দারিদ্রের ব্যাপ্তি বোঝার জন্য যে পরিসংখ্যান প্রয়োজন, তা গত দশ বছরে ক্রমেই অপ্রতুল হয়েছে। পারিবারিক ভোগব্যয় বিষয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এনএসএসও)-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০১১-১২ সালের জন্য; ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্টটি কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করেনি। গবেষকরা পরোক্ষ উপায়ে জাতীয় স্তরে অন্য যে সব পরিবারভিত্তিক ব্যয় সমীক্ষার পরিসংখ্যান আছে, তা ব্যবহার করে ভারতের সাম্প্রতিক দারিদ্রের হার নিয়ে কিছু অনুমান করেছেন, কিন্তু তা থেকে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।
এই পরিস্থিতিতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে এনএসএসও হঠাৎ ২০২২-২৩ সালের পারিবারিক ব্যয় সমীক্ষার একটা অতি সংক্ষিপ্ত তথ্যপুস্তিকা বার করেছে, যাতে দারিদ্র নিয়ে কোনও প্রত্যক্ষ আলোচনা না থাকলেও, বিভিন্ন আর্থিক অবস্থার পরিবারগুলির গড় ব্যয় কী, সেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে— যেমন, ২০২২ সালের অগস্ট থেকে ২০২৩-এর জুলাই অবধি দেশের দরিদ্রতম বা ধনীতম পাঁচ শতাংশ পরিবারের গড় ব্যয় কী ছিল। এই পরিসংখ্যান হাতে পাওয়ার পর থেকে অনেকেই তার থেকে দারিদ্র ও গড় জীবনযাত্রার মান আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন। সেই বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতে চরম দারিদ্র অনেকটাই কমেছে।
এই ফলাফল সত্যি হলে অতীব আনন্দের কথা। কিন্তু অনেকগুলো খটকা লাগার কারণ আছে। সমীক্ষার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি এবং যে সংক্ষিপ্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বিশ্লেষণের সুযোগ কম। ২০১৭-১৮ সালের অপ্রকাশিত সমীক্ষার ফলাফলের বা পদ্ধতিগত সমস্যার কোনও উল্লেখ নেই। সন্দেহ থেকে যায় যে, ফল ভাল হওয়ায় তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন শুরু হওয়ার ঠিক দু’মাস আগে এটি প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে, আংশিক হলেও তথ্য তথ্যই। তার থেকে দারিদ্রের হার কী, এবং গত এক দশকে কতটা কমেছে বা বেড়েছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। দারিদ্ররেখা নির্ণয় করার ধ্রুপদী উপায় হল, এক জন মানুষের জীবনধারণ করার জন্য ও সক্ষম থাকার জন্যে কতটা শক্তি ব্যয় (ক্যালরির হিসাবে) করতে হয়, তার জন্যে যে খাদ্যের প্রয়োজন, তার দাম নির্ধারণ করা। ভারতেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হত— গ্রামে ও শহরে এক জন সক্ষম প্রাপ্তবয়স্কের গড়ে ২৪০০ এবং ২১০০ ক্যালরি দরকার, সেই হিসাবে। দারিদ্র কী করে মাপা হবে, তা নিয়ে ২০০৯ সালে অর্থনীতিবিদ সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন (এফএও)-এর মতে, ন্যূনতম ক্যালরির প্রয়োজনীয়তা ১৮০০ ক্যালরি। তেন্ডুলকর কমিটিও সেই মান ধার্য করে, কিন্তু তার সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ন্যূনতম ব্যয়ের প্রয়োজন যোগ করে নতুন দারিদ্ররেখা প্রস্তাব করে।
২০১১-১২ সালে এনএসএসও-র যে নতুন পারিবারিক ব্যয়ের সমীক্ষা হয়, তাতে এই নিয়ম মেনে দরিদ্র শ্রেণির ব্যয়ের বিন্যাসের পরিসংখ্যান থেকে নতুন দারিদ্ররেখা ধার্য করা হয় গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু ৮১৬ টাকা আর নগরাঞ্চলে ১০০০ টাকা— গ্রামে ও শহরে জনসংখ্যার আপেক্ষিক অনুপাত ধরে জাতীয় গড় দাঁড়ায় ৮৮২ টাকা। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক চরম দারিদ্ররেখার মানও এর খুব কাছাকাছি। ২০১১-১২ সালের পর থেকে যে-হেতু আর পারিবারিক ব্যয় সমীক্ষার ফল পাওয়া যায়নি, তাই পরবর্তী সময়ের দারিদ্ররেখা হিসাব করতে হয়েছে ওই পর্বের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই— মূল্যবৃদ্ধির হার হিসাব করে ওই দারিদ্ররেখার মান বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ সালে সেই রেখার মান গ্রামাঞ্চলে ১৫০০ টাকা আর নগরাঞ্চলে ১৮৫০ টাকা, সর্বভারতীয় গড় ১৬০০ টাকা। সহজ ভাষায়, গত বছর কেউ যদি মাসে মাথাপিছু ১৬০০ টাকা ব্যয় করতে সক্ষম না হন, তা হলে তিনি দরিদ্র হিসাবে পরিগণিত হবেন।
সাম্প্রতিক যে সংক্ষিপ্ত তথ্যপুস্তিকা বেরিয়েছে, তাতে যে পরিবারগুলিকে সমীক্ষা করা হয়েছে তাদের যদি ব্যয়ের নিরিখে দরিদ্রতম থেকে সম্পন্নতম হিসাবে পর পর সাজানো যায়, তা হলে দরিদ্রতম পাঁচ শতাংশের গড় মাসিক ব্যয় হল, গ্রামাঞ্চলে ১৩৭৩ টাকা আর নগরাঞ্চলে ২০০১ টাকা— সর্বভারতীয় গড় দাঁড়াচ্ছে ১৬০০ টাকা, যা দারিদ্ররেখার সমান। সেই দরিদ্রতম পাঁচ শতাংশের মধ্যেও মাসিক ব্যয়ে তফাত থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এই পরিসংখ্যান থেকে বলা যায় যে, ভারতের মোট জনসংখ্যার অনূর্ধ্ব পাঁচ শতাংশ এখন দারিদ্ররেখার নীচে আছেন। ২০১১-১২ সালে জনসংখ্যার ২২% দারিদ্ররেখার নীচে ছিল। অর্থাৎ, এই তুলনা বলছে যে, গত এক দশকে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে অনেকটাই। তবুও খটকা: জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার বা শ্রমের বাজারে মজুরি এবং কর্মসংস্থানের ছবি এই মাত্রায় দারিদ্র হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এর দুটো সম্ভাব্য উত্তর আছে— দরিদ্রকল্যাণের দিক থেকে দেখলে তার একটা ভাল, অন্যটা খারাপ। ভাল উত্তরটা হল, অতিমারির মোকাবিলা করতে সরকার জরুরি কল্যাণমূলক কিছু পদক্ষেপ করে, যার সর্বাধিক পরিচিত উদাহরণ হল রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে আশি কোটি মানুষকে চাল ও গম বিনামূল্যে দেওয়া। প্রকল্পটি এখনও বহাল আছে, কারণ তা রাজনৈতিক ভাবে জনপ্রিয়। আর এর ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের ব্যয়ক্ষমতা বাড়ে, যা এই তথ্যপুস্তিকায় পাওয়া পরিসংখ্যানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
অন্য উত্তরটা হল, মূল্যবৃদ্ধির সঠিক হিসাব না করায় দরিদ্রদের জীবনযাত্রার ব্যয়সূচক কমিয়ে ধরা হচ্ছে— টাকার অঙ্কে যা আসছে, ক্রয়ক্ষমতার হিসাবে তা আসছে না। তেন্ডুলকরের দারিদ্ররেখার সাম্প্রতিক মান হল মাসে ১৬০০ টাকা, বা দৈনিক ৫৩ টাকা। এই টাকাটি কি ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট? আজ যদি কাউকে তেন্ডুলকর প্রস্তাবিত দারিদ্ররেখায় ন্যূনতম ক্যালরির খাদ্য খেতে হয়, তা হলে তার খরচ কত? সবচেয়ে সস্তায় যে সব খাবার থেকে এই ১৮০০ ক্যালরি পাওয়া সম্ভব, তার অন্যতম হল খিচুড়ি। ধরা যাক, রেশনে বিনামূল্যে চাল পাওয়া যাবে। বাকি যা লাগবে, তা হল অনুপাতে ডাল, আনাজ, আর রান্না করার তেল। নুন, মশলা, জ্বালানির খরচ, রান্নার জন্যে সময় ব্যয় ইত্যাদিকে খরচের হিসাব থেকে বাদই রাখা যাক। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে পণ্যমূল্য নিয়ে হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, রোজ এই খিচুড়ি খেয়ে দৈনিক ১৮০০ ক্যালরি পেতে হলে এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাসে খরচ ২৫০০ টাকা, যা তথ্যপুস্তিকার হিসাব অনুযায়ী দরিদ্রতম ২০% মানুষের মাসিক গড় ব্যয়ের বেশি।
যদি দারিদ্ররেখার মান ২০০০ টাকাও ধরি, তা হলেও দেশে দারিদ্রের হার দশ শতাংশের কম হবে না। ভাবছেন, এটা উদ্ভট চিন্তা? ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ইকনমিক সার্ভে-তে একটি পরিচ্ছেদ আছে, যার নাম ‘থালিনমিক্স’। সেখানেও একই ধরনের হিসাব করা আছে
(যদিও রেসিপি আলাদা), এবং সেগুলোর উপর ভিত্তি করলে একটু কম হলেও কাছাকাছিই হিসাব আসছে। অর্থাৎ, তেন্ডুলকর প্রস্তাবিত দারিদ্ররেখার মান যদি ২০২২-২৩ সালে ১৬০০ টাকা হয়, সে টাকায় দরিদ্রতম শ্ৰেণির মানুষের কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্য দূরের কথা, দিনের ১৮০০ ক্যালরি পাওয়ার মতো খাবারও জুটবে না।
মূল সমস্যা কোথায়? ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের (কনজ়িউমার প্রাইস ইন্ডেক্স বা সিপিআই) নিরিখে মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করা হয় এক জন গড়পড়তা ব্যক্তির ব্যয়ের ধরনের উপরে নির্ভর করে; অন্য দিকে, দারিদ্ররেখা গণনার জন্য প্রাসঙ্গিক হল দরিদ্র শ্রেণির ব্যয়ের ধরন, যেখানে কিছু খাদ্যদ্রব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই পণ্যগুলির দাম যদি সাধারণ
মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে দ্রুত হারে বাড়ে, তা হলে আমরা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়সূচকের মানের বৃদ্ধিকে কম করে ধরব। তাই যত দিন না সাম্প্রতিকতম পর্যায়ের সমীক্ষার বিস্তারিত পরিসংখ্যান হাতে আসছে, দারিদ্র কতটা কমেছে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy