—প্রতীকী ছবি।
বারো ক্লাস পাশ করার পর প্রতি বছর বহু ছাত্রছাত্রীকে তাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অভিভাবকদেরও। শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মীদের কাছ থেকে উপদেশ, তথ্যের সাহায্য বা পর্যবেক্ষণ চাওয়ার প্রয়োজন হয়ে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। মানতেই হবে যে, সময়ের সঙ্গে ইন্টারনেট-নির্ভর তথ্যের প্রাচুর্য মানুষকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। তবে, অনেক তথ্য সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও যেটা সহজে বোঝা যায় না তা হল, প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত গুণগত মান কেমন, এবং পরবর্তী কালে সেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেশে বা আন্তর্জাতিক আঙিনায় কী মূল্য পাবে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়েই বিশেষজ্ঞের মতামত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অনেক কিছুর মতো এই পরিষেবারও একটা বাজার আছে। তবে তা সবার জন্যে প্রাসঙ্গিক নয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে এতে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। যেমন বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান কাউন্সেলিং পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নম্বর, ক্রমপর্যায়ে অবস্থান এবং পছন্দের বিষয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা সৃষ্টি করে; এবং এক বা একাধিক রাজ্যের সরকারি বেসরকারি জোগানের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি একেবারে অব্যর্থ তা বলা চলে না, তবু বাছাই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী তাতে সন্দেহ নেই। সমস্যা অনেক বেশি সমাজবিজ্ঞান, আইন, বাণিজ্য, এবং অন্যান্য বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে, কারণ প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ বিচার করার পদ্ধতিটি বহুমাত্রিক এবং গোলমেলে।
স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কর্মজগতে প্রবেশ করার ঠিক আগের ধাপ বলে যথাযথ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে সব দেশেই। বিশ্বায়ন-পরবর্তী পৃথিবীতে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকেই— অন্তত যাদের কাছে এই শিক্ষা বৃত্তি নির্বাচনের সহায়ক হবে— সমকালীন প্রথার বিপরীতে যেতে চাইবে না। এতে ঝুঁকি আছে এবং ক্রমাগত আসতে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা মাথায় রাখলে গড়পড়তা মানুষ যে স্থিতিশীলতা চাইবে, তাতে আশ্চর্য কী। এর ফলে কিছু বিষয় নিশ্চয়ই হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ পরে। মনে রাখা ভাল, পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে যেখানে দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া দুষ্কর; অন্তত, বহু খরচ না করে। সুতরাং, অধিকাংশ মানুষের কাছে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ বার বার আসে না।
শিক্ষা তথা মানবসম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, যতটা চর্চা করলে মানুষের নিজের এবং সামাজিক উপকার এক সঙ্গে ঘটে থাকে, অধিকাংশ মানুষ তার থেকে কিছুটা কম সময় এই খাতে ব্যয় করে। এই ধরনের তথ্যপ্রমাণ আশ্চর্য নয় দু’টি কারণে। এক, মানবসম্পদ সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট খরচ বহন করতে হয়। আর্থিক ভাবে প্রত্যক্ষ খরচ, এবং যে-হেতু পূর্ণ সময়ের শিক্ষায় যোগদান করলে চাকরি বা ব্যবসা করা যায় না তাই অপ্রত্যক্ষ খরচও হিসাবে ধরতে হবে। পড়াশোনা চলাকালীন অনেকে আংশিক সময়ের চাকরি করে থাকে, কিন্তু তাতে অদক্ষ শ্রমিকের থেকে বেশি রোজগার হয় না। দুই, উচ্চশিক্ষা কঠিন, এবং অংশগ্রহণ কমতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মিড-ডে মিল থেকে কন্যাশ্রী প্রকল্প স্কুলশিক্ষা জারি রাখতে সাহায্য করছে তা নিশ্চিত। তবে তার পরের পর্যায় গিয়ে কী হবে, তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে।
উচ্চশিক্ষায় যারা আসবে, তাদের কাছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অগ্রাধিকার পেতেই পারে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মনে রাখাও প্রয়োজন। যেমন, কলেজে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কী রকম; পরিকাঠামো; বিশ্ববিদ্যালয় যে ধরনের সিলেবাস গ্রহণ করেছে, তার সম্বন্ধে ধারণা; এবং ক্যাম্পাস থেকেই চাকরির ইন্টারভিউ হয় কি না। মোটামুটি এর ভিত্তিতেই এনআইআরএফ দেশ জুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রম তৈরি করে প্রতি বছর। কোনও একটি আবেদন করার মাপকাঠি কতখানি কড়া, এবং সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া কতখানি কঠিন, তা-ও নির্ভর করে এই সূচকগুলির উপরেই। যেমন ধরা যাক, সমাজবিজ্ঞানের কয়েকটি বিষয়ের জন্যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কিছু কলেজের খুব সুনাম। এদের পরিকাঠামো উন্নত, নামী অধ্যাপকদের দিয়ে মাঝে মাঝে লেকচার দেওয়ানোর বন্দোবস্ত আছে, এবং অন্য অনেক রাজ্য থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়ের ক্ষেত্র হিসাবে বিশেষ আকর্ষণীয়। উপরন্তু দিল্লিতে থাকার সুবাদে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে— আমলা, মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করে রাখতে পারলে এ দেশে কী না করা যায়? ফলে, এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা প্রবল।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, কিছু ছাত্রছাত্রী নিশ্চিত ভাবেই দেশের এবং বিদেশের সবচেয়ে নামী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে। যে মস্তিষ্ককে এমআইটি গুরুত্ব দেয়, তাকে স্থানীয় কোনও প্রতিষ্ঠানেই আটকে রাখা যাবে কি? উদাহরণস্বরূপ, অর্থনীতিতে ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক স্তরে প্রথম পাঁচশোর মধ্যেই নেই। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স প্রথম ছয় শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপকরা কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে রয়েছেন। সুতরাং দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় না পড়েও রাজ্য স্তরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছাত্রছাত্রীরা পৃথিবীর যাবতীয় নামকরা প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই ভর্তি হচ্ছে বৃত্তি-সহ এবং সুনামের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় শিক্ষকতা বা চাকরি করছে।
পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা হয়, এখনও স্নাতক স্তরে অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা যে রকম যত্নের সঙ্গে শিক্ষাপ্রদান করে থাকেন, তার প্রতিফলন ঘটে চলেছে এই সাফল্যে। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারলেই আরও প্রমাণ হবে যে, স্থানীয় শিক্ষাবিদরা বিষয়ের মৌলিক যে ধারণাগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন, তার আকর্ষণে কত ছাত্রছাত্রী থেকে যাচ্ছে আঞ্চলিক স্তরে। এই শিক্ষাবিদদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত গবেষণাপত্র এবং বই প্রকাশ করে থাকেন নামজাদা জার্নালে। এঁদের কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বলেই বিপণন কম। উন্নত পরিকাঠামো এবং বিজ্ঞাপননির্ভর অতিসক্রিয় প্রতিষ্ঠানকে হারিয়ে ছাত্র আকর্ষণের মূল কেন্দ্র হতে চাইলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের তুলনামূলক সুবিধার কথা জাহির করতে হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম যে মস্তিষ্কসম্পন্ন শিক্ষকের বিকল্প নয়, তা প্রমাণ করতে হলে শিক্ষকদের গবেষণা, বিভিন্ন আলোচনাসভায় যোগ দেওয়ার সংবাদ এবং ছবি, সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে লেখা প্রবন্ধ ইত্যাদি, প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ক্রমাগত প্রকাশ করে যেতে হবে। এগুলো পড়ে কত প্রশংসা পাওয়া গেল তা বড় কথা নয়, কিন্তু প্রতিষ্ঠান যে প্রাণবন্ত, শিক্ষকরা পারদর্শী— এই প্রমাণ ধারাবাহিক ভাবে না দিতে পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা শক্ত। শিক্ষায় উৎকর্ষের অভাব থাকলে এই রাজ্য থেকে সর্বভারতীয় বোর্ড পরীক্ষায় এত ছাত্রছাত্রী প্রতি বছর শীর্ষস্থান অধিকার করত না।
কিন্তু এই সাফল্যকে আর্থ-সামাজিক উৎকর্ষে উন্নীত করতে গেলে রাজ্যের প্রতিভাবান ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠা দিতে হবে, এবং অন্যদের আকর্ষণ করতে হবে। মেধার রফতানি চলতে থাকলে রাজ্যে উদ্ভাবনী শক্তির অভাবজনিত কারণে উন্নয়ন থমকেই থাকবে। যে-হেতু উচ্চশিক্ষায় স্থানীয় মেধাকে আকর্ষণ করার বিষয়টি বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারিগরি এবং আর্থিক সাহায্য বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy