মিলনমুহূর্ত: বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ শুনতে ভিড়, কলকাতা, ৩০ আশ্বিন ১৩১২ (১৯০৫)। —ফাইল চিত্র।
একটা গান কখনও কখনও হয়ে ওঠে একটা দেশ। একটা সমগ্র। খণ্ড খণ্ড হয়েও একটা অখণ্ড। সে গান লিখতে পারেন বব ডিলান। সে গান লিখতে পারেন লালন ফকির। সে গান যখন লেখেন রবীন্দ্রনাথ, তখন সে গানের ‘আমি’ আর আমি থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে সমষ্টিতে, যে ‘তুমি’ প্রেমিকা কিংবা প্রেমিক সেই তুমি হয়ে ওঠে ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’। ‘তুমি’ হয়ে ওঠে দেশ।
‘জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে’— এ লাইন যখন গাওয়া হয়, তখন ‘লাবণ্য ও লড়াই’ এক হয়ে যায়।
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ এমন একটি গান, যা সমস্ত ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে। রবীন্দ্রনাথ এখানেই চূড়ান্তকে স্পর্শ করেছিলেন। তিনি বাঙালির অস্মিতাকে, বাঙালির ভালবাসাকে, বাঙালির আত্মত্যাগকে ‘অখণ্ড ভারতী মানস’-এর সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’— এই পাঁচটি শব্দ যেন পাঁচে পঞ্চবাণ। এত সহজ পাঁচটি শব্দে ওই উত্তাল, হিংস্র, ব্যথিত, দ্বিখণ্ডিত ১৯০৫ সালে কী করে এক জন কবি জোব্বার ভিতর থেকে একটি বিষণ্ণ হাত এগিয়ে দিলেন ভারতবর্ষের দিকে, সেই কম্পমান হাতে একটি রাখি। আর তাঁর ‘হৃদয়পুরে চলিতেছিল’ একটি কীর্তনের সুর। তিনি জানতেন কীর্তনের সুরই হল সেই সুর, যা সবাই গাইতে পারে, সবাই মনে রাখতে পারে। এমনকি তাঁরাও পারেন, যাঁরা বাঙালির ঘরে অন্য ভাষাভাষী ভাই বোন। আমি ছোটবেলায় কৃষ্ণনগরে শুনেছি, কটক থেকে আসা আমাদের পাশের বাড়ির মালি জগন্নাথদা গাছ লাগাতে লাগাতে গুনগুন করে গাইতেন, ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন/ এক হউক এক হউক, এক হউক হে ভগবান’। কী মিষ্টি লাগত তাঁর গলায়! ওই একটা লাইন আমরা বার বার শুনতে চাইতাম।
গানটি আট লাইনের। কোনও স্তবক বিভাজন নেই। গানটির প্রথম চার লাইনে ‘বাংলার’ শব্দটি আট বার শোনা যায়। লেখার গুণে, নরম চলনে, স্নিগ্ধ গমনে মনে হয় যেন আরও আট বার বললেও অতিরিক্ত হত না। কিন্তু পরের চার লাইনে তিনি ‘বাংলার’ না বলে সাত বার ‘বাঙালির’ শব্দটা প্রয়োগ করলেন। এই ‘বাঙালির’ শব্দটার ভিতরে ঝুঁকি ছিল। স্বদেশ পর্যায়ের গান, এত বার ‘বাঙালি’ বললে কি প্যারোকিয়াল দোষ দেখা দিতে পারে— প্রাদেশিকতায় দুষ্ট হতে পারে এই গান? এখানেই রবীন্দ্রনাথের মাস্টারস্ট্রোক। তিনি আট বারের বদলে সাত বার বললেন শব্দটা। অষ্টম বারের জায়গায় বসিয়ে দিলেন বিশল্যকরণী। কী সেই ঔষধি? তিনি লিখলেন, ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’। ‘ভাই’ আর ‘বোন’ এই শব্দ দুটোর মানে জানার জন্য ভারতের বৃহত্তম এবং মহত্তম বাংলা অভিধান হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ খুলে বসার দরকার নেই। ভাই মানে যে শুধু একই মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা নয়, বোন মানে যে একই জঠরনির্গত নয়, সে কথা যদি বাগানে গাছ লাগাতে লাগাতে জগন্নাথদা বুঝতে পারেন, আমরা পারব না? আমরা পারব, কিন্তু আমরা কেন পারব? একটু লোক খ্যাপাব না? ষাঁড়ের সামনে একটু লাল কাপড় নাড়াব না?
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার লিখে গিয়েছেন, ভাই মানে সহোদর, ভ্রাতৃতুল্য ব্যক্তি, স্বদেশবাসী ব্যক্তি। তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ আগুনকেও ভাই বলতে পারেন, সেই ক্ষমতা তাঁর গানে আছে। ‘বোন’ মানেও শুধু সহোদরা নয়। ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’ কথাটার মধ্যে যে স্নেহ যে আদর যে ‘বুকে টেনে নেওয়া’ আছে, তা অতুলনীয়।
এখানে যে ‘অল ইনক্লুসিভনেস’ আছে, তা আসলে শান্তিনিকেতন থেকে এক দিন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভাবলে সারা শরীরে শিহরন জাগে যে, ওই মানুষটা মণিপুর থেকে জাভা, সুমাত্রা থেকে দক্ষিণ ভারত, মরাঠা থেকে কলিঙ্গ থেকে একটা গোটা ভারতবর্ষকে শান্তিনিকেতনের উঠোনে নিয়ে এসেছিলেন।
ন্যাশনালিজ়ম যাতে হিংস্র না হয়ে ওঠে, সে ব্যাপারে বার বার গান্ধীকে চেতাবনি দিয়েছেন। ইউরোপ আমেরিকাকেও তিনি শান্তিনিকেতনের অন্নজলে সিক্ত করিয়েছেন। বীরভূমের পচা গরমে একটা লন্ঠনের পাশে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক বাংলাকে তথা ভারতবর্ষকে। রবীন্দ্র রচনার অনুপুঙ্খ গবেষক, কবি শঙ্খ ঘোষ একেই বলেছেন ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’।
আর এক গবেষক, রবিজীবনী-র লেখক প্রশান্তকুমার পাল লিখছেন, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৫ অক্রূর দত্ত লেনে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, “রাখীবন্ধনের প্রস্তাব সম্ভবত এই সভাতেই প্রথম ঘোষিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে তাঁর বিখ্যাত ‘রাখীসঙ্গীত’ বাংলার মাটি বাংলার জল রচনা করেন।”
গানটির কোথাও তিনি রাখি শব্দটি এক বারও ব্যবহার করেননি। তবু তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান’। তিনি বিভাজনের রাজনীতিকে মাথা তুলতে দেননি।
এই মুহূর্তে বাঙালির ঘরে যে তর্কটা চলছে তা হল, কেন সে দিন নেতাজি ইনডোরে চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বাঙালি’ পাল্টে ‘বাংলা’ করে দেওয়া হল? আমি এখানে একটা কথা পরিষ্কার বলে রাখি যে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে নবান্নের বৈঠকে আমি ছিলাম, বাংলার বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে আমিও সহমত হয়েছিলাম যে, এই গানটিকে রাজ্যসঙ্গীত করা হোক। কোনও শব্দ পরিবর্তন সম্ভব কি না, তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ ডিসেম্বর), কোনও শব্দ পাল্টানো হবে না। যে কোনও সচেতন নাগরিক জানেন রবীন্দ্রনাথের একটি সেমিকোলনও পাল্টানো যায় না, যেমন নজরুলের সুর পাল্টানো যায় না। আমার কথা একটাই, যেখানে কোনও প্রয়োজন নেই, অর্থের কোনও ঘাটতি নেই, ব্যঞ্জনার কোনও কুণ্ঠা নেই, সাত রকম ‘অ্যাম্বিগুইটি’ নেই, সেখানে যে গান আমাদের মর্মে গিয়ে দেশ জাগিয়ে তুলছে, অন্য ভাষার ভাই বোনদের ঘরে এনে বসাতে বলছে, যে গানে কোনও আমরা ওরা নেই, সেই গান গীতবিতানে যে ভাবে ছাপা হয়ে আসছে, সে ভাবেই আমরা গাইতে পারি।
সে ভাবেই গাওয়া উচিত। এ গানের আত্মা ঘাসের উপরে শিশিরবিন্দুর মতো পবিত্র। মনে পড়ে গেল ইটালীয় লেখক উমবের্তো একোর কথা, “লাইক আ স্পুন, ওয়ান্স ইনভেনটেড, ইট ক্যান নট বি বেটার্ড।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy