Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
শিকড়ের গোড়ায় টান পড়েছে, মনে করিয়ে দিক একুশে ফেব্রুয়ারি
international language day

আন্তরিক, না কি আনুষ্ঠানিক

মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা ‘পার্বণীকরণ’ কতটা বাড়াতে পারে, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা কিছুতেই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না।

Preparation before International Language Day Program

একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে গণ্য হওয়াতে এখন এই দিনের অনুষ্ঠানের চাকচিক্য বেড়েছে। ফাইল ছবি।

গোপা দত্ত ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪৯
Share: Save:

আবার এসে গেল একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে গণ্য হওয়াতে এখন এই দিনের অনুষ্ঠানের চাকচিক্য বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি, পোস্টার আঁকা ইত্যাদির মাধ্যমে দিনটি পালিত হয়। আলোচনা কালে ১৯৫২ সালের পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-শহিদদের সঙ্গে ১৯৬১’র উনিশে মে-র শিলচরের ভাষা-শহিদদের যোগ করে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। যদিও ভাষা-শহিদ বলতে শুধু আমাদের দেশেই আরও অনেকের নাম চলে আসে। তবে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন যাঁরা, সাধারণত আমরা তাঁদেরই স্মরণ করি। কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক’ বিশেষণটি যুক্ত করে কি আমাদের দেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে বিলুপ্তির বা অবহেলার মুখে দাঁড়িয়ে একান্ত ত্রস্ত অসংখ্য ভাষার মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? বস্তুত আমাদের মাতৃভাষাও কি সেই ত্রস্ত ভাষাগুলির মধ্যেই পড়ে না? এ-হেন উক্তিতে অনেকেই ক্ষুব্ধ, এমনকি ক্রুদ্ধ হতে পারেন— পার্বণের মুখে দাঁড়িয়ে উল্টো কথা বলার মতো অপরাধ আর কী আছে?

মুশকিল হল, মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা ‘পার্বণীকরণ’ কতটা বাড়াতে পারে, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা কিছুতেই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। কেন জানি না, এ প্রসঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ নামে একটি আশ্চর্য গল্প মনে পড়ে যায়। গল্পের কেন্দ্রে আছে একটি কিশোর, ধনী সহপাঠীর বাড়িতে নিয়মিত যেতে যেতে, অঢেল আরামে অভ্যস্ত হতে হতে হঠাৎ সে অনুভব করে নিজের মা, নিজেদের গরিব শান্ত টিমটিমে সংসার থেকে তার বিযুক্তি ঘটে যাচ্ছে।

“‘কাঁদছিস কেন!’ ব্যস্ত হয়ে মা শুধোয়। আমি কথা বলি না। আমি কি বলতে পারতাম রোগা ময়লা কাপড় পরা তোমার শুকনো মুখের কথা ভুলে গিয়ে ও-বাড়ির শাড়িগয়না-পরা প্রগল্ভ-স্বাস্থ্য সুকুমারের মা’র দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আর কখন তিনি সাদা পাথরের বাটিতে করে আমাকে ও সুকুমারকে আপেল আনারস কেটে দেবেন সেই সোনা-ঝরা বিকেলের অপেক্ষায় আমি শুকিয়ে থাকতাম— থাকতে আরম্ভ করেছি।”

গল্পের কিশোরটি কাঁদতে পেরেছিল, এবং তার থেকেও কঠিন একটি কাজ করে উঠতে পেরেছিল। সে আর সুকুমারদের বাড়িতে যায়নি। আমাদের সমস্যাটা অনেক জটিল। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি আমাদের প্রাণের ভাষাটি জমি ছাড়তে ছাড়তে ক্রমে আরও ম্লানমুখ, বিষাদময়ী হয়ে উঠছে। প্রবল দাপটে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে বাহুবলী দু’টি ভাষা পরাক্রম প্রকাশ করছে। সোনা-ঝরা ভবিষ্যতের আশায় আমরা সন্তানদের প্রাণপণে সেই শক্তিসাধনার দিকে ঠেলে দিতে কসুর করছি না। মুখে কথা ফোটার আগেই প্রায় এই প্রাণান্তকর ব্যায়াম শুরু হয়ে যাচ্ছে। শুধু এ বি সি ডি চেনা নয়—সাত রঙের বর্ণিমাকেও রেড, ব্লু, গ্রিন, ইয়েলো, ব্ল্যাক ইত্যাদি নামে যাতে শিশুরা চেনে তার প্রয়াস কম জরুরি নয়। বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় প্রশ্নাবলি ইংরেজিতে করা দস্তুর। যে শিশু চটপট বন্য জন্তুদের টাইগার, লায়ন, এলিফ্যান্ট বলে চিহ্নিত করবে, রেড রোজ়, গ্রিন লিফ— এই সব বুলি কাটতে পারবে, তার ভাগ্য তত সদয় হবে। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ছাড়া পড়াশোনা হয়, এই ধারণাটাই সমাজ থেকে অদৃশ্য হতে শুরু করেছে। সরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আর্থিক দিকে দুর্বলতা এবং নগরকেন্দ্র থেকে দূরাঞ্চলে বসবাস— প্রধানত এই দু’টি কারণে বাবা-মায়েরা নেহাত অপারগ হয়ে বাংলা মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের পাঠান, এ কথা বললে কি মিথ্যাভাষণ হবে?

বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের যদি কোনও ধারাবাহিক দুর্বলতা থাকে, তার প্রতিবিধানকল্পে কী করা যায়, সেটা ভেবে দেখা দরকার। তবে এক বার ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি হলে উপরে ওঠার সিঁড়ি সুনিশ্চিত— এই ধারণার কোনও শক্তপোক্ত ভিত্তি নেই। আমরা সকলেই অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে জানি এবং মানি যে, মাতৃভাষায় পড়াশোনা করলে বাড়তি অনেকখানি সুবিধা পাওয়া যায়। যে কোনও বিষয় অধিগত করার ক্ষেত্রে, স্বচ্ছ ধারণাশক্তি গড়ে ওঠার ব্যাপারে এর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের অবস্থাটা দুর্যোধনের মতো। ধর্ম কী তা জানি, কিন্তু তাতে প্রবৃত্তি নেই। এক বার পছন্দসই বিলিতি খাপে ভরে ফেলার পর, করুক না যত খুশি ওরা একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসব। রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের বাছা বাছা গান শিখুক, শামসুর রাহমানের কবিতা পড়ুক— তাতে সংস্কৃতিপ্রেমী আমরা গর্বিতই থাকি। লালপাড় সাদা শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা ইত্যাদি পোশাকে দিনটাকে বেশ পুজো-পুজো আমেজ দিলেই বা মন্দ কী! আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বরে হয়তো চোখে পড়ছে না যে শিকড়ের গোড়ায় টান পড়ছে।

মাতৃভাষার গৌরব যাপনে উৎসাহী হলেও আঞ্চলিক উচ্চারণের ক্ষেত্রে নাসিকাকুঞ্চনে অসুবিধা বোধ করি না আমরা। পরিমার্জিত পরিশীলিত কলকাতার কথ্য ভাষা (অন্য কথ্য ভাষাও এই কলকাতাতে কম নেই, যাকে ‘অকথ্য’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।) ছাড়া অন্য কোনও প্রান্তিক সুর যদি গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়েদের বাচনে ধরা পড়ে— কী ধরনের পরিহাস সমাজে বর্ষিত হয় একটু কান পাতলেই শোনা যাবে। ইংরেজি শব্দের ভুল উচ্চারণ যেমন ‘মারাত্মক অপরাধ’, আঞ্চলিক সুর লাগিয়ে কথা বলাও তেমনই নিম্ন স্তরের সংস্কৃতি বলে আমরা ধরে নিয়েছি। বিদেশি শাসকেরা যে আমাদের দেশীয় শব্দগুলিকে যদৃচ্ছা ভুল উচ্চারণ করে আবার তা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, সেই বিভ্রাটে অবশ্য আমাদের দৃষ্টি ক্ষমাসুন্দর।

এ রাজ্যের অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের অধিকার বিষয়েও অসাড়তা শিক্ষিত মানসে পরিব্যাপ্ত। শক্তিময়ী হিন্দির কথা বলছি না, বিশেষ করে জনজাতিদের ভাষাগুলিই মনে করছি। সংখ্যার দিক দিয়ে লঘু হলেও তা কম গুরুত্বের নয়— আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি প্রতি বছর আমাদের মনে করিয়ে দেয়। ১৯৫২ বা ’৬১-র দমনকারীরা এই গুরুত্বটিই বিস্মৃত হয়েছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE