ঋদ্ধ: ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস-এর রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও বিদেশি প্রতিনিধিরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৮। —ফাইল চিত্র।
বছরের শুরুতেই বড়সড় ধাক্কা খেল ভারতের বিজ্ঞান সমাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের (ডিএসটি) অসহযোগিতায় বন্ধ হয়ে গেল শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী একটি বিজ্ঞান অধিবেশন। কেন বন্ধ হয়ে গেল আর তাতে কী ক্ষতি হল, তা বুঝতে গেলে আগে এই অধিবেশনের গোড়ার কথা একটু জেনে নিতে হবে।
ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন বিজ্ঞান সংস্থাগুলোর একটা হল ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন (প্রতিষ্ঠা ১৯১৪), মুখ্য দফতর কলকাতায়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী কালে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমনের মতো ব্যক্তিত্ব সভাপতি হয়েছেন। দেশ জুড়ে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত নাগরিকদের পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া এদের কাজের মধ্যে পড়ে। এভরিম্যান’স সায়েন্স নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এক-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় প্রতি বছর ৩-৭ জানুয়ারি সংস্থাটি একটি জাতীয় স্তরের বিজ্ঞান সম্মেলন (বিজ্ঞান কংগ্রেস) আয়োজন করে, বরাবর যাঁর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের কথা এখনও অনেকের মনে আছে। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে গবেষণা করছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন ছাত্রছাত্রীরা এই সেমিনারে নিজেদের কাজ নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জনকে বেছে ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট’ পুরস্কারও দেওয়া হয়। বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা এক সঙ্গে নিয়ে এমন ‘বিজ্ঞানের কুম্ভমেলা’ ভারতে আর হয় না। ঐতিহ্য, ব্যাপ্তি ও বৈচিত্রের দিক থেকে বিজ্ঞান কংগ্রেস অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনেকখানি।
২০২১ ও ২০২২-এ কোভিডের কারণে বন্ধ থাকার পর ২০২৩-এ এই অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়, যার উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন অনলাইনে। এ বছর ১০৯তম বিজ্ঞান কংগ্রেস হওয়ার কথা ছিল পঞ্জাবের লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি (এলপিইউ)-তে। কিন্তু নির্ধারিত দিনের মাত্র দু’সপ্তাহ আগে এলপিইউ জানিয়েছে, অনিবার্য কারণে তারা এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারছে না। ফলে কার্যত বন্ধ হয়ে গেল বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অনুষ্ঠান; থেমে গেল ১০৯ বছরের ইতিহাস, যার পিছনে রয়েছে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতর (ডিএসটি) ও সায়েন্স কংগ্রেসের ঠান্ডা লড়াই।
বিজ্ঞান কংগ্রেসের মতো একটা বিপুল আকারের সম্মেলনের মুখ্য ব্যয়ভার বহন করে ডিএসটি। এই টাকা সায়েন্স কংগ্রেসের হাতে আসে না; যে বিশ্ববিদ্যালয় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়, ডিএসটি-র অনুদান সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছয়। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত বছর ডিএসটি-র তরফে হঠাৎই সায়েন্স কংগ্রেসকে যাবতীয় আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানানো হয়; অভিযোগ অস্বীকার করে সায়েন্স কংগ্রেস আদালতে যায়। তখনও পর্যন্ত ১০৯তম সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ডিএসটি-র অনুদান বন্ধ হয়ে যেতে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। তখন এলপিইউ স্বেচ্ছায় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি এর আগেও (২০১৯) বিজ্ঞান কংগ্রেস সম্মেলন করেছে; তাদের পরিকাঠামো অনুষ্ঠানের উপযুক্ত মনে করে সায়েন্স কংগ্রেস কর্তৃপক্ষও রাজি হন। অতঃপর সেপ্টেম্বরে ডিএসটি সায়েন্স কংগ্রেসের কাজকর্মের বিরুদ্ধে আরও কঠিন অভিযোগ আনে; এমনকি অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তনও যে ডিএসটি-র অনুমতিসাপেক্ষে হয়নি, কিছু সদস্যের মর্জিমাফিক হয়েছে, এমন অভিযোগও করা হয়। তবু প্রস্তুতি চলছিল। অনুষ্ঠানসূচি তৈরি, বক্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে এলপিইউ তাদের অক্ষমতার কথা জানাল।
বিজ্ঞান কংগ্রেস কোথায় হবে তা নিয়ে আগে কোনও দিনই ডিএসটি মাথা ঘামায়নি, তার কথাও না। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে সায়েন্স কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ডিএসটি রীতিমতো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করায় বিরোধ ঘনিয়ে উঠেছে, যার ফল অনুদান বন্ধ করে দেওয়া। যেমন ইতিমধ্যেই ডিএসটি এভরিম্যান’স সায়েন্স-কে আন্তর্জাল-পত্রিকায় পরিণত করেছে। এখন তারা মনোনীত সদস্যদের নিয়ে একটি কার্যনির্বাহী সমিতি গঠন করতে চাইছে; সায়েন্স কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচন থেকে বিজ্ঞান কংগ্রেসের গবেষণাপত্র নির্বাচন, সব এই সমিতি ঠিক করবে। কিন্তু ডিএসটি-র কাছ থেকে সরকারি অনুদান পেলেও সায়েন্স কংগ্রেস আসলে একটি নথিভুক্ত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, ডিএসটি-র থেকে অনেক পুরনো; তাদের নিজস্ব কার্যপদ্ধতি এবং দায়বদ্ধতা আছে। ভোটদানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের কার্যনির্বাহী সমিতি তৈরি হয়। তাই নির্বাচিত একটি সমিতিকে সরিয়ে শুধু মনোনয়নের মাধ্যমে গঠিত সমিতিকে শীর্ষে বসাতে তারা স্বাভাবিক ভাবেই নারাজ। নিয়ম না মানলে ডিএসটি যে অনুদান বন্ধ করে দেবে এই হুমকি তারা আগেই দিয়েছিল, সেটাই এ বার হাতে-কলমে করে দেখাল।
কিন্তু এলপিইউ এগিয়ে এসেও কেন হঠাৎ পিছিয়ে গেল? উত্তরটা অনুমান করা যায়। ডিএসটি-র কাছ থেকে পরোক্ষ চাপ তাদের উপরে নিশ্চয়ই এসেছিল। আর আজকের ভারতে, যেখানে সব অনুদান ডিএসটি-র কুক্ষিগত, তাকে চটিয়ে কে বাঁচবে? অনুদান ছাড়া কেউই টিকে থাকবে না। তাই দুইয়ে দুইয়ে চার করা কঠিন নয়।
ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, একটি সরকারি সংস্থা শুধু তাদের ‘কথা শুনে না চললে’ এক শতাব্দীপ্রাচীন সংস্থার প্রাপ্য অনুদান বন্ধ করে দিতে পারে! আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এখনও আদালতের বিচারাধীন, আলোচনার মাধ্যমে তা মেটানোর চেষ্টা না করে ডিএসটি যে ভাবে অনুষ্ঠানটাই বন্ধ করে দিল, জানতে ইচ্ছে করে এই অধিকার তাদের আছে কি না। কিন্তু আজকের ভারতে প্রশ্ন করার কোনও জায়গা নেই। এ কথা সত্যি যে, উৎকর্ষের বিচারে বিজ্ঞান কংগ্রেস কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে, নামী প্রতিষ্ঠানের নামকরা বিজ্ঞানীদের উচ্চমানের গবেষণাপত্র সেখানে আর পড়া হয় না। মূলত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিয়েই চলে সম্মেলন। তার পরেও বিজ্ঞান কংগ্রেস একটা বিজ্ঞান সম্মেলন, মেলা নয়। সীমিত অনুদানে যাঁদের গবেষণার কাজ করতে হয়, তেমন গবেষকদের মতামত বিনিময়ের একটা জায়গা দেয় এই সম্মেলন। তার মানের অবনতির কারণ খতিয়ে না দেখে সায়েন্স কংগ্রেস বন্ধ করে দেওয়াটা কোনও ভাবেই লঘু করে দেখা যায় না।
২০১৫ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ‘বিজ্ঞান ভারতী’ নামের একটি ‘স্বদেশিয়ানা সমৃদ্ধ’ সংস্থার সহযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশন্যাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল’ (আইআইএসএফ)। প্রধানমন্ত্রী সেখানে অনেক বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন, আন্তর্জালে এই অনুষ্ঠানে তাঁর নানা ভঙ্গিমার ছবি শোভা পাচ্ছে। এখানে উৎসব বেশি, বিজ্ঞান কম, গবেষণা আরও কম। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নানা প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী, পাশাপাশি নানা বেচাকেনা— হাতে তৈরি শৌখিন জিনিস থেকে দামি জামাকাপড়— এবং এ সবের মধ্য দিয়ে দেশীয় কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠা, এই নিয়েই উৎসব। ২০২২-এর ‘থিম’ ছিল ‘বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রয়োগকৌশলকে সঙ্গে নিয়ে অমৃতকালের দিকে যাত্রা’। প্রায় একই থিম ছিল ২০২৩ ও ২০২৪-এও, যেখানে ওই ‘অমৃতকাল’টি জ্বলজ্বলে। কিন্তু বিজ্ঞান মেলার নানা উপকরণের মধ্যে যাঁরা বিজ্ঞানের ছোঁয়া খুঁজেছেন তাঁরা চূড়ান্ত হতাশ হয়েছেন, এমন মতামতও পাওয়া গেছে।
‘ফেস্টিভ্যাল’ বনাম ‘কংগ্রেস’ দ্বৈরথ কাম্য নয়, দু’টি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র আলাদা। কিন্তু ‘সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল’ যে ভাবে এগোচ্ছে আর বিজ্ঞান কংগ্রেস যে ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে কংগ্রেসের বদলে উৎসবই চালু থাকবে এমন একটা আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, আর তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিজ্ঞানী সমাজ। ২০১৯-এ বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেই গণেশের শরীরে হাতির মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সে বারও দেশ জুড়ে, দেশের বাইরে থেকেও বিজ্ঞানীরা প্রতিবাদ করেছিলেন, সায়েন্স কংগ্রেসকে তড়িঘড়ি যাবতীয় অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাতেই হয়তো কর্তাব্যক্তিরা ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, তাই এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানধারার ঐতিহ্য নিয়ে যাঁরা প্রবল উৎসাহী, বিজ্ঞানচর্চার সমকালীন ধারাটির প্রতি তাঁরা কেন যত্নশীল নন, এই প্রশ্ন তীব্র হচ্ছে। তেমনই, সরকারি অনুদান বণ্টনের দায়িত্বে থাকা একটি সংস্থা তার অধীন একটি সংস্থার উপরে কতটা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে, সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। আশা রাখি, দেরিতে হলেও অন্য কোথাও বিজ্ঞান কংগ্রেস হবে, এ বছরই!
এর মধ্যেই গত ১১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি স্কুলে মকরসংক্রান্তি পালনের নির্দেশ এসেছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে ‘সূর্যের মকর রাশিতে সরে যাওয়া’র সঙ্গে জড়িত প্রাকৃতিক ঘটনার উপস্থাপনা ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে তার প্রভাব নিয়ে নানা আলোচনা, প্রবন্ধ রচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, ষোলো কলা পূর্ণ হতে বেশি দেরি নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy