কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের চাপে বোর্ড পরীক্ষা বাতিলের পর থেকে বঙ্গসমাজে ‘মেধা’ নিয়ে প্রবল চিন্তা দেখা যাচ্ছিল। অজন্তা সুব্রহ্মণ্যন কাস্ট অব মেরিট, অথবা মাইকেল স্যান্ডেল টিরানি অব মেরিট নিয়ে যতই বই লিখে ফেলুন, বাৎসরিক মেধাতালিকা ঘিরে সমাজমাধ্যমে আহা-উহু, সংবাদমাধ্যমের ইন্টারভিউ ও টিভি চ্যানেলে ‘মেধাবী’দের নোটবইয়ের বিজ্ঞাপন— এ না হলে কি বাঙালির ভাত হজম হয়?
যে কোনও পাঠ্যক্রমে যথাযথ মূল্যায়ন শিক্ষার অঙ্গ। এ বছর দশম ও দ্বাদশে মূল্যায়নের পদ্ধতি যথাযথ ছিল কি না, এই নিয়ে পর্যালোচনা অবশ্যই কাম্য। দেড় বছর ঠিক করে স্কুল হয়নি। করোনা-যুগে পাঠপদ্ধতি কেমন হবে, শিক্ষাকর্মীদের ভ্যাকসিন দিয়ে, স্কুলস্তরে করোনা পরীক্ষা বাড়িয়ে স্কুল কেমন করে খোলা যাবে, এই নিয়ে সদর্থক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে নিত্যনতুন নব্যউদারবাদী ‘রিস্ট্রাকচারিং’-এর বরাত দিলেও, করোনাকালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকে এক অদ্ভুত নীতিপঙ্গুত্ব দেখা দিয়েছে। রাজ্যগুলিকেও দেখে মনে হয়নি যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছুটা কল্পনাশক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন আছে— কোনও ক্রমে পরিকাঠামোহীন অনলাইন ক্লাসই মোক্ষ। ঢেউয়ের বিরতিতে স্কুল খোলার প্রচেষ্টা, চিন্তাবিহীন ভাবে। এক-একটা ক্লাসরুমে/ ল্যাবে জায়গা কতটা, হাওয়া চলাচল হয় কি না, ছাত্রছাত্রীদের নিয়মের প্রতি ভালবাসা কতখানি, এ সবই উপরতলার লোকজন ভুলে গিয়েছেন!
তবে, স্বাভাবিক অবস্থায় এই ‘বড়’ পরীক্ষা দু’টিতে সত্যিই ঠিক মূল্যায়ন হয় তো? স্মৃতিশক্তির ও কয়েক ঘণ্টা টানা হাতে লেখার ক্ষমতার পরীক্ষা ছাড়াও যুক্তি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, কল্পনাশক্তির মূল্যায়ন হয় তো? দ্বাদশ শ্রেণিতে ‘সফল’ ছাত্র যখন অনার্স পড়তে এসে স্বাধীন ভাবে একটা বাক্যও লিখতে পারে না, অথবা একটা অধ্যায় পড়ে তার অর্থ বুঝতে পারে না, তখনও সেই মূল্যায়নের দাম থাকে তো?
অর্থব্যবস্থার তালা খোলার এক বছর পরে, ১৯৯২ সালে, দেশের নানা স্কুল শিক্ষা বোর্ডের দেওয়া নম্বরে সামঞ্জস্য নিয়ে আসার জন্য তৈরি করা হয় ‘মার্কস মডারেশন’ নীতি। এর পর ১৯৯০-এর দশক জুড়ে ব্র্যান্ড আইআইটি-র গঠন ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার রমরমা, উচ্চশিক্ষা স্তরে বেসরকারিকরণের হিড়িক। ২০১৩ সালে দুই ব্লগার দেবার্ঘ্য দাস ও প্রশান্ত ভট্টাচার্য সিবিএসই ও আইসিএসই পরীক্ষার নম্বরের তথ্য বিশ্লেষণ করেন। দেখা যায় যে, সে বছর সিবিএসই-তে ৯৫%-এর সংখ্যা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পায়, আবার আইসিএসই পরীক্ষায় কেউ কোনও বিষয়ে ৮১, ৮২, ৮৪, ৮৫, ৮৭, ৮৯, ৯১ অথবা ৯২ পায়নি! সিবিএসই-র নিজের সমীক্ষায় আবার দেখা যায় যে, অধিকাংশ রাজ্য বোর্ড বেল কার্ভ নীতি না মেনে ৯০%-এর উপরে অস্বাভাবিক হারে নম্বর দিয়েছে, হয়তো সিবিএসই-র সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলেই। এর পর জল গড়ায় অনেক দূর। অবশেষে ২০১৭ সালে সিবিএসই ও অন্য ৩২টি স্কুলশিক্ষা পর্ষদ জানায়, তারা আর মডারেশন নীতি মানবে না।
আসলে, মডারেশন-এর নাম করে নম্বর বাড়িয়ে নিজেদের বোর্ডকে আকর্ষক হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন বোর্ডকর্তারা। কোচিংব্যবস্থার রমরমায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া মূল্যায়ন পদ্ধতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিছুটা বাধ্য হয়েই তাঁরা জনপ্রিয় হওয়ার এই সহজ পদ্ধতি বেছে নেন, ফিরে আসা তাঁদের সাধ্য নয়। এর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিভিন্ন কলেজে অস্বাভাবিক হারে কাট অফ বেড়েছে। বছর বছর ভারতীয় গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা (এমপ্লয়েবিলিটি) নিয়ে গুরুগম্ভীর বাণী সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠেনি— দশম-দ্বাদশ স্তরে সব ঠিক আছে তো?
অথচ, ১৯৯২ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে দেখা যাচ্ছে যে নীতিনির্ধারকরা বলছেন, স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। ‘এক্সটার্নাল পরীক্ষা’-নির্ভরতা কমানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে আমরা কী পেয়েছি? কন্টিনিউয়াস ইভ্যালুয়েশন-এর নামে ‘ক্লাস টেস্ট’, উইকিপিডিয়া থেকে টুকে তৈরি করা কিছু রংচঙে ‘প্রজেক্ট’। আধুনিক ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতিতে টার্ম-শেষের পরীক্ষার থেকেও বেশি জোর দেওয়া হয় ফর্মেটিভ অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতিতে, কিন্তু বিশুদ্ধ ভারতীয় পদ্ধতিতে ‘ডেফিনিশন’ ও ‘কি ওয়ার্ড’ যাচাই করাই দস্তুর। কড়া খাতা দেখা একেবারেই চলবে না। অবশ্য, স্কুলশিক্ষকের সেই সময়, পরিকাঠামো বা বেতন— কিছুই জোটে না। বেসরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণির বাক্যগঠন করতে না শেখা ছাত্রীকে ‘নোট’ দেওয়া হয়। অতঃপর, মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট চালু হওয়ার তিন দশক পরেও বাঙালির আশঙ্কা জাগে, ‘বড়’ পরীক্ষাটা না হলে, পাশ-ফেল না থাকলে, চাকরির বাজারে ছাত্রছাত্রীদের জাত যাবে না তো?
এর পরেও ব্যর্থ মূল্যায়ন পদ্ধতি টিকিয়ে রাখতে হবে কেন, উত্তর মিলবে না। প্রজেক্ট-নোটবই টুকে হাতে-কলমে কুম্ভিলক বৃত্তি শিখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বলা হবে, চাকরির বাজারের ‘যোগ্য’ নয় তারা! জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’তে আমেরিকান ৫+৩+৪ মডেলে ‘রিস্ট্রাকচারিং’-এর বরাত দেওয়া থাকলেও, এ সমস্যা সমাধানের হদিস পাওয়া যায়নি। অতিমারি পরিস্থিতিতে অন্য রকম ভাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy