দেশদ্রোহী প্রকারে ও সংখ্যায় গোকুলে বাড়ছে। তকমা লাগানোর পবিত্র কাজটা শুরু হয়েছিল মুসলমান দিয়েই, যাদের প্রায় সবাই যে আসলে পাকিস্তানি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ ছাড়া খ্রিস্টানদেরও গতিবিধি সন্দেহজনক। সদ্য আবার শিখরাও ঢুকে পড়েছে তালিকায়, পাগড়ি আর হলুদ রঙের ঝান্ডা মানেই খালিস্তানি, এ কি আর বলার অপেক্ষা। যে জাঠরা ছিল ভরসার ভোটব্যাঙ্ক, তারাও যে তলায় তলায় এত বেইমান কে জানত।
ও দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দেশদ্রোহী বরাবরই থিকথিক করছে, কেবল জেএনইউ, যাদবপুর, জামিয়া মিলিয়া কেন, অন্য ইউনিভার্সিটিগুলোও তাল মিলিয়েছিল না গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে? আর তার পর তো এল কোটিখানেক পরিযায়ী শ্রমিক। ৫০০ কিলোমিটার হেঁটেছে তো কী হয়েছে, দেশের মঙ্গলের জন্য ও-সব একটু করতেই হয়।
এ ছাড়া অধিকাংশ শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সকলেই বড্ড অ্যান্টিন্যাশনাল। আশার কথা, শুধু টিভির চিল-চিৎকার করা সাংবাদিকরা সবাই ‘ভক্ত’। যে ক’জন বেসুরো, তাদের নামে একে একে দেশদ্রোহের মামলা ঠুকলেই সমঝে যাবে।
এ বার দেশদ্রোহের তালিকায় নতুন যোগ হয়েছে চাষি। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, আর তার পরিবার: সব মিলিয়ে সারা দেশে প্রায় ৫০ কোটি নতুন সম্ভাব্য দেশদ্রোহীর সন্ধান মিলল। আশ্চর্য, মাসের পর মাস প্রবল ঠান্ডার মধ্যে রাস্তায় বসে আছে। অথচ তাদেরই সুখসমৃদ্ধির জন্য যে সরকারের প্রাণ কাঁদছে, সেটুকু বুঝছে না। চেষ্টা চলছে, যদি রাজপথ কেটে, রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে চাষিদের থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়। তবে মুসলমান সেই ভাবে নেই, তাই জন্য এই সমস্যাটা কেমন একটু শিশিবোতলের মতো ঠেকছে।
অ্যান্টিন্যাশনাল সামলাতে সামলাতে এল নতুন বিপদ, টুইট— একেবারে অ্যান্টি-ইন্টারন্যাশনাল। পপ-গায়িকার টুইটেযোগ্য জবাব দিতে হল বিদেশ মন্ত্রক থেকে, বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে। তবে হ্যাঁ, দেখতে হয় আমাদের ক্রীড়া ও বিনোদনের ‘ভক্ত’ তারকাদের, দু’শো জন প্রতিবাদী কৃষকের মৃত্যুর মতো তুচ্ছ ঘটনায় সময় নষ্ট না করেও দেশের শত্রু কৃষকের মোকাবিলায় সবাই কেমন সুন্দর এক সুরে ‘ঐক্য’বদ্ধ। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিরা নাক গলাবে কেন, আমরা নাহয় আমেরিকার নির্বাচনের আগে ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’ একটু বলেইছি !
কপাল আর কী, দেখতে দেখতে ছ’বছরের মধ্যে হাফপ্যান্ট বাহিনী আর দেশের সেবায় নিবেদিত কিছু শিল্পপতি ছাড়া দেশের এত রকম মানুষ দেশদ্রোহী, ‘আন্দোলনজীবী’ হয়ে উঠল। কতই না প্রচার চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় মগজধোলাইয়ে, চাষির এক মন্ত্র, শ্রমিকের আর এক, ছাত্রের অন্য। বার বার বলা হচ্ছে, অর্থনীতি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ছোট ও মাঝারি ব্যবসার হাল খারাপ হচ্ছে, কর্মহীনতা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু ‘হমারা দো’ কিংবা হাতে-গোনা বড় কোম্পানির তো মুনাফা বাড়ছে, তাই শেয়ারবাজারও তো দেশপ্রেমের মতোই ঊর্ধ্বমুখী।
এর মধ্যে এসে পড়ল বাংলার ভোট। সোনার উত্তরপ্রদেশ, সোনার ত্রিপুরা গড়ার কাজটা শেষ। সোনার বাংলাটাই যা বাকি। বাড়ির কাছে দিল্লিতে লালকার্ড, ঝাড়খণ্ডে অর্ধচন্দ্র— ও সব ভুলে এখন বাংলার খেলাটা ধরতে হবে ‘রামকার্ড’ দিয়ে। দিল্লি সীমান্তের চাষিদের তোয়াক্কা না করে মালদহের চাষির সঙ্গে খিচুড়ি ভক্ষণ তাই। বাঙালি মনীষীর জন্মদিনের গন্ধ পেলেই ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়া। অসমে এনআরসি নিয়ে ল্যাজে-গোবরে হলেও বাংলায় যে করে হোক সিএএ-টাকে গাজরের মতো ঝুলিয়ে রাখতে হবেই। একটা বাঁচোয়া, টাকা-লোভ-ভয় ত্রিফলায় পটাপট ছিপে বা চার্টার্ড প্লেনে উঠে পড়ছেন ও-দিকের নানা নেতা, দশ বছর মন্ত্রী বা সান্ত্রি থাকার পর ভোটের তিন মাস আগে যাঁদের অন্তরাত্মা জনগণের জন্য কাজ করার আকুতিতে ডুকরে কেঁদে উঠছে।
বাংলার হালচালই কেমন যেন। গোটা গোবলয় যেখানে নবরাত্রির উপোস করে শুকিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এরা নবমীর দিন মাংস খাচ্ছে, চিকেন রোল খেতে খেতে ঠাকুর দেখছে, দেবীকে উমা নাম দিয়ে বাড়ির মেয়ের মতো আহ্লাদ করছে, পুজো মানেই এদের খাওয়া-নাচ-গানের মোচ্ছব। এ সব অনাসৃষ্টি বন্ধ করা দরকার। রামনবমীর দিন খোলা তরোয়াল হাতে না নাচলে আবার হিন্দু কী। যত যা-ই হোক, কোথায় রাম, কোথায় দুর্গা।
স্বভাবটাই মন্দ। হিন্দি ছেড়ে যারা বলে বাংলা ‘আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক’, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। নাটের গুরু গুরবোর রাবিন্দারনাথ টেগোরের বিশ্বভারতীকে একেবারে চৌপাট না করে দিলে বাংলায় দেশভক্তি আসবে না। ভিদিয়াসাগরজির মূর্তি কলেজে রাখাও বন্ধ করতে হবে, ভেঙে দিয়ে অষ্টধাতুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা ভাল। অমর্ত্য সেনের নাকটাও ঘষে দেওয়া জরুরি।
এ দিকে টিকাপর্ব চুকলে তবে মতুয়ারা নাগরিক হবে, আপাতত তারা ঘুসপেটি। তা হলে তাদের ভোট দেওয়া, কিংবা বিধায়ক বা সাংসদ হওয়া? জটিল প্রশ্ন। আরও মুশকিল, সে দিন সংসদে তথ্য পেশ হল, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ এখন বছরে পাঁচশোরও কম। কী করা, ঘোষণা করতে হল, দেশ বাঁচাতে এখন ও-পার বাংলার পায়রাকেও ঢুকতে দেবে না সীমান্তরক্ষীরা। ওরে ‘গ্রহবাসী’, এখনও আরও তিন মাস, ‘চোলায় চোলায় বাজবে’ ভোটের ভেরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy