—প্রতীকী ছবি।
আরও এক বার নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়ল— অন্তত ৮০০টি ওষুধের। ২০২২ সালে জীবনদায়ী ওষুধের দাম ১০.৮% বেড়েছিল। ২০২৩ সালে ফের বেড়েছিল ১২.১২%। প্রতি বছর কেন দাম বাড়বে ওষুধের? অত্যাবশ্যক ওষুধের ক্ষেত্রেও কেন কোনও সুবিবেচনা কাজ করে না? লোকসভা ভোটের মুখেও মূল্যবৃদ্ধি আটকানো গেল না কেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর লুকিয়ে আছে নির্বাচনী বন্ডে অর্থদাতাদের তালিকায়।
মোট ৩৫টি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলকে অর্থ দিয়েছে। অনুদানের পরিমাণ প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকা। যে কোনও পণ্য উৎপাদকই অতিরিক্ত খরচ তুলতে দুটো তাৎক্ষণিক উপায় বেছে নেয়। হয় তারা পণ্যের দাম বাড়ায়, নয়তো পণ্যের গুণমানে আপস করে। দু’ক্ষেত্রেই ক্রেতার বিপদ। আর পণ্যটি যদি ওষুধ হয়, তা হলে তো কথাই নেই।
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার দেওয়া তালিকায় ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলির নামের তালিকা দীর্ঘ। এরাই আমাদের রোজের দরকারি ওষুধগুলির নির্মাতা, জোগানদার। করোনাকালেই দেখা যায় যে, এই সংস্থাগুলি ওষুধের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। শুগার, প্রেশার, থাইরয়েডের ওষুধের দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়তে থাকে। এমনকি কিছু ব্র্যান্ডে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে দেখা যায়। ২০২৩ সালের ১ এপ্রিল ১২.১২% দাম বৃদ্ধিতে সবুজ সঙ্কেত দেয় ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি। অন্তত ৮০০টি ওষুধের দাম বাড়ে। প্যারাসিটামল, অ্যামোক্সিসিলিন, মরফিন, অ্যামপিসিলিনের দাম বেড়ে যায়। অ্যামিকাসিন, বেডাকিলিন, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিনের মতো যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধকারী ওষুধের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময়ে এডস-এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত একাধিক ওষুধের দামও বাড়ানো হয়েছিল। এ বারেও দেখা যাচ্ছে তালিকায় স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক, পেনকিলার, ভিটামিন ট্যাবলেট, রক্তচাপ-শুগার-কোলেস্টেরল এবং জ্বর-সর্দি-কাশির ওষুধ রয়েছে।
দাম দিয়ে ওষুধ নাহয় কিনলাম, তাতে রোগ সারবে তো? বন্ডে চাঁদা দিয়েছে, এমন সাতটি সংস্থা গুণমানের পরীক্ষায় বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এমন একটি সংস্থা আছে সেই চাঁদাদাতাদের তালিকায়, নিম্নমানের ওষুধ তৈরির জন্য গত দু’বছরে অন্তত পাঁচটি নোটিস পেয়েছে যে সংস্থাটি। বারংবার প্রশ্ন উঠেছে অন্য একাধিক ওষুধের গুণমান নিয়েও। কোভিডের সময় একটি সংস্থা ফাভিপিরাভির এনেছিল বাজারে। এই ওষুধটির কার্যকারিতা প্রমাণিতই হয়নি। ঠিক তেমনই আরও একটি সংস্থার করোনা-ঔষধি তার কার্যকারিতা প্রমাণের তৃতীয় ট্রায়ালে যোগই দেয়নি। অথচ ওষুধ বাজারে চলে এসেছে। আর একটি ওষুধ নির্মাতা সংস্থার চেয়ারম্যান নিজের সংস্থা থেকে তো বটেই, অন্য দু’টি অকিঞ্চিৎকর সংস্থার তহবিল থেকেও প্রথম দফায় মোট পাঁচ কোটি এবং দ্বিতীয় দফায় মোট কুড়ি কোটি টাকা চাঁদা দেন নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। সেই কারণেই কি ভ্যাকসিন বাজারে জায়গা করে নিয়েছিল তাঁদের পণ্য? লক্ষণীয় যে, ভারতে টিকা প্রস্তুতকারক তিনটি প্রধান সংস্থাই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে শাসক দলকে চাঁদা দিয়েছে।
তালিকায় এমন বহু ওষুধ প্রস্তুতকারকের নামও আছে, যারা খানাতল্লাশির পর বন্ডে অনুদান দিয়েছে। ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর হায়দরাবাদে তেমনই একটি সংস্থার দফতরে আয়কর বিভাগ থেকে তল্লাশি চালানো হয়। প্রথম দিনেই ১৪২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। অন্তত ৫৫০ কোটি টাকার হিসাব গরমিল দেখানো হয়। পরের দু’বছরে এই সংস্থাই ৬০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল এই গোষ্ঠীরই হেটারো ড্রাগ ১৯ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। ওই একই বছর, ১১ জুলাই বন্ড কেনা হয়েছে ১০ কোটি টাকার। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে একই গোষ্ঠীর অন্য শাখা ৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। আর একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছে ১ কোটি। ২০২২-২৩ সালে গুজরাতের এক ওষুধ নির্মাতা সংস্থা মোট ২৯ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল বন্ডে। সংস্থাটির রেমডেসিভিরের একটা ব্যাচে ব্যাক্টিরিয়াল এনডোটক্সিন পাওয়া যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আর একটি সংস্থার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে ন্যশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের হয় যে, তারা পরিবেশবিধি লঙ্ঘন করে তামিলনাড়ুর কাঞ্চনপুরমে কারখানা সম্প্রসারণ করছিল। কিন্তু দেখা গেল মাত্র তিন মাসের মধ্যে পরিবেশ মন্ত্রক থেকে যাবতীয় ছাড়পত্র জুটিয়ে ফেলল এই সংস্থা। চাঁদাদাতাদের তালিকায় এই সংস্থাটিও আছে। এক কাফ সিরাপ প্রস্তুতকারক সংস্থার তৈরি ওষুধ খেয়ে উজ়বেকিস্তানে ৬৮টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। সেই সংস্থাকেই আবার কাজ চালু করার ছাড়পত্র দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। কী ভাবে তা সম্ভব হল, সে উত্তরও হয়তো পাওয়া যাবে আগামী দিনে।
এ কথা সত্য যে, ওষুধ প্রস্তুতকারকদের থেকে অর্থ পেয়েছে অন্তত ১১টি দল। তবে, সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে অন্য কারও তুলনাই চলে না। একটি ত্রিভুজের এক বিন্দুতে অনুদানদাতা তথা ওষুধনির্মাতা, অন্য বিন্দুতে রাজনৈতিক দল, তৃতীয় বিন্দুতে এই দুইয়ের প্রচারযন্ত্র। এই ত্রিকোণের মাঝে ধুঁকছে ভারত। যতই রাজবৈদ্য আসুক, অমল কখনও আর সুস্থ হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy