Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Songs

মেয়েদের গানে জীবনবসন্ত

গ্রামীণ নারীর একটা বড় অংশের গতিবিধি অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ ছিল না। সংসার বা পেশা, নানা প্রয়োজনে খেতখামার হাটবাট সর্বত্র ঘুরে বেড়ান তাঁরা। তাঁদের মনের কথাতেও মিশে থাকে আকাশ-মাটির গন্ধ।

Songs

—প্রতীকী ছবি।

চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৬
Share: Save:

বাঁকুড়ার ছাতনা বা বীরভূমের নানুরে রামী ধোপানি বা রজকিনির ঘাট কারও নজরে পড়ে, কারও পড়ে না। কেউ থামেন, কেউ এগিয়ে যান ব্যস্ততায়। চতুর্দশ শতকের কবি রামী তবু আজও ‘প্রেমের শিরোমণি’। যতই ‘নিকষিত হেম’ বলা হোক, বৈধব্যের বেড়া, জাতপাতের বাধা টপকে প্রেমে পৌঁছনোর যাত্রাপথ কেমন ছিল মেয়েটির, জানার কৌতূহল থেকেই যায়। বৃত্তিজীবন একটু হলেও কি মেয়েদের জন্য কোনও স্বাধীন পরিসর তৈরি করত সে সময়? গ্রামসমাজের অন্য বৃত্তিজীবী মেয়েরা— গোয়ালিনি, জেলেনি, কাটুনি, মালিনী, কৃষি ও তার সঙ্গে জড়িত হালিক রমণীদের জীবনযাপনের হদিস পেতে আজও প্রণোদিত করেন রামী ধোপানি।

চর্যাপদের যুগে মেয়েরা নৌকা বাইতেন, শুঁড়িখানা চালাতেন। দিনে-রাতে ধান ভানা হচ্ছে, হাট সেরে দিনান্তে বধূরা কড়ি গুনতে গুনতে ঘরে ফিরছেন, বলেছেন লক্ষ্মণ সেনের সময়কার কবিরা। গোবর্ধন আচার্য আর্যাসপ্তশতী-তে জানান, ‘কৃষকরমণীরা স্বাধীনা’; কলমগোপী বা রজকিনিদের মনোভূমের গতিবিধি তুলে ধরেন তিনি। কয়েক শতক সময়সরণি পরেও রামীর উত্তরসূরি কৃষি ও অন্য বৃত্তিজীবী মেয়েদের অন্তরমহলের কথা রয়ে গেছে তাঁদের নিজস্ব গীতস্বরে।

গ্রামীণ নারীর একটা বড় অংশের গতিবিধি অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ ছিল না। সংসার বা পেশা, নানা প্রয়োজনে খেতখামার হাটবাট সর্বত্র ঘুরে বেড়ান তাঁরা। তাঁদের মনের কথাতেও মিশে থাকে আকাশ-মাটির গন্ধ। ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ তত্ত্ব এ সব ক্ষেত্রে খাটে না। অল্প বয়সে বিয়ে যেমন হত, উল্টোটাও প্রচলিত কোনও সমাজে— ধুলোমাটি মেখে এক সঙ্গে খেলতে খেলতে বড় হওয়া ছেলেটির প্রতি এক হঠাৎ-টান অনুভব করে কোনও মেয়ে। “বড়ো বাঁধের আড়ে যাত্যে, লাগলো গো প্রেমের হাওয়া,” “দেখিলে ভালো লাগে, না দেখিলে পরান কাঁদে”।

প্রথম নিবিড়তার শুরু ‘হাতে হাতে গুয়া দিতে’, বা লাল শালুকের ফুল আনার আবদারে। বিপদ বাড়ে কারও চোখে পড়লে, শুরু হয় শাসন, উপদেশ। মনের কথা কিন্তু বলা হয়ে যায়, “ছাড় বইলতে কি ছাড়্যে দিই, শিশুকালের পিরতি।” এ বার দেখাসাক্ষাৎ আরও সাবধানে, গাব গাছের আড়ে বা লিচুর বাগানে। জলের ঘাটে আসা-যাওয়ার সময়টা জানা থাকলেও, দরকার মতো তা তৈরি করেও নেওয়া হয়, “কলসির জল মাজিয়ায় ঢালিয়া, কলসি হইল মোর খালি রে।” অভিভাবক বিয়ের খোঁজখবর শুরু করলে জেদি মেয়ে জানিয়ে দেয়, “বাইছ্যা লিবো আমি মনের মত ছোকরা।”

গানে ফুটে ওঠে দাম্পত্যপ্রেম। রোদে হাল চালনারত স্বামীকে দেখে কৃষকবধূর মনে হয়, “আমার বন্ধু হাল বাহে রামকানালির ধারে/ ও তার কালোমুখে ঘাম ঝরে দেখে হিয়া ফাটে।” স্বামীর ঘামঝরা মুখ দেখে মন পোড়ে, তাই পান্তাটা সে নিজেই খাইয়ে আসতে চায়। বর্ষার জলে সারা দিন ভিজে ধান রোয়ার শেষে মেয়েটিও চায় ঘরের বন্ধুর স্নেহস্পর্শ, “আরে গাওখান হইল মোর ন্যাতের প্যাতের নাওছা বেছন গাড়িয়া আসো বন্ধুধন যাও দেখিয়া।” কখনও স্বামীর অনুপস্থিতিতে রজোদর্শনে স্ত্রী আক্ষেপ করেন, “এমন দিনে ফুটছ ফুল রে, আমার স্বামী নাই ঘরে/ আমার স্বামী যদি থাইকতো কাছে রে, আমি মনের কথা বইলতাম তারে রে।” গ্রামীণ মেয়েদের বরযাত্রার গানে ‘কথার দোসর’ আর ‘বিছিনার দোসর’ আনার উল্লেখ, ‘দাসী আনা’র ধারণা সেখানে অনুপস্থিত। দীর্ঘ অদর্শনে যুবতী বধূ চাকরি ছেড়েই চলে আসার পরামর্শ দেন, “গলার হার ব্যাচেয়া দিম মুই ঐ চাকিরির কড়ি।”

সব সম্পর্কে এই প্রেম থাকে না। বয়সের ফারাক, নেশা, অসুস্থতা, নানা কারণে প্রেমহীন দাম্পত্যও বোনা মেয়েদের গানে। টাকার লোভে ‘বুঢ়া’ বা ‘ভেন্দা’ বরে বিয়ে দিলে, সেই সম্পর্কের বাইরে কোনও বন্ধুত্ব জরুরি হয়ে ওঠে জীবনে। উদ্‌গ্রীব মেয়ে রান্নাও বন্ধ রাখে তখন, “খাকের চুলো নিবাই দিয়ে শুনবো বন্ধুর গান।” নানা প্রয়োজনের ভরসা সেই বন্ধুর আসা-যাওয়া চলে, “আমার সোনাবন্ধু রে আমার ভাবের বন্ধু রে/ আমার বাড়ি কাতিপুজা ঢাকের বায়না দে।” বন্ধুত্বের দৃঢ়তা ও গভীরতা এতই যে মেয়েটি জানায়, বৈধব্য যদি কখনও মানেন তা হবে বন্ধুর মৃত্যুতে, স্বামীর মৃত্যুতে নয়: “বিয়ার সোয়ামি মইলে মাছ-ভাত খাওং মুই/ বন্ধু মরিলে হবো আড়ি।” (বিধবা) ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের বাইরে, সমাজের একটা বড় অংশে মেয়েদের দ্বিতীয় বিবাহ বহুদিন ধরেই প্রচলিত: কাইন, সাঙা, নিকালা বা উঠানী বিয়া। তবে দুঃখের অভিজ্ঞতা আছে বলেই দ্বিতীয় বারে নারী খুঁজে বেড়ান দরদি প্রেম: “যে মোরে দরদি হইবে ধুতির খুঁটে গাও হাঁকাইবে গামছা দিয়া মুছিয়া রে দিবে ঘাম... সোনামুখে তুলিয়া রে দিবো পান।”

পল্লিনারীর প্রেম ছড়িয়ে থাকে জলে স্থলে, গাছপালায়, আকাশে, জমিতে। গাছকে জড়িয়ে তাঁরা ‘সই’ পাতান, উৎসবে নদীকে নিমন্ত্রণ করে আসেন; অনাবৃষ্টিতে খেতমাঠ যখন জ্বলে যায় তখন প্রেমের গান আর নগ্ননৃত্যে মেঘদেবতার কাছ থেকে বৃষ্টি ছিনিয়ে আনার পণ করেন। নরনারীর প্রেমময়তায় যে উর্বরতার বার্তা, ধান রোয়ার সময় তারই গান শুনিয়ে মাঠভরা ফসলের স্বপ্ন দেখান সমাজকে। মাটির প্রতিকৃতি, রঙিন তৈজসপত্র, ফুল-আলপনা বসনপুজোয় বিয়ে আর প্রেমের গান গাইতে গাইতেই জীবনবসন্তের উদ্‌যাপন করেন গ্রামবালারা।

অন্য বিষয়গুলি:

Songs Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy