প্রজন্মান্তর: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।
চার পাশের পরিস্থিতি চঞ্চল। তার মধ্যে তৃণমূলের অন্দরমহলও এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সেই পরীক্ষায় এনে ফেলেছেন তাঁর হাতে গড়া দলকে। যার ফলে সামনে এসে পড়েছে রাজ্যের শাসক দলে প্রবীণ-নবীন টানাপড়েনের চর্চাটিও।
বিশেষ করে এমন একটি সময়ে মমতা বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যখন পর পর ভোট, এবং রাজ্যে শাসক দলের বিভিন্ন স্তরে নব্য নেতৃত্বের উত্থান ঘটছে উল্কাবেগে। আর পুরনোদের একাংশ মনে করছেন যে, তাঁরা এখন অপাঙ্ক্তেয়।
অনেকে অনেক ভাবে তৃণমূল নেত্রীর এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তবে মূলত যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে তা হল, পরিস্থিতির ‘গুরুত্ব’ বুঝতে পেরেই এ বার দলের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ফাঁকফোকরগুলি দ্রুত ভরাট করতে উদ্যোগী হয়েছেন মমতা স্বয়ং। এই ফাঁক অবশ্য রাতারাতি তৈরি হয়নি। হালচাল মমতার একেবারে অজানা ছিল, ধরে নিলেও হয়তো ভুল হবে। কিন্তু এখন পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোট মাথায় রেখে সমন্বয়ের কাজটি তাড়াতাড়ি সমাধা করে ফেলার প্রয়োজনীয়তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। যা দলের সামনে চ্যালেঞ্জও বটে।
বস্তুত তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এটা অনুভব করেছেন যে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে ‘পরবর্তী প্রজন্ম’-এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উল্টো দিকে তৃণমূলের কিছু অংশের মধ্যে ক্ষোভ, উৎসাহের অভাব, গুটিয়ে থাকার মানসিকতা দানা বাঁধছে। তাঁদের ওই মনোভাবের কারণগুলি ঠিক বা ভুল, উচিত বা অনুচিত, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। থাকতেই পারে। তবে সেই ভেদবিচারে না গিয়েও এ কথা বলা ভুল হবে না যে, তৃণমূলের মতো এককাট্টা ‘দিদি’র দলে এই রকম ‘ভাগাভাগি’র প্রবণতা তৈরি হওয়া প্রকৃতপক্ষে অপরিচিত রসায়ন! ফলে তার প্রতিক্রিয়াও এখন পর্যন্ত অজানা।
তার উপর একুশের বিধানসভা ভোটে বিপুল আসনে জিতে আসার পর থেকে গত দু’বছরে শাসক দলে এবং প্রশাসনে যে সব টালমাটাল ঘটনা ঘটে চলেছে, তার অভিঘাতও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এই সময় দলকে ‘বেঁধে বেঁধে’ রাখার গুরুত্ব অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং প্রশাসক হিসাবে মমতার চেয়ে ভাল আর কেউ উপলব্ধি করেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিনকয়েক আগে তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মমতার কয়েকটি বার্তা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট অর্থপূর্ণ। তাতে এক দিকে তিনি যেমন পুরনোদের ‘হুঁশিয়ার’ করেছেন, অন্য দিকে তেমনই ‘সতর্ক’ করে দিয়েছেন নতুনদের। আর বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ‘বুক টান করে’ মোকাবিলার ডাক দিয়েও দলের লোকজনদের নিশানা করে বলেছেন, “এত লোভের প্রয়োজন কী!” এ সবই তাঁর দিক থেকে ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখার সচেতন প্রয়াস।
বিভিন্ন সূত্রে ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে, তৃণমূল নেত্রী সে দিন ধমকের সুরে প্রশ্ন তোলেন, তিনি ‘না থাকলে’ দল করবেন না, এমন কথা বলে বেড়াচ্ছেন কারা? সবাই বুঝেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য তৃণমূলের ‘প্রবীণ’ বা পুরনো অংশ। তবে একই সঙ্গে নবীনদেরও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা আরও কাজ করুন, অভিজ্ঞতা বাড়ুক। ভোটে টিকিট পাওয়ার সময় আসবে তার পরে।
দলনেত্রীর এই সব কথা থেকে প্রধানত যে দু’টি ইঙ্গিত মেলে, তার একটি হল, তৃণমূলে পুরনোদের ‘মর্যাদার সঙ্কট’ রয়েছে। অন্যটি, নতুনদের ‘প্রত্যাশার পারদ’ চড়ছে। এর কোনওটিই রাজনৈতিক দলের পক্ষে স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়। অন্তত মমতার তৈরি দলে তা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। কারণ, মমতার নেতৃত্বে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এই দলে সব কিছুই আবর্তিত হয়ে এসেছে তাঁকে ঘিরে। সোজা কথায়, সবাই সেখানে ‘দিদির লোক’। তিনি ছাড়া অপর কোনও শিবির বা গোষ্ঠীর তকমা তৃণমূলে কখনও ছিল না।
এটাও সবাই জানেন, ক্ষমতায় আসার আগে মমতার আন্দোলনের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনই ঘটনাবহুল। সেই সব আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে কারও কারও দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু মমতার অতি বড় সমালোচকও এটা মানতে বাধ্য যে, তিনি ফুল বিছানো পথে হেঁটে ক্ষমতায় পৌঁছননি। ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছেন কয়েক দশক। তাঁর সেই যাত্রাপথের সঙ্গীরাও তাঁরই নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্দোলন করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। ক্ষমতায় বসার স্বপ্ন তখনও ছিল সুদূরপরাহত।
যদিও আজ ক্ষমতাসীন তৃণমূল ও তাদের সরকার বহু বিচ্যুতির শিকার। তাদের ভিতরে নানা অনৈতিকতা, অসততা, চুরি-জোচ্চুরি, ক্ষমতার দম্ভ ইত্যাদি যে ভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে, তা স্তম্ভিত করে দেয়! আন্দোলন করে উঠে আসা তৃণমূলের সঙ্গে এখনকার তৃণমূলের এটি নির্মম ফারাক।
তথাপি আন্দোলনের অতীত তো মুছে যায় না। তাই সেই আন্দোলনে মমতার পাশে থাকা ‘পুরনো’রা যদি আজ ক্রমশ নিজেদের কোণঠাসা ভাবতে শুরু করেন, দলের কাঠামোতে তার ধাক্কা লাগা খুব অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন ওঠে, তা হলেনতুন প্রজন্ম কি এগিয়ে আসবে না? এটা কি হতে পারে? অবশ্যই তা হতে পারে না। বরং কালের নিয়মেই পুরনোরা নতুনদের স্থান করে দেন।সেটাই হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অন্য যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনের কোনও তফাত চলে না। বস্তুত মমতা নিজেও সে দিন বলেছেন, “তবে আর এত কষ্ট করে দল গড়ে দিয়ে যাচ্ছি কেন!”
তা হলে আটকাচ্ছে কোথায়? মনে হয়, এই প্রশ্নটিই আজ তৃণমূলের অভ্যন্তরে অতি প্রাসঙ্গিক। কারণ, সমন্বয়ের অভাব যেখানে যা-ই থাক, তার বীজ আছে এখানেই। তবে তার ‘দায়’ কখনওই এক পক্ষের উপর বর্তায় না। বিষয়টিকে তাই দু’দিক থেকে দেখা উচিত।
এ কথা ঠিক যে, তৃণমূলের নতুন প্রজন্ম বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তাঁরা প্রায় কেউই আন্দোলন থেকে উঠে আসেননি। কারণ, মমতা যখন রাস্তায় রক্ত ঝরিয়ে আন্দোলন করেছেন, তখন এই নব্য প্রজন্মের অনেকের জন্মই হয়নি। রাজনীতিতে সাবালক হওয়া তো দূরের কথা! ফলে, সেই আন্দোলন সম্পর্কে এই প্রজন্মের উপলব্ধি পুরনোদের আবেগের থেকে আলাদা হতেই পারে। কিন্তু পরে জন্মানো তো তাঁদের অপরাধ বা অযোগ্যতা বলে গণ্য হতে পারে না! সর্বত্র এ ভাবেই নতুনরা এগিয়ে আসেন। পুরনোরা তাঁদের ‘পথ’ করে দেন, এবং নেতৃত্বের উত্থান ঘটে।
সমস্যা বাধে নতুনের স্রোতে পুরনোদের ‘বিসর্জন’-এর পরিস্থিতি হলে। নানা ভাবে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা, অবজ্ঞা করা বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হলে পুরনোদের ধারণা হতে পারে যে, তাঁরা ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে গিয়েছেন। বিশেষত কোনও রাজনৈতিক দলে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির ঝুঁকি বেশি। কারণ, সংগঠনের স্বার্থে সেখানে সংযোগের সেতুটিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
আগেই বলেছি, পঁচিশ বছর ধরে তৃণমূলের অন্যতম সম্বল ‘মমতা-আবেগ’। তাই যাঁরা তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ দিন আন্দোলন করেছেন, দলের সেই অংশের মধ্যে তার প্রকাশও যে বেশি হবে, সেটা স্বাভাবিক। ক্ষোভের উৎসও সেখানে। আর তা বোঝেন বলেই হয়তো মমতা সে দিন দলের নতুন প্রজন্মকে তৃণমূলের আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার কথা বলেছেন। কার্যক্ষেত্রে কী হবে, ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
সন্দেহ নেই, তাঁর দলে মজবুত সমন্বয় সাম্প্রতিক সময়ে মমতার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও বটে। কিন্তু দলের যখন বৃদ্ধি ঘটে, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র তখন সংখ্যায় বেড়ে যায়। অনেক কিছুই আগের মতো থাকে না। সহজটাও অনেক সময় কঠিন মনে হয়।
মমতা অবশ্য জোর দিয়ে জানিয়েছেন, সংগঠন তিনিই দেখবেন। এটা শুধু বার্তা, না কি চ্যালেঞ্জও, বলবে সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy