Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ালে রাজ্যগুলিকে এত ধার করতে হবে না
Freebies

পুনর্বণ্টনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য

সরকারি খরচের এই রকম শ্রেণিবিভাগ যে সহজ নয়, সুপ্রিম কোর্ট তা স্বীকার করছে। আমরাও সে চেষ্টা করব না। আমাদের জিজ্ঞাসা আরও মৌলিক।

কয়েকটি রাজ্যের অবস্থা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

কয়েকটি রাজ্যের অবস্থা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২২ ০৫:৩৩
Share: Save:

আজকাল খুব চলছে ‘ফ্রিবি’ কথাটা। ফ্রিবি বা খয়রাতি মানে সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা। কৃষিঋণ মকুব, নিখরচায় জল বা বিদ্যুৎ পরিষেবা, গরিবদের পেনশন, রেশনের চাল-গম, সরকারি হেঁশেল থেকে অল্প দামে বিক্রি হওয়া ভাত-ডাল-তরকারি, বিনা পয়সার সাইকেল, কন্যাশ্রী-রূপশ্রী, বিশেষ শ্রেণির নাগরিকদের হাতে সরাসরি নগদ অনুদান— সবই খয়রাতির আওতায় পড়ছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, খয়রাতি দিতে দিতে রাজ্য সরকারগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার মধ্যে কয়েকটি রাজ্যের অবস্থা রীতিমতো উদ্বেগজনক।

রাজ্যগুলির মতো কেন্দ্রও যে প্রচুর খয়রাতি করছে, এবং রাজ্যগুলির তুলনায় কেন্দ্রের রাজস্ব ঘাটতি যে আরও অনেক বেশি, তা নিয়ে অবশ্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক উচ্চবাচ্য করেনি। তা ছাড়া যে পাঁচটি রাজ্যের আর্থিক অবস্থা সবচেয়ে উদ্বেগজনক বলে মনে করছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক— বিহার, কেরল, পঞ্জাব, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গ— এই মুহূর্তে সেগুলির প্রতিটিই অ-বিজেপি শাসিত। এটা কাকতালীয়, না কি এর পিছনে অন্য কিছু আছে, সে প্রশ্নে যাব না। শুধু এইটুকু জানিয়ে রাখি যে, ২০২১-২২’এর পরিশোধিত হিসাব অনুযায়ী দেশে পাঁচটা রাজ্য ঋণ-আয়ের অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে, এবং ন’টি রাজ্যে জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি। এটা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কেরই দেওয়া তথ্য। ঋণ-আয় অনুপাত ও রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় খারাপ। সে ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশকে বাদ দিয়ে কেন পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক স্বাস্থ্যকে উদ্বেগজনক বলা হচ্ছে, তা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা হতে পারে।

আপাতত খয়রাতি প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই মুহূর্তে খয়রাতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটা জনস্বার্থ মামলা চলছে। বিজেপির প্রাক্তন মুখপাত্র অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার ডিভিশন বেঞ্চে আর্জি জানিয়েছিলেন, বিনা পয়সায় সরকারি প্রসাদ-বিতরণের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক, কারণ এগুলি সাধারণ করদাতার টাকায় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত এমন খরচ, যার কোনও দীর্ঘমেয়াদি সুফল নেই। কোন কোন সরকারি খরচকে কল্যাণমূলক বলা হবে, আর কোনগুলোকে বলা হবে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত খয়রাতি, সুপ্রিম কোর্ট তা বিবেচনা করছে।

সরকারি খরচের এই রকম শ্রেণিবিভাগ যে সহজ নয়, সুপ্রিম কোর্ট তা স্বীকার করছে। আমরাও সে চেষ্টা করব না। আমাদের জিজ্ঞাসা আরও মৌলিক। আমরা বোঝার চেষ্টা করব যে, একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় খয়রাতি— যা আসলে পুনর্বণ্টনের নামান্তর, করদাতাদের টাকায় গরিব মানুষের কাছে সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া— তার উপর আদৌ কোনও লাগাম পরানোর দরকার আছে কি না। থাকলেও, কতটা আছে?

খয়রাতির বিরুদ্ধে যুক্তিগুলো প্রথমে দেখা যাক। প্রথম যুক্তি, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের চশমা দিয়ে দেখলে উন্নয়ন খাতে সরকারের সিংহভাগ খরচ ফলাফলহীন, অপচয়। এক বার নির্বাচিত হলে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ যে-হেতু পাঁচ বছরের বেশি নয়, পরবর্তী নির্বাচন জেতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে তার মধ্যেই কিছু করে দেখাতে হয়। দীর্ঘমেয়াদি ফল নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, সে অবকাশও নেই। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তথাকথিত জনকল্যাণমূলক খরচগুলির লক্ষ্য স্বল্পমেয়াদি— দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিতে সেগুলি অপচয়। কিন্তু গরিব ভোটাররা, যাঁদের জন্য উন্নয়ন, তাঁরা কি এই অপচয়টা বুঝতে পারছেন না? দুর্ভাগ্যবশত, এটাই সত্য যে, উন্নয়নের বৃহত্তর ছবিটা সাধারণ ভোটারদের সামনে নেই। স্বল্পমেয়াদে যেটুকু সরকারি দয়া-দাক্ষিণ্য পাওয়া যায়, তাতেই তাঁরা খুশি। তাই আইন করে এই অপচয়ের উপরে লাগাম পরানো দরকার।

দ্বিতীয় যুক্তি, খয়রাতির খরচ মেটাতে সরকারগুলিকে ধার করতে হচ্ছে। কিন্তু খয়রাতির বেশির ভাগটাই যে-হেতু তাৎক্ষণিক ভোগ, ফলে এখানে কোনও বিনিয়োগ হচ্ছে না, যার থেকে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের আয়বৃদ্ধি হতে পারে এবং সেই আয়বৃদ্ধির একটা অংশ বর্ধিত রাজস্ব হিসাবে সরকারের ঘরে জমা পড়তে পারে। তাই প্রশ্ন উঠছে যে, এই ঋণ শোধ হবে কী করে? আশঙ্কা, ঋণ করে খয়রাতি করতে গিয়ে সরকারগুলি আরও ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, এবং ক্রমশ তাদের ঋণগুলি অপরিশোধ্য হয়ে উঠছে। এই প্রসঙ্গে শ্রীলঙ্কার দৃষ্টান্ত দেওয়া হচ্ছে, ভেনেজ়ুয়েলা বা আর্জেন্টিনারও।

যুক্তিগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবু ভাল করে ভেবে দেখলে মন খুঁতখুঁত করে। আশির দশক থেকে আমাদের দেশে আয়বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। সমাজের উপরতলার মানুষদের অবিশ্বাস্য শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, তুলনায় নীচের তলার মানুষদের ততটা উন্নতি হয়নি। সন্দেহ নেই যে, এটা বিশ্বায়নের ফল। যাঁদের অর্থ-শিক্ষা-প্রশিক্ষণের জোর ছিল, তাঁরা মুক্ত বাজারের সুযোগ-সুবিধাগুলো নিতে পেরেছেন, পিছিয়ে-পড়ারা পারেননি। ফলে গড় আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল হারে অসাম্য-বৃদ্ধিও ঘটেছে। নৈতিক প্রশ্নটা হল, সমাজের কি দায়িত্ব নয় উপরতলার সমৃদ্ধির কিছুটা নীচের তলাতেও পৌঁছে দেওয়া? দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন যে দরকার, তা নিয়ে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু উন্নতির জন্য যদি একটা বা দুটো প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হয়, তা হলে যে গরিব মানুষরা এখন বেঁচে আছেন, তাঁদের কী হবে? তাঁরা কি সারা জীবন অন্ধকারেই কাটিয়ে দেবেন?

যে কোনও সংবেদনশীল মানুষ স্বীকার করবেন যে, পুনর্বণ্টন কিছুটা হওয়া দরকার এবং সেটা শুধু ভবিষ্যতের কথা ভেবে নয়, বর্তমান ভোগের জন্যও বটে। না হলে, একটা পুরো প্রজন্মকে চরম অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তা ছাড়া, অসাম্য বাড়তে থাকলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে, অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখাটাই দুরূহ হয়ে ওঠে। সে দিক থেকে দেখলেও সরাসরি ভোগের জন্যে পুনর্বণ্টনের প্রয়োজন আছে। আমরা শুধু শ্রীলঙ্কা-ভেনেজ়ুয়েলা-আর্জেন্টিনার উদাহরণ দেব কেন? কেন ইউরোপ-আমেরিকার কথা ভাবব না, যেখানে সরকারি উদ্যোগে নাগরিকদের জন্য ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে?

সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলোর খরচ মেটানোর প্রশ্নটা অবশ্য থেকেই যাচ্ছে। যদি খরচ মেটাতে গিয়ে সরকারগুলিকে ধার করতে হয়, তা হলে ভবিষ্যতে সেই ধার শোধ করতে গিয়ে উন্নয়নমূলক মূলধনি ব্যয় কমে যাওয়ার, এবং উন্নয়নের ধারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু ধার করে গরিবদের জন্য খরচ করাটা তো পুনর্বণ্টন হল না। পুনর্বণ্টনের প্রকৃত অর্থ হল, ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে গরিবদের জন্য খরচ করা। ভারতে প্রত্যক্ষ করের আওতায় এখনও খুব বেশি মানুষকে আনা হয়নি— এখানে অন্যান্য দেশের তুলনায় অবস্থাপন্নদের, বিশেষ করে অতি অবস্থাপন্নদের খুব বেশি কর দিতে হয় না; এখানে কর্পোরেট কর বাড়ার বদলে কমে যায়; এখানে ধনী কৃষকরা সম্পূর্ণ করমুক্ত। ধনীদের প্রতি একটু কম সহানুভূতিশীল হলে প্রত্যক্ষ কর থেকেই আরও অনেক রাজস্ব কেন্দ্রীয় তহবিলে আসতে পারত, যার ভাগ রাজ্যগুলোও পেত। সেটা হলে প্রকৃত পুনর্বণ্টন ঘটত এবং সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে ধার করতে হত না— বর্ধিত রাজস্ব থেকেই সে কাজ হত।

কেন্দ্র এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অবশ্য রাজ্যগুলিকে নিজস্ব আয় বাড়াতে বলছে। আমাদের দেশে যে-হেতু রাজ্যগুলি প্রত্যক্ষ কর আদায় করতে পারে না, তাদের আয় বাড়ানো মানে পরোক্ষ কর বাড়ানো। কিন্তু পরোক্ষ কর তো প্রত্যক্ষ করের মতো ধনী-দরিদ্র বিচার করে না— সকলের উপর সমান ভাবে চেপে বসে। তাই পরোক্ষ কর বাড়লে অসাম্য আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তা ছাড়া পরোক্ষ কর মূলত বিক্রয়ের উপরে কর। যে রাজ্য অপেক্ষাকৃত গরিব, সেখানে বিক্রিবাটা কম, বিক্রয় করের আদায়ও কম। অথচ, সেই গরিব রাজ্যটিতেই পুনর্বণ্টন বেশি দরকার। মোটের উপর বলা যায় যে, পরোক্ষ কর দিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের খরচ চালানোর সীমাবদ্ধতা আছে— প্রত্যক্ষ করের আদায় বাড়িয়েই কাজটা করা বাঞ্ছনীয়। দায়িত্বটা, বলা বাহুল্য, কেন্দ্রের।

পরিশেষে দু’টি কথা। এক, সব সুযোগ-সুবিধা সমান ভাবে মানুষের কাজে লাগে না। কিন্তু কোনটা লাগছে, আর কোনটা নয়, তার তাৎক্ষণিক বিচারের বদলে গণপরিসরে তর্ক হোক। দুই, কেন্দ্র যদি প্রত্যক্ষ করের আদায় বাড়ানোর দায়িত্ব পালন করতে রাজি না হয়, তবে রাজ্যগুলির কী কর্তব্য? বর্তমান প্রতিবেদকের মতে, সে ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে গণবণ্টনের খরচ কমাতেই হবে। অর্থনীতির পরিভাষায় এটাকে বলে সেকেন্ড বেস্ট বা মন্দের ভাল। ঋণ করে খয়রাতি কোনও কাজের কথা নয়— রাজ্য এবং কেন্দ্র, উভয়ের ক্ষেত্রেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Freebies Supreme Court India Reserve bank of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy