বাইসাইকেল।
এই সময়ে থানাগড়ের বাবুদের এক ছেলে এক বাইসিকল কিনিয়া আনিয়া চড়া অভ্যাস করিতেছিল। রসিক সেটাকে লইয়া অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এমন আয়ত্ত করিয়া লইল যেন সে তাহার নিজেরি পায়ের তলাকার একটা ডানা। কিন্তু কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ণ সুদর্শন চক্রের মত অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়। ঝড়ের বাতাস যেন চাকার আকার ধারণ করিয়া উন্মত্তের মত মানুষকে পিঠে করিয়া লইয়া ছোটে...রসিকের মনে হইল এই বাইসিকল নহিলে তাহার জীবন বৃথা।”— (‘পণরক্ষা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
দাদা বংশীর কাছে এই সাইকেল না পেয়ে সে চলে গেল শহরে। সেখানে বিয়ের পণ হিসেবে পেল বাইসাইকেল। সেটা চেপে গ্রামে এসে দেখল দাদা আর বেঁচে নেই, তাঁতে নিজের জীবনটি বুনে ভাইকে দান করে গেছে নিজের রক্তজল করা টাকায় কেনা একটি বাইসাইকেল।
রসিকের মতো এক সময় অনেক তরুণের স্বপ্নের ধন ছিল এই সর্বত্রগামী, দূষণহীন যানটি। মনে আছে, আমাদের মফস্সলের একটি বাস স্টপের নাম অ্যাটলাসের মোড়, বিখ্যাত সাইকেল কোম্পানির নামে। একটা সময় ছিল, যখন টানা তিন থেকে সাত দিন এক নাগাড়ে মাঠে গোল হয়ে সাইকেল চালাত কোনও তরুণ সাইকেল আরোহী। অচিরেই সে হয়ে উঠত মেয়েদের হৃৎস্পন্দন। শীতের সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সাইকেলের খেলা। প্রতি বছর সার্কাসের স্টার প্লেয়াররা আমাদের বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতে আসত, এক বার এসেছিল চার মালয়ালি বোন। পরীর মতো সুন্দরী চার জন যখন ঝলমলে খাটো পোশাক পরে সাইকেলের খেলা দেখাত, তা প্রকৃতই হয়ে উঠত স্বপ্নের উড়ান।
শুধু জীবনের নয়, সাইকেলের নিত্য যাতায়াত বাংলা সাহিত্যের অলি গলিতে।
সাইকেল নিয়ে কত কী করা যায় তা লিখেছেন শীর্ষেন্দু। “বউ দিয়ে সে কী করবে? তার দরকার একখানা সাইকেল। সাইকেলের মতো জিনিস হয় না। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো করে উঠে পড়লেই হল। তারপর দু-খানা সরু চাকার খেল। এই খেলটাও বড়ই আশ্চর্যের। পড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু পড়ে না। ঘটুর দুনিয়াখানা এখন এসে জড়ো হয়েছে সাইকেলে। আর সাইকেলের রকমারি কম নয়। মদনবাবুর ছেলে কুঁড়োরাম কী জিনিসটাই কিনেছে। সবুজ রং নীচু হ্যান্ডেল যায় যেন পক্ষীরাজ। হরিপদর সাইকেলে একখানা বাহারি বাতি আছে, পিছনের চাকায় তার কল। কলখানা চাকার গায়ে ঠেসে দিলেই হল, সাইকেল চালালেই টর্চবাতির মতো আলো। অত বাহারের অবশ্য দরকার নেই ঘটুর। নন্তের মতো পিছনের চাকায় একখানা পিচবোর্ডের টুকরো বেঁধে নেবে। চালালে চাকার স্পোকে লেগে শব্দ হবে ফটফট-ফটফট, ঠিক যেন মোটর সাইকেল যাচ্ছে।”
এই ঘটুই উত্তেজিত হয়ে ওঠে যখন শোনে বিয়ের বৌকে সাইকেলে নিয়ে ভেগেছে তার প্রেমিক। সে বিড়বিড় করে বলে “একটা সাইকেলে কত কী করা যায়!” (‘সাইকেল’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়)
সাইকেলে চাপিয়ে বিয়ের পিঁড়ি থেকে বৌ তুলে আনা যায়, তেমনই বিপ্লবের হাতচিঠি চালাচালি করা যায়, আবার মৃত্যুবাণও বয়ে আনে এই সাইকেল। শরদিন্দু ‘পথের কাঁটা’য় লিখেছেন এমন এক মারাত্মক অপরাধী প্রফুল্ল রায়ের কথা। বাইসাইকেল আরোহীকে কেউ সন্দেহ করবে না, এই নিশ্চয়তার আড়ালে সে একের পর এক পথের কাঁটাকে সরিয়ে গেছে স্রেফ সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে।
অথচ এই টিং টিং শব্দের জাদুতে আমাদের শৈশবকে মোহিত করে রেখেছিলেন অধুনা বিস্মৃত ছড়াকার মোহিত ঘোষ—
‘টিং টিং বাজে বেল
ওই চলে সাইকেল
চাকা দুটো ঘুর ঘুর
নিয়ে যায় বহু দূর
...
আগুন কয়লা নাই
একটুও নাই তেল’
এই যে আগুন, কয়লা, তেল লাগে না, এখানেই তো সাইকেলের জিত। আর এই দু’চাকার যে অপার রহস্য, তাতে মজেছেন লোকগায়করাও—
“সাইকেলের দুই দিক চাকা, মধ্যে ফাঁকা
ভাইরে ভাই, চাপতে হবে ঠ্যাং তুলে,
আয় আয় আয়, চড়বি কে ভাই কলির সাইকেলে।
সাইকেল ডবল বেলওয়ালা,
বুড়ো ছোকরা দেখলে পরে মন হয় উতলা
আমার মন হয় উতলা রে,
তুমি আস্তে-আস্তে প্যাডেল করো
হাত রেখে দুই হ্যান্ডেলে।
ও ভেবে ক্ষ্যাপা বাউল কয়
এই সাইকেল মানবদেহ হয়,
আরে, লিক করে পাম্প বেরিয়ে যাবে
কখন কোন সময়,
ভোলা মন, মন রে আমার—
ওই তোর সাধের গাড়ি পড়েই রবে
টানবে কুকুর-শেয়ালে।”
চেনওলা সাইকেলের জনক যিনি, সেই স্কটিশ কারপ্যাট্রিক ম্যাকমিলান, তিনি নাকি একটা বাচ্চা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে পাঁচ শিলিং জরিমানা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই কি সুনির্মল বসু সতর্ক করে দিয়েছেন ‘সাইকেলের বিপদ’ ছড়ায়?
“ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং! সবে স’রে যাও-না,
চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না?
ঘাড়ে যদি পড়ি বাপু, প্রাণ হবে অন্ত;
পথ-মাঝে র’বে পড়ে ছিরকুটে দন্ত।
বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল—
‘যেয়ো না যেয়ো না সেথা, যেথা চলে সাইকেল।”
বাইসাইকেল থিভস এই ইটালীয় সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। যাঁর উপরে এই সিনেমার প্রভাব অপরিসীম, সেই সত্যজিৎ রায়ের নায়ক সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে অরিন্দম (তখনও সে বিখ্যাত হয়নি) তার রাজনীতি করা বন্ধু বীরেশের সঙ্গে পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। এই উত্তমকুমারই বিচারক সিনেমায় সাইকেল থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছেন অরুন্ধতী দেবীর মুখে ‘আমার মল্লিকা বনে’ গান শুনে! কী আর করা, প্রেমে পড়লে মানুষ ক্যাবলা হয়ে যায় কিনা!
হিন্দি সিনেমাও কম যায় না। মনে আছে ১৯৮০ সালের সুপারহিট হিন্দি সিনেমা শান? অমিতাভ বচ্চন ও শশী কপূর সাইকেল চালাতে চালাতে গান গাইছেন, “জানু মেরি জান/ ম্যায় তুঝপে কুরবান…”
কিংবা নব্বই দশকের গোড়াতেই (১৯৯২)আমির খান অভিনীত ছবি যো জিতা ওহী সিকান্দার। যার বিষয়ই ছিল সাইকেল রেস, সাইকেল এখানে হয়ে ওঠে প্রোলেতারিয়েতের উত্থানের প্রতীক। আর পিকু-তে অমিতাভ বচ্চন হইচই ফেলে দিয়েছেন কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে সাইকেল চালিয়ে। দিল্লিপ্রবাসী চরিত্রটির কাছে সাইকেল মানে নস্ট্যালজিয়া।
১৮৮৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। কলকাতায় এসে পৌঁছলেন টমাস স্টিভেন্স। বাইসাইকেলে চড়ে প্রথম বিশ্বভ্রমণ করছেন যিনি। বিশ্বভ্রমণ না করলেও সাইকেলে চেপে কলকাতা ভ্রমণ করেছেন অনেক বিখ্যাত মানুষ। এই সময়ে অমর্ত্য সেন থেকে রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ অবধি, যিনি সাইকেল চেপে হাওয়া খেতে যেতেন চৌরঙ্গি অঞ্চলে। জগদীশচন্দ্র বসু, তাঁর স্ত্রী অবলা বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার ও পত্নী নির্মলা দেবী এক সঙ্গে নাকি ভোরবেলায় মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে সাইকেল চালাতেন। জগদীশচন্দ্রের কথায় “...আজকাল বাইসিকেল আমাদের পুষ্পক রথ।” বিখ্যাত থেকে অখ্যাত— ছাত্রছাত্রী, মাস্টার, কাগজের হকার, গয়লা, সবার বাহন এই সাইকেল।
উনিশ শতকের শেষের দিকে, বাইসাইকেলকে বিবেচনা করা হত নারী-স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। সাইকেলকে তখনকার আধুনিক নারীরা দেখতেন ‘ফ্রিডম মেশিন’ হিসেবে!
ভাবতে ভাল লাগে যে, এই সময়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়ের কাছেই সাইকেল সত্যি স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। এখন অনেক গৃহপরিচারিকাই আসেন সাইকেলে চড়ে। এক মহিলা তবলচি বাড়ি বাড়ি টিউশনি করেন সাইকেল বাহনা হয়ে।
তবে সাইকেলের সব থেকে চিত্তাকর্ষক জিনিসটি হল বাড়তি একটা ছোট্ট সিট, যেটা সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয় বাবা বা মা’র সাইকেলে চড়ার জন্য বাড়িতে এক খুদে সদস্যের আবির্ভাব ঘটেছে। আসলের চেয়ে সুদের মতোই সেই ছোট্ট আসনটি ভারী মিষ্টি— তাতে সন্দেহ কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy