১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতে প্রায় সাড়ে বাইশ কোটি রোজগেরে মেয়ে ছিল। ফাইল চিত্র।
বিপর্যয় দু’রকমের হয়। এক রকম, যখন সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর ঘর ছাপিয়ে, পাড়া ডিঙিয়ে ক্ষোভ নেমে আসে রাজপথে। লাগাম-লাগানো জনজীবন ঘাড় বাঁকিয়ে, হ্রেষাধ্বনি করে, কেশর ফুলিয়ে দাঁড়ায়। তখন তাকে বশ মানিয়ে পথে ফিরিয়ে আনতে ছুটোছুটি পড়ে যায়। আর এক রকম, যখন ভয়ানক বিপর্যয় দেখেও কেউ দেখে না, পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পঞ্জাবের কবি পাশ (অবতার সিংহ সাঁধু) লিখেছেন, ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সেই চোখ/ যা সব কিছু দেখেও ঠান্ডায় বরফ।’ এ ভাবেই ইহুদিরা চালান হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, দীর্ঘ অনাহারে লোকে মরেছে ইউক্রেন, চিন, বাংলার দুর্ভিক্ষে। হত্যার হার যখনই লক্ষ-কোটি ছাড়িয়েছে, তখনই চার পাশে ছিল অগণিত বরফ-ঠান্ডা চোখ।
জীবন হরণের সেই পালার অন্য পিঠ, জীবিকা হরণ। কাজ মানুষকে কেবল খাওয়া-পরা দেয় না, সম্মানও দেয়। কাজ দিয়ে মানুষ নিজের পরিচয় তৈরি করে। সেই কাজের জগৎ থেকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। ১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতে প্রায় সাড়ে বাইশ কোটি রোজগেরে মেয়ে ছিল। তার পর দেশে এসেছে সর্বশিক্ষা মিশন, শিক্ষার অধিকার আইন, জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কত না প্রকল্প। তা সত্ত্বেও ২০১৯-২০২০ সালে রোজগেরে মেয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে পনেরো কোটিতে। যদি কুড়ি বছরের আগের হার বজায় থাকত— মোট কর্মক্ষম মেয়ের ৩৪ শতাংশ যদি যোগ দিত শ্রমের বাজারে— তা হলে আজ আরও সাড়ে সাত কোটি মেয়ে শ্রমবাহিনীতে থাকত। গোটা তামিলনাড়ুর জনসংখ্যা সাত কোটিও নয়। তার চাইতেও বেশি মেয়ে কাজের বাজার থেকে ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে। একটি অসরকারি সংস্থার হিসাব, কেবল ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে অন্তত দু’কোটি মেয়ে সরে গিয়েছে কাজ থেকে। তবু চারিদিকে শীতল চাহনি।
আজ ভারতে পাঁচ জন মেয়ের বড়জোর এক জন, মানে ২০ শতাংশ, রোজগেরে গিন্নি। যেখানে চিনে রোজগার করে মেয়েদের ৬২ শতাংশ, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কাতেও ৩০ শতাংশের বেশি। ফারাক বাড়ছে বাড়ির মধ্যেও। ভারতে পুরুষদের অন্তত ৬৬ শতাংশ কাজ করে। অথচ, শহুরে, শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যেও কাজের হার কমছে।
তার একটা কারণ সংসারের কাজের বোঝা। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে মেয়েরা দিনে ২৩৫ মিনিট ঘরের কাজ করে, পুরুষরা করে ২৫ মিনিট। মেয়েদের মজুরিহীন কাজের আর্থিক মূল্য ভারতের জিডিপি-র চল্লিশ শতাংশ, যেখানে বিশ্বে গড় ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ, অন্য দেশে যে সব প্রয়োজন মেটায় বাজার, ভারতে সে সব চাপানো হয় মেয়ে-বৌদের উপর। সে মেয়ে হতে পারে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা আশাকর্মী, কী আসে যায়? মায়ের হাতের রান্না নইলে কি হয়? না কি, মা নিজে না পড়ালে লেখাপড়া হয় ছেলেমেয়ের? সংসার-সমাজের প্রত্যাশার চাপে মেয়েরা হয় ঘরে বসে কাজ করে, নইলে ঘরের কাছাকাছি। ফলে যে কাজ দেয়, তার কাছেই বাঁধা পড়ে যায়। পাইকার, মহাজনেরা তার সম্পূর্ণ সুযোগ নেয়।
এ সব কথা তুললেই কিছু বাঁধা উত্তর মেলে। যেমন, ভারতে ‘জবলেস গ্রোথ’ চলছে— ছেলেরাই কাজ পাচ্ছে না, মেয়েরা পাবে কোত্থেকে? আসলে আরও শিল্প চাই, আরও মুক্ত বাজার (অথবা আরও বেশি স্বদেশি উৎপাদন) চাই। আসলে মেয়েদের আরও প্রশিক্ষণ চাই, নিজ-উদ্যোগ চাই। এমন হাজার ‘আসল’ কথা দিয়ে চাপা দেওয়া হয় সব চাইতে বড় ‘আসল’ কথাটা— মেয়েদের কম টাকা দেওয়া হয়, কাজ ছেড়ে দিতে বলা হয় তারা মেয়ে বলেই। তা স্পষ্ট করল অসরকারি সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’-এর সমীক্ষা, ‘দ্য ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট, ২০২২’। গবেষকরা দেখছেন, যখন শিক্ষা-দক্ষতায় একই জায়গা থেকে পুরুষ ও মেয়েরা শুরু করছে, তখনও রোজগারে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে, তা সে বাঁধা-মাইনের চাকরিই হোক আর ‘ক্যাজুয়াল’ বা ঠিকা কাজ হোক। এমনকি স্বনিযুক্তদের ক্ষেত্রেও ফারাক অনেকটা। শহরাঞ্চলে স্বনিযুক্ত পুরুষদের গড় রোজগার (১৫,৯৯৬ টাকা) মেয়েদের তুলনায় (৬৬২৬ টাকা) প্রায় আড়াইগুণ বেশি। অতিমারির পরে মেয়েদের মজুরি আরও কমেছে। যে শাড়ি বুনে আগে পাঁচশো টাকা পেতেন, এখন তার জন্য পাচ্ছেন সাড়ে তিনশো টাকা, সম্প্রতি কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে বললেন ফুলিয়ার তাঁতি মেয়েরা।
মেয়েদের প্রতি এই চরম অন্যায় কেন উত্তপ্ত করছে না কাউকে? নারী সংগঠনগুলি এক-একটা ধর্ষণ নিয়ে কত শোরগোল তোলে, অথচ কোটি কোটি মেয়ের জীবিকাহরণ, মজুরিহরণ নিয়ে মিছিল যেন চোখেই পড়ে না। আর এখানেই বেজে ওঠে ইতিহাসের বিপদঘণ্টি।
মেয়ে বলেই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র থেকে বিপুল সংখ্যায় অতি দ্রুত অপসারণ এর আগেও ঘটেছে। মুসোলিনির ইটালি আর নাৎসি জার্মানি, এই দুটো দেশেই সরকার ঘোষণা করেছিল, দেশকে উপযুক্ত সন্তান উপহার দেওয়া, পুরুষের জন্য সুখী গৃহকোণ সাজিয়ে রাখাই মেয়েদের প্রকৃতি-নির্দিষ্ট কাজ। চাকরি করতে বেরোয় স্বার্থপর মেয়েরা। মুসোলিনি বেকারত্বের সমস্যার জন্য কর্মরত মেয়েদের সরাসরি দায়ী করেছিলেন। হিটলার বলেছিলেন, চার্চ, শিশু আর রান্নাঘর, এই হল মেয়েদের পরিধি।
অথচ, তখন ইউরোপে ব্রিটেনের পর জার্মানিতেই সব চাইতে ‘আধুনিকা’ ছিল মেয়েরা— সাজপোশাকে, অফিসে-কলেজে, শিল্পে-মঞ্চে। কেন সেই শিক্ষিত মেয়েরা রুখে দাঁড়ায়নি? তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অতি পরিচিত এক বিরোধে— কাজের মাসি-বাড়ির গিন্নির খটাখটি। রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটে গিয়েছে ১৯১৯ সালে, ইউরোপের নানা দেশে তখন শ্রমজীবী আন্দোলন জোরদার হয়েছে, তাতে যোগ দিচ্ছে মেয়েরাও। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করছে মেয়ে-মজুররা। সেটা মোটেই ভাল চোখে দেখেনি মধ্যবিত্ত গিন্নিরা। জার্মান গৃহবধূদের সংগঠনের কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছিল গৃহ পরিচারিকাদের ইউনিয়নের বিরোধিতা করা। ফ্যাসিবাদের কাছে মেয়েদের নতিস্বীকারের অন্যতম কারণ এটাও, বলছেন ইতিহাসবিদরা।
আজ ভারতে দেখছি, আশাকর্মী, মিড-ডে মিল কর্মী, শ্রমজীবী মেয়েদের কোনও আন্দোলনই মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত মেয়ের সমর্থন পাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত আয়া বা রাঁধুনির মাইনে নিজের ইচ্ছাধীন রাখতে চায়, তাই গরিব মেয়ের ন্যায্য মজুরির জন্য চাপ দিতে চায় না সরকারকে। বরং সুলভে শ্রম পাওয়ার লক্ষ্যে গরিব মেয়ের বাঁধা রোজগার, বেশি রোজগারের বিরোধিতাই করে, কখনও নীরব অসমর্থন জানিয়ে, কখনও শ্রমজীবী মেয়েদের ফাঁকিবাজি, অপরিচ্ছন্নতা, অসততা নিয়ে নালিশ তুলে। অথচ, তারা একই নৌকায়— কাজের মেয়েটি আর গৃহবধূর কলেজছাত্রী কন্যা, দু’জনকেই সুপুরির ডোঙায় ভেসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ময়ূরপঙ্খির সঙ্গে। সে বোধটা মধ্যবিত্তের মধ্যে জন্মাতে পারে, সেই রাজনীতি কোথায়?
আশি-নব্বইয়ের দশকে নারী আন্দোলন লড়েছিল নারী-হিংসার বিরুদ্ধে। তা যথার্থ রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে উঠেছিল বলেই আজ দরিদ্র মেয়ের ধর্ষণের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনের গদি টলে যায়, থানার ওসিকে সাসপেন্ড করেও জনরোষ সামলানো কঠিন হয়। এখন চাই এমন রাজনীতি, যাতে পুরুষের সঙ্গে একই কাজ করে মেয়েরা কম মজুরি পেলে শ্রম আধিকারিক সাসপেন্ড হন। মেয়েদের কাজ চুরি, মজুরি চুরিকে মেয়েদের সম্মানহানির সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কে চায় এমন জীবন, যেখানে মেয়ের সেরা নম্বর, অসামান্য প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রমক্ষমতা কেবল ঘর-সাজানোর কাপ-মেডেল হয়ে থাকবে? “সব থেকে ভয়ঙ্কর/ আমাদের স্বপ্ন মরে যাওয়া,” লিখেছিলেন পাশ, সন্ত্রাসবাদীর গুলিতে মৃত্যুর আগে, তাঁর শেষ কবিতায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy