—প্রতীকী ছবি।
জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ভারতে তিনটি নতুন ফৌজদারি আইন কার্যকর হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এই তিনটি আইন ভারতকে ঔপনিবেশিক
শাসনের ঘোর অন্ধকারপূর্ণ অতীত থেকে নিয়ে আসবে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর যুগের জাজ্বল্যমান ভবিষ্যতে। সত্যিই কি তাই? না কি, এই আইন তিনটি দেশের মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত না করে তাদের উপর নতুন করে এক ঔপনিবেশিক শাসন চাপাচ্ছে?
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নতুন আইনগুলিতে কয়েকটি ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, তদন্তে অডিয়ো/ভিডিয়ো যন্ত্রের প্রয়োগ, কারাবাসের পরিবর্তে কমিউনিটি সার্ভিস ইত্যাদি। সে পরিবর্তন স্বাগত। কিন্তু, মূল সমস্যা হল, সরকার যদিও বিশ্বাস করাতে চায় যে, এগুলি অমৃতকালের অমৃত আইন, আসলে এ সেই পুরনো ঔপনিবেশিক বিষ, নতুন দেশি বোতলে ভরা হয়েছে মাত্র।
সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশের যে মূল ভিত্তি পুরনো ফৌজদারি আইনে প্রতীকায়িত, তা এই রকম: ‘নেটিভ’রা সততই মিথ্যাবাদী, এবং সেই কারণেই ভারতীয়দের প্রয়োজন শাসন। জটিল নিয়মকানুন ও কঠোর শাস্তির দ্বারা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই মূল ভিত্তি কোনও অংশেই বদলায়নি নতুন তিনটি আইনে। বরং, আইনগুলো বানানোর সময় যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, তা আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রথা-বিরোধী। আইনগুলির ভাষা লর্ড মেকলের ভাষার মারপ্যাঁচের স্মৃতিবাহী।
পূর্ববর্তী ফৌজদারি আইনগুলি পরাধীন ভারতের সামাজিক চুক্তির উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। এ বারের প্রত্যাহার এবং পুনঃপ্রণয়ন অনুশীলনের ঘোষিত ভিত্তি হল ফৌজদারি আইনের মধ্যে নতুন ভারতীয় সামাজিক চুক্তির স্বীকৃতি— একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র এবং মৌলিক অধিকারবাহক নাগরিকের মধ্যে চুক্তি। কিন্তু নতুন আইনগুলির নকশা সেই পুরনো ধাঁচের— নাগরিক এবং প্রশাসনের মধ্যে অবিশ্বাস; শাসক এবং শাসিতদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা; এবং নাগরিককে সন্দেহের চোখে দেখা। এর ফলে পুলিশকে বিস্তৃত, বিপুল ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আধুনিক প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ। ফৌজদারি আইন হওয়া উচিত ন্যায্যতার উপর ভিত্তি করে। জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু নতুন বিধিগুলি ঔপনিবেশিক বিচারধারার— ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’— প্রতিফলন।
রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ তার একটি মোক্ষম উদাহরণ। পুরনো এবং নতুন আইনে এই ‘অপরাধ’ সম্বন্ধে অবস্থানে পার্থক্য নেই বললেই চলে। উচ্চতম ন্যায়ালয় দ্বারা আইনব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক মানসিকতার বাইরে নিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে যেন সচেতন ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। ২০২২-এ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের উপর স্থগিতাদেশ ঘোষণা করা সত্ত্বেও, নতুন আইনে এই অপরাধটি আবার ফিরে এসেছে। যদিও অপরাধ এখন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে— কিন্তু তা এতই সূক্ষ্ম পার্থক্য যে, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তথ্য ও প্রমাণ পেশ করার সময়ে তা নির্ঘাত হারিয়ে যাবে।
নতুন আইনগুলি প্রায় গোপনে একটি ছোট কমিটির দ্বারা বানানো হয়। জনসাধারণের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামত অবশ্য চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু যে মতামতগুলি পাওয়া গিয়েছিল, তার কোনও প্রভাব রচিত আইনগুলিতে পড়েছে কি না, তা জানার কোনও উপায় নেই। এর ফলে দু’টি সমস্যা হয়েছে— প্রথমত, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বাস্তবতার সঙ্গে এই নতুন আইনগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; দ্বিতীয়ত, এই অনুশীলনের নীতি ও ভিত্তির কোনও রেকর্ড নেই। কমিটির গবেষণা বা সমর্থনকারী নথি, যদি কোনওটি আদৌ থেকে থাকে, তা প্রকাশ করা হয়নি। ঊনবিংশ শতকে টমাস মেকলে (যিনি ভারতীয় দণ্ডবিধি তৈরি করেছিলেন) এবং জেমস ফিটজেমস স্টিফেন (যিনি ভারতীয় সাক্ষ্য আইন তৈরি করেছিলেন) দু’জনেই তাঁদের কাজের প্রথা নিয়ে ডায়েরি রেখে গেছেন। মেকলে ১৮৩৪-৩৬ সালে কোডের প্রথম খসড়া তৈরির সময় সঙ্কলিত মিনিটস্গুলির রেকর্ড রেখেছিলেন। ১৮৩৭ সালে ভারতীয় আইন কমিশন কর্তৃক বিস্তারিত নোট-সহ এগুলি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী দুই দশকে ভারতীয় আইন কমিশন কোডের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে। এর জন্য বম্বে, মাদ্রাজ, কলকাতার প্রাদেশিক প্রশাসন-সহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয়, কারণ শেষ পর্যন্ত কোডগুলি কার্যকর করার দায়িত্ব তাঁদেরই। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং অন্য বিচারকদের কাছ থেকেও মতামত চাওয়া হয়েছিল, যাঁরা এই বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের প্রথম যোগসূত্র হবেন। খসড়াটি তার পর পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে, যেখানে বিভিন্ন আইনজীবী, সাংসদ এবং বিচারকদের দ্বারা এটি যাচাই-বাছাই করা হয়। একাধিক পঠনপাঠনের পর, খসড়াটি একটি সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়, যা এর সংশোধন করে। এমন কোনও প্রক্রিয়া এ বারে অনুসৃত হয়নি।
নতুন কোডগুলির অধিকাংশ বিধান পুরনো আইন থেকে অনুলিপি করা হয়েছে, ‘কেস ল’ উপেক্ষা করে। যেমন, ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়মের ধারা ৭৯, যা আদালতের সামনে পক্ষ বা সাক্ষীদের দ্বারা উত্থাপিত নথির সত্যতা সম্পর্কে অনুমানের কাজ করে, কোনও পরিবর্তন ছাড়াই ভারতীয় সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ধারা ৮০-র একটি সরাসরি অনুলিপি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, কিন্তু এমনই জটিল তার ভাষা যে, আইনজীবীদের পক্ষেও তার অর্থ সম্পূর্ণ রূপে উপলব্ধি করা কঠিন।
এই নতুন আইনগুলি তার ঘোষিত উদ্দেশ্য পূরণে যথেষ্ট কার্যকর না-ও হতে পারে। তার দু’টি কারণ— এক, এত দিন যে আইনগুলি বহাল ছিল, তার থেকে নতুন বিধিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি; এবং দুই, যেখানে পরিবর্তন হয়েছে, সেখানে আইনব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে অপ্রস্তুত।
নতুন আইনে কেন কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই? এই মাত্রার ফৌজদারি আইন সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল বিশেষ ফৌজদারি আইনের বিশাল আয়তনের সঙ্গে সাধারণ ফৌজদারি আইনের সমন্বয় করা— যেমন, প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট (পকসো), প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ), আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট (ইউএপিএ)। এটি হতে পারত সাধারণ আইনের আওতা থেকে বিশেষ আইনে অন্তর্ভুক্ত সমস্ত অপরাধ বাদ দিয়ে, বা বিশেষ আইন বাতিল করে এবং অপরাধগুলিকে সাধারণ আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। এই কাজ করা হয়নি। পরিবর্তে, সন্ত্রাসবাদ এবং সংগঠিত অপরাধের মতো অপরাধগুলিকে সাধারণ আইনেও জুড়ে দিয়ে, এখন সাধারণ এবং বিশেষ আইনের মধ্যে প্রবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হল।
দ্বিতীয়ত, একটি ফৌজদারি আইনের কঠোরতার প্রতীক হল মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ১২ রকম অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা সম্ভব ছিল, যেমন হত্যা, হত্যা-সহ ডাকাতি, বিদ্রোহ ইত্যাদি। নতুন ফৌজদারি আইনে ১৫ রকম অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড সম্ভব। এই বিভাগে, নতুন অপরাধ হল গণপ্রহার, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নাগরিক ও শাসকের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার মূল ভিত্তি শাসকের প্রতি তুমুল ভীতি ও শাসকের দৃষ্টিতে নাগরিকের প্রতি ক্রূরতা।
তৃতীয়ত, একটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে— বিভিন্ন অপরাধের ধারা পাল্টে গিয়েছে। যেমন, আগে যা ছিল ৪২০ ধারার মামলা, তা এখন ৩১৬ নম্বর ধারা। আবার, কাউকে হত্যা করার শাস্তি এখন ধারা ৩০২ নয়, ১০১। এ পরিবর্তনের মাপ অকল্পনীয়। দেশের প্রত্যেক পুলিশ অফিসারকে ট্রেনিং দিতে হবে, যাতে তাঁরা আদালতে ভুল ধারা না লেখেন, তাতে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডস-এ অপরাধী রেহাই পেয়ে যাবে। এই ট্রেনিং করার জন্য লাগবে লোকবল এবং আর্থিক সম্বল। এই বিষয়ের উপর কোনও আলোচনা হয়নি সংসদে। ডুবতে ডুবতে সাঁতার শেখার মতো, সাংসদরা হয়তো ভেবেছেন যে, পুলিশও ঠিক শিখে যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের ভুলে বহু দোষী রেহাই পাবে, আবার বহু নির্দোষের শাস্তি হবে।
এমন গুরুত্বপূর্ণ আইন কার্যকর করার আগে ‘লিগাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ করা অপরিহার্য হওয়া উচিত। শুধু ট্রেনিং নয়, কত জন বিচারক লাগবে, কত জন আইনজীবীর প্রয়োজন হবে ইত্যাদি হিসাব করতে হবে। বিনা প্রস্তুতিতে আইনগুলিকে কার্যকর করে সংসদ আইনের শাসনের পরিবর্তে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy