দশাশ্বমেধ ঘাটে শুরু হল ভারী পিলসুজ, প্রদীপ নিয়ে আরতি। ফাইল ছবি।
বাজেকদমতলা, বাবুঘাট বা বাগবাজার কেন? কলকাতাই বা কেন? কেন নয় নবদ্বীপ, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, উত্তরপাড়া বা কাটোয়া? শহর কলকাতা ব্রিটিশ আমলে অখণ্ড ভারতের রাজধানী ছিল বলে কি সেখানকার গঙ্গা পূতপবিত্র? স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরে ১৯৯৫ সালে পিতলের ভারী পিলসুজ, প্রদীপ নিয়ে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে ওই আরতি শুরু হয়। এখন বারাণসীর কেদারঘাট, অসিঘাট সর্বত্র সেই সন্ধ্যাদীপের রমরমা। মোটামুটি কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের ফারাক। মানে, দশাশ্বমেধ ঘাটে যদি সন্ধ্যা ৬টায় আরতি, কেদারঘাটে সাড়ে ৬টা, আর একটু দূরে, দক্ষিণ প্রান্তের অসিঘাটে প্রায় ৭টা। কলকাতায় কি বাগবাজার, বাবুঘাট সর্বত্র একই সময়ে আরতি শুরু হবে? না কি বাগবাজারে শুরুর আধ ঘণ্টা পরে বাবুঘাটে? কর্তাদের অনেক কিছুই ভাবতে হবে।
তবে, বারাণসীর গঙ্গারতি-মডেলটি সরাসরি কলকাতায় আসেনি। তার আগমন ভায়া অযোধ্যা। বছর দুয়েক আগে সেখানে দেখেছিলাম অন্ধকার সরযূ নদীর তীরে আরতি। সামনে নদী, দূরে ব্রিজের উপর ছুটন্ত বাস আর গাড়ির গতিময় আলো। বারাণসীর ধাঁচে সামনে পিতলের ভারী প্রদীপ, পিলসুজ নিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে আরতি। যোগী আদিত্যনাথ দেখিয়ে দিয়েছেন, গঙ্গারতিতে শুধু মা গঙ্গার স্বত্ব নেই। সেখানে সরযূও ভাগ বসাতে পারে। কলকাতার লক্ষ্যও বদলে গিয়েছে। সে আর টেমস-এর ধারের লন্ডন হতে চায় না, বাগুইআটিতে নকল ‘বিগ বেন’ বসাতে চায় না। জননেত্রী জানেন, উত্তরপ্রদেশ আজ যা ভাবে, বাংলা আগামী পরশু সেটাই নকল করে।
গঙ্গা, বিশেষত বারাণসীর গঙ্গা কবে এত পবিত্র হল? ভারতীয় জনবিশ্বাসে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে গঙ্গা পবিত্র। এই সে দিনও বারাণসীর বাসিন্দা, প্রয়াত সানাইবাদক উস্তাদ বিসমিল্লা খান রোজকার গঙ্গাস্নানের জন্য নিজের শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতে চাননি। তারও আগে ‘পাগলা রাজা’ মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করছেন, তাঁর সঙ্গে যাচ্ছে কয়েকশো ঘড়া গঙ্গাজল। মোগল সম্রাট আকবর গঙ্গাজল ছাড়া অন্য জল পান করতেন না। আগরার প্রাসাদে তাঁর জন্য রোজ সারান থেকে গঙ্গাজল যেত, বারাণসী থেকে নয়। তাঁর সময়েই তুলসীদাস শ্রীরামচরিতমানস লিখছেন। তাঁর কাছে বারাণসী পবিত্র, সেখানে মৃত্যু হলেই মোক্ষ। কারণ, স্বয়ং শিব সেখানে মুমূর্ষুর কানে তাঁর গুরু শ্রীরামচন্দ্রের নাম জপ করে যান। গঙ্গাতীরে মরলে মোক্ষ, আর দূরে হলে নরক, এমন ধারণা নেই। বারাণসীর আর এক সন্তান সন্ত কবীরও গঙ্গাকে গুরুত্ব দেন না, দোঁহা রচনা করেন, “মল মল ধোয়ে শরীর কো/ ধোয়ে না মন কা মেল/ নহায়ে গঙ্গা গোমতী/ রহে বেল কা বেল।” বারাণসীর গঙ্গার বৈশিষ্ট্য এখানেই। একই স্রোতে সে পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকে অক্লেশে ধারণ করে। গল্প, ব্যাসদেব কাশীর প্রতিপত্তিতে ক্ষুব্ধ হয়ে গঙ্গার অন্য পারে আর একটি কাশী প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা করলেন। দেবী অন্নপূর্ণা বৃদ্ধার ছদ্মবেশে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে মরলে কী হয়? ব্যাসের উত্তর, “শিব হয়।” বৃদ্ধার ফের প্রশ্ন, কী হয়? “শিব।” ফের বুড়ি বলল, কী হয়? ঋষি বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “গাধা হয়। ঠিক আছে?” বুড়ি তথাস্তু বলে উধাও! লোকবিশ্বাস, সেই থেকে গঙ্গার এ পারে বারাণসীতে মরলে মানুষ শিব হয়, ও পারে রামনগরে বা ব্যাসকাশীতে মরলে গাধা। কলকাতা, হাওড়ার গঙ্গায় এ পার ও পারের কোনটা পুণ্যস্নান, কে জানে! সবই দূষণে ভরা!
বারাণসীর শ্রেষ্ঠত্বের মিথ আসলে যে দেশে গঙ্গা নেই, সেই মহারাষ্ট্রের পণ্ডিতদের অবদান। মোগল আমলের গোড়ার দিকে নারায়ণ ভট্ট নামে এক মরাঠা পণ্ডিত হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় ‘ত্রিস্থলীসেতু’ নামে এক পুঁথি রচনাও করেন। সেখানে বলা হল, গয়া, কাশী ও গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে প্রয়াগই হিন্দুদের আসল তিন তীর্থ। এই তিনটেই ত্রিস্থলী। মানে, শুধু গঙ্গা নয়, অন্তঃসলিলা ফল্গুও সমান পুণ্যতোয়া।
মরাঠা পণ্ডিতের লেখা সংস্কৃত পুঁথি কী আর তামাম দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে পারে? বারাণসীর ‘পবিত্র গঙ্গা’কে জনপ্রিয় করা বস্তুত ম্লেচ্ছ ব্রিটিশ সাহেবদের অবদান। মোগল সাম্রাজ্যের অবসানে, বারাণসীর গঙ্গায় মরাঠাদের তৈরি একের পর এক ঘাট। ছবির মতো। সাহেবরা একে ‘রোম্যান্টিক’ বা ‘পিকচারেস্ক’ ছাড়া আর কী ভাবতে পারেন? উইলিয়াম হজেস, টমাস ড্যানিয়েল থেকে কলকাতার টাঁকশালের কর্তা জেমস প্রিন্সেপ তখন বারাণসীতে গঙ্গার ঘাট ও মন্দিরের ছবি আঁকেন, বিদেশিনী ফ্যানি পার্কস, মারিয়া গ্রাহামরাও ওই ‘পিকচারেস্ক’ শহরে মুগ্ধ। ছবির মতো হয়ে ওঠাই যে আসল, তা বোঝা যায় কলকাতার তৎকালীন বিশপ রেজিনাল্ড হেবারের ভ্রমণকথায়। ১৮২৯ সালে তিনি বারাণসীর গলিতে ষাঁড় ও পণ্যসম্ভার দেখে অবাক। উত্তর থেকে শাল, দক্ষিণ থেকে রত্নরাজি, ঢাকা থেকে মসলিন কী নেই? গঙ্গারতি ছিল না ঠিকই, তবু বারাণসী সাহেবদের আকর্ষণ করেছে অন্য কারণে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়েই বোঝা গেল, অর্থনৈতিক ঐশ্বর্য, নদীতটের সৌন্দর্যায়ন কিছুই আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমাদের অন্তরের ধারণা? সে তো স্বরাট! উপনিবেশের ধারণা কি সেখানে থাবা বসানোর ক্ষমতা রাখে? সাহেবরা তত দিনে ‘গঙ্গা ক্যানাল’ কেটে, গৌণ স্রোতটিকে হরিদ্বারের হর-কি-পৌড়ী, বিষ্ণুঘাট দিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বেশি জল গিয়েছে তার পাশে ‘নীলধারা’ দিয়ে। পর্যটনের খাতিরে ওই হর-কি-পৌড়ী ঘাটটি গুরুত্বপূর্ণ, বেশির ভাগ লোক সেখানেই স্নান করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ১৯১৪-১৫ নাগাদ তাই পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয়র চেষ্টায় হরিদ্বারের ওই ঘাটে প্রথম শুরু হল গঙ্গারতি। ঘাটের ছোট্ট মন্দির থেকে গঙ্গাদেবীর মূর্তিটি পাল্কিতে বার করে ঘাটের ধাপে বসানো হল, পুরোহিতরা ফুল, পাতায় আরতি ও সন্ধ্যার্চনা করে মূর্তি ফের মন্দিরে নিয়ে গেলেন, বাকিরা শালপাতায় ফুল ও প্রদীপ অন্ধকার গঙ্গাস্রোতে ভাসিয়ে দিল। এখনও সেখানে এ ভাবেই আরতি হয়, ঘাটের উল্টো দিকে যে চাতালে দর্শনার্থীরা বসে আরতি দেখেন, তার পোশাকি নাম মদনমোহন মালবীয় দ্বীপ।
স্বাধীন ভারতে, ১৯৯৫ সালের বারাণসী এই মালবীয় মডেল মানেনি। উদার অর্থনীতি, স্যাটেলাইট টিভির যুগে আরতি হতে হবে ‘স্পেক্টাকল’ বা দর্শনীয়। অতএব, দশাশ্বমেধ ঘাটে শুরু হল ভারী পিলসুজ, প্রদীপ নিয়ে আরতি। প্রসঙ্গত, দশাশ্বমেধ ঘাট নতুন গুরুত্ব পায় ঔপনিবেশিক আমলেই। গোদাবরী বা গোদালিয়া নামে এক ছোট নালা বুজিয়ে তৈরি হয় ওই ঘাটের রাস্তা। সেই গোদালিয়া থেকেই কালে কালে রাস্তার নাম গোধূলিয়া। ইংরেজের তৈরি ক্যানাল বা রাস্তা না থাকলে হরিদ্বার থেকে বারাণসী কোথাও হতে পারত না গঙ্গাপুজো।
অথচ, এই বঙ্গে ত্রিবেণীর গঙ্গারতি ‘ঔপনিবেশিকতা’ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারত। জোব চার্নকের জন্মের ঢের আগে থেকে সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী আমাদের অন্যতম বাণিজ্যশহর। বাংলার শেষ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে আছে ত্রিবেণীর নাম। এমনকি গঙ্গাস্নানে আজও বিশ্বাসীরা যে স্তোত্র আওড়ান, ‘অচ্যুতচরণতরঙ্গিনী শশিশেখর মৌলী মালতিমালে/ত্বয়ি তনুবিতরণ-সময়ে দেয়া হরতা ন মে হরিতা’— অর্থাৎ, হে বিষ্ণুচরণ নিঃসৃত, শিবের জটাস্থিত নদী, দেহত্যাগের পর আমাকে শিবত্ব দিয়ো তুমি— সুলতানি আমলের শুরুতে সংস্কৃত ভাষায় এই শ্লোক ত্রিবেণীতে লিখেছিলেন দরাপ খাঁ গাজি। গাজি মানে, প্রথম দিকে তিনি হিন্দুদের কচুকাটা করতেন, তার পর মর্জি বদল। ত্রিবেণীতে আজও আছে তাঁর সমাধি। মধ্যযুগের বাংলা কবিতা, ‘ত্রিবেণীর ঘাটেতে বন্দিনু দরাফ খান্/গঙ্গা যাঁর ওজুর পানি করিত যোগান।’ বাংলার সর্বধর্ম সমন্বয় শুধু উনিশ শতকের রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দে আবদ্ধ নয়, তার চেতনা আরও গভীরে। যে নেত্রী সর্বদা ‘জয় শ্রীরাম’ আওড়ানো হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে, তাঁর অনুপ্রেরণালব্ধ গঙ্গারতিতে কি ত্রিবেণীই হতে পারত না উজ্জ্বল উদ্ধার?
তবে, এই বঙ্গে এখনও একটি জিনিসের অভাব। মা গঙ্গার ভক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। হর-কি-পৌড়ীর ঘাটে আরতি আয়োজন করে ‘গঙ্গাসভা’। দশাশ্বমেধ ঘাটে ‘গঙ্গোত্রী সেবা সমিতি’, অসিঘাটে ‘গঙ্গা সেবা সমিতি’। বাঙালি এ সব জানে। বাম আমলে এই রাজ্য বামফ্রন্ট-প্রভাবিত ‘নাগরিক কমিটি’-তে ছেয়ে গিয়েছিল। এ বার নাহয় ঘাট-এলাকার তৃণমূল দাদা, দিদিদের প্রভাবে পাড়ার ‘ইয়ং স্টার’ বা ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’ বদলে যাবে ‘গঙ্গা ফ্রেন্ডস’ জাতীয় নামে।
তাতে আপত্তি নেই। আসলে গঙ্গারতির ধর্মীয় শিল্পে বিনিয়োগের দরকার নেই। কিছু কাঁসর ঘণ্টা, প্রদীপ, পিলসুজ, মন্ত্র বলার মাইক। দর্শকদের জুতো রাখা, ঘাটের ভাল জায়গায় প্লাস্টিকের চেয়ারে তাঁদের বসার টিকিট থেকে আয়, কোনওটাই তো অডিট করা যায় না। সবই খুচরো এবং হিসাব-বর্হিভূত। বড়জোর কয়েকটি বড় চপ, মিষ্টি ও চায়ের দোকান থাকতে পারে। কিন্তু ট্রেন্ড বলছে, সেই দোকান খুলতে গেলেও গঙ্গাতীরের দাদাদের তোলা দিতে হবে।
কষ্টকল্পনা? না কি ঘরপোড়া বাঙালি সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়? উত্তর জানে ছল-ছলাৎ গঙ্গাস্রোত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy