তদন্ত: জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সল্ট লেকের বাড়িতে ইডি-র তল্লাশি। স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।
এ বড় সুখের সময় নয়। মোটামুটি নির্বিঘ্নে পুজো কাটল। জাঁকজমক করে কার্নিভালও হয়ে গেল। জেলা থেকে রেড রোড সর্বত্র উপচে পড়ল খুশির রোশনাই। কিন্তু এত সবের পরেও সুখ মিলছে কি? জানি, এটা কোনও প্রশ্ন হতে পারে না। কারণ, এর উত্তর সবার জানা। যেটা আসল প্রশ্ন তা হল, পথের শেষ কোথায় এবং কী আছে শেষে? জ্যোতিপ্রিয় (বালু) মল্লিক দীর্ঘ তালিকায় সাম্প্রতিক একটি সংযোজনমাত্র। তাতে মূল ছবির ধোঁয়াটে রং বদলায় না। প্রশ্নগুলিও তাই ফুরোয় না।
একুশের বিধানসভা ভোটের পর থেকে বছর দুয়েকের মধ্যে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতা, মন্ত্রীরা যে ভাবে নানা দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়ছেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সির তলব পাচ্ছেন, ইনি-তিনি জেলে যাচ্ছেন, তা সত্যিই নজিরবিহীন। বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন রাজ্যে সরকার ও শাসক দলের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সির হানা এখন তো প্রায় নিত্য কর্মসূচি। তবে অভিযুক্তের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ বোধ হয় অন্য সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।
সিবিআই, ইডি-র বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এখন দেশ জুড়ে। সব অভিযোগই অমূলক, সে কথা বলা যাবে না। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির বেলায় কোনও তদন্তের গতি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিরোধী রাজ্যগুলিতে তদন্তের তৎপরতার ফারাকও একেবারে আকাশ-পাতাল। এই রাজ্যে দুর্নীতির যে অভিযোগে তৃণমূলের লোকের সাজা হয়, সেই এক অভিযোগে বিজেপি নেতার কেশাগ্র স্পর্শ করা হয় না, এ সবও তো বাস্তব। তা বলে চোখের সামনে পর পর যা ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তার সবই ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বা ‘প্রতিহিংসা’ বলে উড়িয়ে দেওয়ারও কোনও অবকাশ নেই। রাজ্যের শাসক দলের এ বার এটা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। ভোটের আগে তৃণমূলের কাছে বিষয়টি চ্যালেঞ্জও বটে।
সন্দেহ নেই, তৃণমূলের নেতৃস্থানীয়দের এক-এক জনের ঝাঁপি থেকে যা বেরোচ্ছে, তার কিয়দংশ দিয়েই দুর্নীতির আঁচ পাওয়া সম্ভব। ফলে ঘুরে ফিরে সেই পুরনো কথাটি বলতে হয়— রাজনীতিতে ‘পারসেপশন’ অর্থাৎ দেখা বা জানার ভিত্তিতে ধারণা গড়ে ওঠা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের আগে তার চাপ আরও বেশি। আইনের বিচারে কোন অভিযোগের কী নিষ্পত্তি হবে, সে সব অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে গড়াচ্ছে, তাতে তৃণমূলের অস্বস্তি বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
অনেকের অবশ্য বক্তব্য, রাজ্যে বিজেপি যত দুর্বল হচ্ছে, তাদের সাংগঠনিক নড়বড়ে অবস্থা যত প্রকট হয়ে উঠছে, নানা ভাবে কেন্দ্রীয় ‘ক্ষমতা’ ফলানোর মাত্রা তত বাড়ানো হচ্ছে। তারই অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তাঁদের মতে, এর পিছনে একটি চতুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটি হল, তদন্তকারী সংস্থাদেরই কার্যত শাসকের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসাবে খাড়া করে দেওয়া। তাতে তদন্ত গড়াবে আইনের পথে। দলের গায়ে কাদা লাগবে। আবার আখেরে বিজেপির পালে হাওয়া জোগানোরও সুবিধা হবে।
তবে সে সব যা-ই হোক, মানুষ তো দেখছে যে, বড় বড় নেতা ছাড়িয়ে এক-একটি পুরসভার কাউন্সিলরদের ঘরে পর্যন্ত এখন এজেন্সির হানা। সব অকারণ? সবই চক্রান্ত? মানা কঠিন। কারণ এঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে ‘তোলাবাজি’র অভিযোগ বহু আগেই শোনা গিয়েছিল। তবু তাঁরা অনেকেই দায়িত্বশীল পদ পেয়ে গিয়েছেন। যেমন, এক-দেড় বছর আগে কাগজে খবর বেরোয় পুর-পদাধিকারী জনৈক কাউন্সিলরের নামে। লিখিত অভিযোগে এক ব্যক্তি বলেছিলেন, তিনি একটি বেসরকারি কাজের বরাত পাওয়ার পরে ওই পদাধিকারী কাউন্সিলর তাঁর কাছে অগ্রিম ‘তোলা’ চান। সেই দাবির পরিমাণ নাকি ছিল বরাতের প্রাপ্যের চেয়েও বেশি! তিনি তাই কাজটি করতেই পারেননি। এমন আরও বহু অভিযোগ মাথায় নিয়েও সেই পদাধিকারী বহাল তবিয়তেই আছেন। তবে এখন তাঁর ঘরেও এজেন্সির তদন্ত চলছে।
এটি একটি উদাহরণমাত্র। এই ধরনের লোকজন কে কী ভাবে টাকা ‘করেছেন’, সেই সব টাকার ‘উপভোক্তা’ কে বা কারা, তার সব তথ্য-প্রমাণ এখনও সামনে অসেনি। তাই এখনই এই নিয়ে অধিক চর্চা অনুচিত। কিন্তু ধারণা তো ধারণাই! এর আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’-থেকে কোটি কোটি টাকার হদিস পেতে আমরা দেখেছি। এজেন্সির তদন্তে অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডলের কন্যার অ্যাকাউন্টে বিপুল টাকা এবং সম্পত্তির হদিস মিলেছে। এখন খবর আসতে শুরু করেছে, বালু মল্লিকের স্ত্রী-মেয়েরও নাকি কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স! চাইলেই কি এ সব ধামাচাপা দেওয়া যায়?
অন্য দিকে, একটু নজর করলে আরও ঠাহর হবে, বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে এ পর্যন্ত তৃণমূলের বড় মাপের যে সব নেতা-মন্ত্রী তদন্তের জালে জড়িয়েছেন, এমনকি যাঁরা ইতিমধ্যেই অল্প বা বিস্তর কারাবাস ভোগ করেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই দলের পুরনো আমলের লোক। পরে তাঁদেরই কেউ কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, কেউ সাংসদ, কেউ বিধায়ক, কেউ জেলা-দলের সর্বাধিকারী। এঁরা সবাই ‘চক্রান্ত’-র শিকার কি না, সেই বিতর্ক চললে চলুক। তবে বিপুল টাকা ও সম্পত্তির ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ ব্যাখ্যা দেওয়া কতটা সহজসাধ্য, বলা কঠিন।
তৃণমূলের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রধান নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এজেন্সির তদন্তের আওতায়। তাঁর স্ত্রী, মা, বাবা, ব্যক্তিগত সচিব অনেককে তলব করা হয়েছে। অভিষেক নিজেও বার বার ইডি, সিবিআই-এর মুখোমুখি হয়েছেন। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরার পরে বেরিয়ে এসে বুক বাজিয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জও ছুড়েছেন তিনি। মনে রাখতে হবে, অভিষেক শুধু তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকই নন, তিনি স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারভুক্ত। তাই তাঁর এমন অকুতোভয় অবস্থানের মধ্যে রাজনীতির উপাদান কম নেই। যার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী এবং অর্থবহ। যদিও দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যাওয়া অন্য নেতাদের সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের নবীন প্রজন্ম এখনও দৃশ্যত কিছুটা ‘সতর্ক’।
মমতার কাছে অবশ্য সবটাই ঘোষিত ‘রাজনৈতিক’ লড়াই। তিনি যে সবার পাশে, এটা বোঝাতেও মমতা দ্বিধাহীন। তিহাড় জেলে বন্দি কেষ্ট আজও কাগজে-কলমে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি। বালুর জন্যও তৃণমূল নেত্রী নিজে কতখানি সরব, সবাই দেখছেন। সর্বোপরি তাঁর পরিবারের সদস্যেরা তো আছেনই। দল ও সরকারের কর্ণধার হিসাবে পরিস্থিতির বহুমুখী চাপ মমতার না বোঝার কথা নয়। হয়তো অনেক কিছুর আগাম আঁচ পাওয়াও তাঁর পক্ষে সহজতর। মনে হয়, সেই জায়গা থেকেই তিনি সমগ্র বিষয়টিকে সরাসরি রাজনীতির চেনা ময়দানে কেন্দ্রীভূত করতে চান। যাতে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, আরও কী হতে পারে ইত্যাদি সকল শঙ্কা ও সম্ভাবনার কথা তিনি নিজের মতো করে প্রচার করতে পারেন এবং তা দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা হাওয়া তোলার চেষ্টা করতে পারেন। সোজা কথায়, ‘লড়কে লেঙ্গে’ মেজাজ ধরে রাখতে তিনি কৃতসঙ্কল্প। যাকে বলে, অফেন্স ইজ় দ্য বেস্ট ডিফেন্স।
এ তো গেল রাজনৈতিক কৌশলের দিক। দেখার হল, এজেন্সির বিবিধ তদন্ত ভোটের আগের কয়েক মাসে কোন দিকে কী ভাবে মোড় নেয়। কতটা বাড়ে বা কতটা কমে। কারণ, অনেক কিছুই তার উপর নির্ভর করবে। প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগে কলকাতায় বসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর দলের বঙ্গ-সতীর্থদের বলেছিলেন, “কী হতে চলেছে, আপনারা ভাবতেও পারছেন না!”
সত্যিই তো, আমরা পাঁচ পাবলিক, শাহের ওই বক্তব্যের ‘মর্মার্থ’ কতটুকু বা বুঝব! আমাদের ভাবনা তাই এ দিক-ও দিক যে কোনও দিকেই চলে যেতে পারে। তবে তৃণমূলের সামনে এখন সত্যকে মেনে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। এতে কোনও মিথ্যে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy