—ফাইল চিত্র।
ভোগবাদী যাপন নয়, ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’— হাজারো ওঠাপড়ার মাঝে এই আলোকময় বাণীই হবে ভারতবর্ষের শিরদাঁড়া, বৈদান্তিক অদ্বৈতজ্ঞান হবে তার সুষুম্না— অনুভব করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই ভারতবাসীকে তিনি উদ্বুদ্ধও করেছিলেন আত্মশ্রদ্ধার সেই মন্ত্রে, এ কথা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু আত্মশ্রদ্ধার পাশাপাশি দ্বিতীয় আর একটি স্তম্ভ বিবেকানন্দের ভারতচেতনার সার— আত্মসমীক্ষা। সময় ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিচারে নিজের নিয়মিত মূল্যায়ন করে ঔচিত্যবোধে কর্মক্ষম হওয়ার শিক্ষা এই দেশকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।
বিশ্বের আঙিনায় এ দেশের শ্রদ্ধার্হ সম্পদ তার শাশ্বত ধর্মদর্শন ও আধ্যাত্মিকতা, এ সব কথা বিবেকানন্দ যখন খোলসা করছেন বিভিন্ন জনসভায়, তখন তাঁর দেশবাসীর অবস্থা কেমন? তাঁরা হীনম্মন্যতাগ্রস্ত, পরাভূত। আধ্যাত্মিকতায় বলীয়ান হয়ে জগতের হিতসাধন দূরস্থান, দুর্বল পরমুখাপেক্ষী ভারত তখন নিজের উন্নতি থেকেই লক্ষ-কোটি যোজন দূরে। অথচ, বিবেকানন্দ নিজে তত দিনে ‘হিন্দুধর্ম’-এর স্বীকৃত প্রতিনিধি, ভারতের সবেধননীলমণি ‘যুগপুরুষ’। চাইলে, সে সময়ে আত্মশ্রদ্ধার মোড়কে, আচারসর্বস্ব ধর্মের নামে জনগণকে তাতিয়ে দিয়ে আবেগ-জর্জরিত এই দেশে সনাতনি ঐতিহ্যের ধ্বজাধারী ‘গুরু’ হয়ে থাকার নির্বিঘ্ন পথটি কি ছিল না বিবেকানন্দের সামনে?
এখানেই গড়ে ওঠে আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মসমীক্ষার ‘ডায়লগ’; কারণ ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার অনিয়ন্ত্রিত, উন্মত্ত, ছেলেভোলানো প্রসার চাননি স্বামী বিবেকানন্দ। দারিদ্র ও বিভেদ, হুজুগ ও কুসংস্কারে জেরবার ভারতীয় সমাজে তখন রুটি-রুজি ও সমানাধিকারের প্রয়োজন সর্বাগ্রে, বুঝেছিলেন তিনি। হোক না অতীন্দ্রিয়বোধ মানবজীবনের উচ্চতম আদর্শ, তবু তার দোহাই দিয়ে ইহজাগতিক সমস্যাকে উপেক্ষা করা বা তুচ্ছ প্রতিপন্ন করার দুর্মতি যেন কারও না হয়, এ বিষয়ে তিনি সচেতন। তিনি যখন আমেরিকায়, তাঁর চোখে ভাসছে হাজার-হাজার নিরন্ন দুঃস্থ ভারতবাসীর মুখ। নিজ অবস্থানের মূল্যায়ন করে, ধর্মমহাসভার মঞ্চে নিঃসঙ্কোচে তিনি বলতে পারলেন, ভারতের আশু প্রয়োজন ধর্ম নয়, তার কোটি কোটি আর্ত নরনারী অন্ন চায়: “ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র শেখানো, তাহাকে অপমান করা।”
আত্মসমীক্ষা ও বাস্তববোধের এই সুরে যুক্ত হত আত্মসমালোচনার মিড়। জাতীয় পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে দেশের ভালকে ধরে রাখতে গিয়ে তার মন্দকেও প্রশ্রয় দেওয়ার হৃদয়দৌর্বল্য বিবেকানন্দের ঘটেনি। তীব্র সমালোচনায় লিখেছেন, “আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে, আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি।” আজও যখন ‘উঁচুজাতের’ নলকূপ থেকে জল নেওয়ার দোষে অন্ত্যজ মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়, মন্দিরের কল খুলে তৃষ্ণা নিবারণের অপরাধে প্রহৃত হয় ভিন ধর্মের কিশোর, তখন ধ্বনিত হতে থাকে তাঁর শতাব্দীকাল আগের উচ্চারণ: “আমরা এখন বৈদান্তিকও নই, পৌরাণিকও নই, তান্ত্রিকও নই; আমরা এখন কেবল ‘ছুঁৎমার্গী’, আমাদের ধর্ম এখন রান্নাঘরে... আর ধর্মমত— ‘আমায় ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, আমি মহাপবিত্র!’”
দারিদ্র বা মহামারি রুখতে অর্থ জোটে না, অথচ মোটা টাকার ধর্মব্যবসা যে হয় ভারতে, তা চোখ এড়ায়নি বিবেকানন্দের। গুরুভাইদের লিখছেন, “টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন... এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে।” এই ‘জ্যান্ত ঠাকুর’— জীবের মধ্যে ‘শিব’কে দেখা ও তাঁর সেবাই বিবেকানন্দের ধর্ম। ধর্মের সারসত্যটুকুও তাই তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল অন্য ভাবে: “যদি একজনের মনে এ সংসার নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য... বাকি সব ঘোড়ার ডিম।”
দেশ গড়তে গেলে যুগপৎ প্রয়োজন তার কুসুমাস্তীর্ণ জমির কর্ষণ ও কণ্টকাকীর্ণ পথটি বর্জন। ভারতের ঐতিহ্যবাহী অধ্যাত্মসম্পদ যেমন গর্বিত করেছে বিবেকানন্দকে, সমকালীন রক্ষণশীলতা ও কাপুরুষতা তেমনই যন্ত্রণা দিয়েছে। তিনি ভালবেসেছিলেন এই দেশকে, তাই তার সমালোচনাও করেছিলেন। শিক্ষার পরিভাষায় যাকে বলে ‘গঠনগত মূল্যায়ন’, ভারতবর্ষকে সে পথেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, নবজাগরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আত্মসমীক্ষায় আমাদের বড়ই অনীহা; আজও প্রশ্নের, সমালোচনার কঠিন সুরে স্বদেশজীবনের তার বাঁধা দূরে থাকুক, গঠনমূলক ভিন্নস্বর ও প্রতিবাদ মাত্রেই আজ রাষ্ট্রদ্রোহে পর্যবসিত হচ্ছে। ফলে আত্মশ্রদ্ধা যে কখন বদলে যায় অন্যায় প্রশ্রয়ে, কখন সংযমের আড়ালটুকু ফেলে দেশপ্রেম হয়ে ওঠে বেআব্রু, কদর্য জাতীয়তাবাদ, বোঝা দায়।
হয়তো সে কারণেই, বিবেকানন্দকে নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনাও প্রবল। কখনও ভক্তিগদগদ স্বরে আমরা তাঁর অর্চনা করি, কখনও মনে করি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সাম্প্রদায়িক ভোটবাক্সে তিনি ‘পোস্টারবয় রূপেণ সংস্থিতা’, কখনও অতি-প্রগতিশীল সেজে ধর্মের আফিম ত্যাগ করার নামে তাঁকে সবেগে প্রত্যাখ্যানও করি। অথচ, তাঁর স্নেহ ও তিরস্কার যদি সমদৃষ্টিতে গ্রহণ করা যায়, ভারতীয় গণতন্ত্রে শ্রদ্ধা ও সমীক্ষার উর্বর প্রয়াগরূপে বিবেকানন্দ আজও ভাস্বর। তিনি সদাসর্বদাই প্রস্তুত দেশগঠনের পাঠ দানে, আমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy