এই স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশুকল্যাণ প্রকল্প বা শিক্ষাব্যবস্থার উপভোক্তা দরিদ্র, বড়জোর নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ। প্রতীকী ছবি।
আবাসন বিভ্রাট ঘিরে রাজ্যে যে তোলপাড় চলছে, তার একটা পার্শ্বনাটকে কারও নজর নেই। বহু জায়গায় আশাকর্মীরা জনরোষে পড়ছেন: লোকে তাঁদের দুষছে, হেনস্থা করছে, আটক করছে পর্যন্ত। আবাসন সমীক্ষায় আশাকর্মী কেন? তাঁদের একমাত্র বিধিবদ্ধ কর্মক্ষেত্র জনস্বাস্থ্য। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও এই কাজে নামানো হয়েছে; তাঁদের ‘জব ডেস্ক্রিপশন’-এ ঘুণাক্ষরে এমন উল্লেখ নেই।
আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা খাতা-কলমে সরকারি কর্মীই নন, স্বেচ্ছাসেবক; এবং সেই ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষেত্রে। সরকারি দফতরে পদবলেই এই ধরনের কাজে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ বহু কর্মী ও আধিকারিক আছেন। মাঠে নেমে অগ্নিগর্ভ আবাস প্রকল্পের ঝক্কি সামলাতে এই বিচক্ষণ মানুষেরা স্বভাবতই অপারগ; সামনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আশা-অঙ্গনওয়াড়ির সর্বংসহা দিদিমণিদের।
আশাদিদিরা যখন বাড়ি গুনছেন, গ্রামের কোনও মহিলার প্রসববেদনা উঠলে কে সামলাবে? শিশুদের টিকাকরণের দিন কী হবে? অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বেরিয়ে পড়লে সারা দিন বাচ্চাদের কে দেখবে খেলাবে পড়াবে? খাওয়াটুকুই কি হবে ঠিকঠাক?
স্বাস্থ্যকর্মীদের এমন কাজে নামানো নতুন ধারা। আশাদিদিদের মতো স্বাস্থ্যকর্মী আগে ছিলেনই বা কই? এমন ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমল থেকে, উপলক্ষ নিত্যনতুন: ঝড় বন্যা দাঙ্গার সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বাচন, ভিআইপির আগমন, দুয়ারে সরকার, রাজনৈতিক সভা। গ্রামে-গ্রামে আজ পঞ্চায়েত ভবন থেকে শুরু করে নানা ইমারত, তবু ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই স্কুল-কলেজ। তাদের ঘর আটকে থাকে, আসবাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যুৎ খরচ মেটাতে অনুদানে টান পড়ে। আর লেখাপড়া অবশ্যই শিকেয় ওঠে। শিক্ষকরাও দশভুজ: জনগণনা থেকে ভোটার তালিকা, কোন কাজটা নয়? সরকারকে দুয়ারে-দুয়ারে পৌঁছে দিতেও তাঁদের চাই। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের ক্লাস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সুপারিশ আছে; কবে তা কার্যকর হবে? বলা বাহুল্য, এই স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশুকল্যাণ প্রকল্প বা শিক্ষাব্যবস্থার উপভোক্তা দরিদ্র, বড়জোর নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ। আমাদের মজ্জাগত সংস্কার, গরিবগুর্বোর বরাদ্দ পরিষেবা সাচ্চা সরকারি কাজের মধ্যে পড়ে না। নেহাত পাবলিকের মাথায় ঢুকে গেছে, ভোটের তাগিদে বলতে হয়, এক-আধটু করতেও হয়। তা বলে ভোটের স্বার্থেই আরও কত দামি কাজ আছে, সে সব ফেলে রাখলে চলে? এই গণতান্ত্রিক নিষ্ঠায় মিশে গেছে সাবেক ঔপনিবেশিক মন্ত্র যে সরকারের আসল কাজ দুটো, লাঠি ঘোরানো আর রাজস্ব আদায়। প্রজাপালন হবে উদ্বৃত্তটুকু দিয়ে।
সেই উদ্বৃত্ত কাজে লাগিয়েই অনেক কিছু হয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের কার্যকর উদ্ভাবন ২০০২-এ, আশা কর্মী নিয়োগ ২০০৫ থেকে। শিক্ষার অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ২০০২-এ, আইন পাশ ২০০৯-এ। কিছু-না কিছু-না করেও এই প্রকল্পগুলিতে প্রভূত সুফল মিলেছে। জনস্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে। অতিমারির আগে প্রাথমিকে ভর্তি প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছেছিল। মেয়েদের স্কুলে ভর্তি যথেষ্ট বেড়েছিল, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেছিল। সমাজের উচ্চবর্গের, অতএব সরকারের, এই উন্নতিতে মন থেকে সায় ছিল না, আজও নেই। বলতে বাধে, এই শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে অতিমারি এল আশীর্বাদ হয়ে। অতিমারির পর ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে বিশ্বের সর্বত্র, ভারতে কিছু বেশিই। বিত্তশালীর ভোগব্যয় বেড়েছে। গরিবের ব্যয় ও পণ্যভোগের বহর কমেছে, কমেছে কর্মসংস্থানের আশা-উদ্যোগ।
এমন দৃশ্যপটে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বাজেট গত বছরের সর্বশেষ বরাদ্দের মাত্র ০.১ শতাংশ বেশি হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্যের কিছু নেই, অঙ্গনওয়াড়ি আর মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বলতে গেলে এক থাকায়। (মিড-ডে মিলে পরে কিছু বেড়ে থাকতে পারে।) সবচেয়ে আশ্চর্য, অতিমারির দুর্দিনে অঙ্গনওয়াড়ি খাতে প্রকৃত ব্যয় হয়েছিল বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশ! এ দিকে বিভিন্ন শিক্ষাবঞ্চিত গোষ্ঠীর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বৃত্তি বন্ধ। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এই মনোভাবে জারিত, খুঁড়লেই বেরিয়ে পড়ে। যেখানে গরিবের সন্তানের মঙ্গলসাধনের সম্ভাবনা ছিল, বিশেষত অঙ্গনওয়াড়ি আর প্রাথমিক স্কুলের পুনর্বিন্যাসে, তা নিয়ে টুঁ শব্দ নেই।
এই অবস্থায় অর্থক্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির উপর প্রচণ্ড দায় বর্তাচ্ছে, কেন্দ্রের বিমুখতা পুষিয়ে দেওয়ার। এ রাজ্যে গরিবের হাতে টাকা বা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার নানা প্রকল্প হয়েছে, কিছু উপকার অবশ্যই হচ্ছে। স্কুলপড়ুয়াদের জন্যও হরেক ব্যবস্থা, সর্বোপরি কন্যাশ্রীর মতো একটি অসাধারণ প্রকল্প।
সব প্রকল্প সমান নয়; তবু সমবেত ভাবে এগুলিকে খয়রাতি বললে অবিচার হয়। বলার অবকাশ যে থেকে যায়, তার কারণ দান-অনুদানের পিছনে সদিচ্ছার অভাব। শিক্ষাক্ষেত্রে যে দুর্নীতির নিত্যনতুন প্রকাশ আমাদের হতবাক করছে, তা এই অভাবের সবচেয়ে উৎকট অভিব্যক্তি। জনগণের শিক্ষা যেন একটা আলগা এলেবেলে ব্যাপার। ক্ষমতাবানের স্বার্থসিদ্ধিতে রাশ টানছে না, সুযোগ জোগাচ্ছে। দুর্নীতির এই শিখরে পৌঁছবার সিঁড়ি ছোট-বড় অশেষ ফাঁকি আর ঘাটতিতে। ব্যক্তিবিশেষের ফাঁকি নয়, পুরো ব্যবস্থার ফাঁকি, সিস্টেমিক প্রবঞ্চনা। ফিরে এলাম আমার গোড়ার কথায়। শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের বাইরে অন্য কাজে লাগানো হয়; সরঞ্জাম পরিকাঠামোর অভাবে শিক্ষাদান মাথায় ওঠে; শিক্ষকপদ খালি পড়ে থাকে, আস্ত পাঠ্যক্রম বরবাদ হয়ে যায়। এ সবই সমাজ ও সরকারের নীরব কিন্তু উচ্চগ্রাম ঘোষণা: লেখাপড়াকে আমরা থোড়াই কেয়ার করি। ‘চাকরি চুরি’ কথাটা চালু হয়েছে। তার চেয়েও বড় পাপ, শিক্ষা চুরি হয়ে চলেছে। আমাদের হুঁশ নেই, ফলে সে পাপে আমরাও দায়ভোগী।
আদালত অর্থচোরদের সাজা দিতে পারে; চোরাই শিক্ষার ধন উদ্ধারের দায় শিক্ষাকর্তাদের। বহু বিলম্বে হলেও এ-বার তাঁরা জানুন ও জানান, কোন স্কুলে কোন বিষয়ে স্থায়ী-অস্থায়ী পূর্ণ-আংশিক কত জন শিক্ষক বহাল, কত পদ খালি। জানান, শিক্ষকের অভাবে কোথায় ক্লাস বন্ধ; ক’টি শ্রেণির জন্য ক’টি শ্রেণিকক্ষ; গবেষণাগারে কত টাকা অনুদান মিলেছে, গ্রন্থাগারে শেষ কবে বই কেনা হয়েছে। দু’টি বিষয়ে জানা সবচেয়ে জরুরি। এক, শিক্ষক অর্থ সরঞ্জাম বণ্টনে স্কুলে-স্কুলে কী ভাবে সামঞ্জস্য আনা হচ্ছে, ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। দুই, অতিমারির ফলে অনুশীলনে যে ভয়াবহ বিঘ্ন ঘটেছে, সেটা কী ভাবে পূরণ হচ্ছে।
ভারত জুড়ে মৌলিক প্রণালীগত স্তরে, আইনসিদ্ধ পথে নীরবে শিক্ষা চুরি হয়ে চলেছে। রাজ্য স্তরে এই ক্ষতি ঠেকাবার সুযোগ ছিল, কারণ অন্যান্য বিষয়ের মতো শিক্ষার সঙ্গে রাজ্যের কারবার সরাসরি, দৈনন্দিন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মানবিক সংযোগে। দেশব্যাপী নড়বড়ে কাঠামো সত্ত্বেও তাই তাদের সত্যিই কিছু শেখানো যায়। আবার এই তৃণমূল স্তরে অনাচার ঘটলে শিক্ষার আয়োজন পণ্ডও হয় সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে স্থূল ভাবে।
সব রাজ্যেই বহু দরদি শিক্ষক এবং কিছু বিরল প্রশাসকের কল্যাণে সাধারণ ঘরের বহু ছেলেমেয়ে এখনও সফল ভাবে লেখাপড়া শিখছে। সেই সুযোগ বানচাল হতে বসেছে কেবল নাটকীয় দুর্নীতির ফলে নয়, শিক্ষার মূল লক্ষ্য যে লেখাপড়া, সেই স্বতঃসিদ্ধ কথাটা আমরা ভুলতে বসেছি। এমন বিস্মৃতির ফলেই দুর্নীতির রাস্তা খুলে গেছে। শিক্ষা শিক্ষক শিক্ষালয় কব্জা করেছে সমাজের অন্যান্য স্বার্থ।
এমনই হয়ে চলবে? রাজ্যের ৮৬ শতাংশ ছেলেমেয়ে সরকারপোষিত স্কুলে পড়ে। তারা, তাদের মা-বাবারা এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন? বলা যায়, বড়রা জীবনযন্ত্রণায় জেরবার। প্রতিবাদের ফুরসত নেই, স্বপ্ন দেখা কোন ছার। সেটা কিন্তু শেষ কথা নয়। শিক্ষার রোখ কত প্রবল, গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে মায়েদের সভা দেখলে স্পষ্ট হয়। সন্তানের কোচিং-এর জন্য দরিদ্র পিতামাতা আয়ের কত অংশ খরচ করেন, শুনলে রোমাঞ্চ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বায়নের যুগে ছোটরা নিজেরাই দুনিয়ার খবর রাখে, বাস্তব-অবাস্তব নানা স্বপ্ন দেখে। সেই দাবি সেই স্বপ্নকে মর্যাদা না দিলে এক দিন যে ক্ষোভ ফেটে পড়বে, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে শোরগোল সে তুলনায় নগণ্য। অর্থনৈতিক পতন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, শিক্ষাভিমানী উচ্চবর্গের দর্পনাশ— এ সব ছেড়েই দিলাম।
বিপর্যয় যথেষ্ট ঘটেছে। ভক্তিতে না হলেও ভয়ের তাগিদে কিছু না করলেই নয়। কিন্তু শুধু তা-ই বা কেন হবে? আমাদেরই ছেলেমেয়েদের জন্য আমরা আর একটু ইতিবাচক ভাবে দরদ দিয়ে সত্যিকারের লেখাপড়ার আয়োজন করতে পারি না?
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy