—প্রতীকী ছবি।
আমরা যখন স্নাতকোত্তর স্তরে লেখাপড়ার জন্য প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি, তখন আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যে বিষয় নিয়ে পড়তে এসেছি, সেটি ভাল করে শেখা। অনেক সময় স্নাতক স্তরে একটি বিষয়ের বিস্তার আর তার ব্যাপকতা এক জন ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে অনুভূত হয় না। সেই ফাঁকটি অনেক সময় স্নাতকোত্তরে ভরাট করা সম্ভব হয়। আমাদের মতো অনেকের সেটাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। আমাদের অনেক সহপাঠী সক্রিয় ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যেও দেখেছিলাম পড়ার বিষয়টি শেখার বা বোঝার আগ্রহ। সহপাঠীদের একটি গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল স্নাতকোত্তর গবেষণা করে গবেষক হওয়া এবং অধ্যাপনা করা। আর একটি অংশ প্রশাসন ও বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আরও একটি অংশের লক্ষ্য ছিল বেসরকারি ভাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, যে কারণে অনেকে এমবিএ করতে চলে যায়। কিন্তু আমরা কাউকে এমনটা বলতে শুনিনি যে, ‘আমি শুধু রাজনীতি করব’, বা ‘রাজনীতিই হবে আমার পেশা বা জীবিকা’। অন্তত আমাদের সমকালীন কারও এই ‘টার্গেট’ ছিল না। রাজনীতি করতে পারি বা তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি, কিন্তু ওটাই জীবিকা, এমন কেউ বলেনি। তাই কিছু দিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কৃতী ছাত্র যখন দেখা করতে এসে এই কথাটিই বলল, একটু ঝাঁকুনি লেগেছিল।
ঘটনাটি আর একটু বিশদে বলা যাক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র, যে এখন আমেরিকায় গবেষণারত, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। ছাত্রটি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, অর্থনীতি বিষয়টি বুঝতে খুব অসুবিধে তার হয় না, গণিতেও যথেষ্ট পারদর্শী। তাই অ্যাকাডেমিকসে তার সফল না হওয়ার কোনও কারণ নেই। তার কাজের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করি, ভবিষ্যৎ নিয়ে সে কী ভাবছে। অর্থাৎ, তার ভবিষ্যৎ গবেষণা ও ‘অ্যাকাডেমিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ নিয়ে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু সে হঠাৎ বলল, গবেষণার পর দেশে ফিরে রাজনীতি করবে, আর সেটাই হবে তার জীবিকা। দেশে ফেরা উত্তম প্রস্তাব। আজকাল অনেকেই আর বাইরে থাকতে চায় না, কারণ ভারত এখন কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর হয়েছে, আর বিশ্বায়নের যুগে বিদেশে না থাকলেই ভাল গবেষণা হয় না, এ-ও আর বলা যায় না। তা বলে রাজনীতি জীবিকা?
বলছি না রাজনীতি করা খারাপ, কিংবা রাজনীতি জীবিকা হওয়াও খারাপ। আমাদের সামনে সে রকম কিছু উদাহরণ আছে— আমাদের অগ্রজ যাঁরা রাজনীতিকে জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল যখন ছাত্রসমাজ এই সমাজকে পাল্টানোর স্বপ্ন দেখত, তাই হয়তো রাজনীতিতে পুরো সময় দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কতটা পেরেছিলেন জানি না, হয়তো কিছুই পারেননি, তার পর হতোদ্যম হয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। কয়েকজন আবার স্বেচ্ছায় উন্নত অর্থনীতির সুফল ভোগ করবেন বলে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন, তা ছাত্রাবস্থায় যতই তাঁরা বামমনস্ক থাকুন না কেন।
একটু কটাক্ষ করে বললে, রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে ‘ভাল’ জীবিকা। যদি কেউ বিত্তশালী হতে চান, সমাজের সর্বনাশ করে নির্লজ্জ ভাবে অর্থ উপার্জন করতে চান, সম্ভব। যদি জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তা হলে তো অর্থ উপার্জনের অগাধ সুযোগ। এমনকি সংসদে প্রশ্ন তোলার জন্যও অর্থ নিতে পারা যায়। সেই সঙ্গে থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অগাধ ‘দাদাগিরি’র লাইসেন্স, সব কুকর্ম ধুয়েমুছে সাফ। আর কুকর্ম করলেই বা মনে রাখছে কে? এমনিতেই জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি স্বল্পকালীন। দু’-চার টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই তাঁরা খুশি। এ-হেন রাজনীতিতে আসা নিশ্চয়ই এই ছাত্রটির উদ্দেশ্য নয়!
এ রকম একটি ধারণা আমরা অনেকেই পোষণ করি যে, ভাল ও শিক্ষিত মানুষের রাজনীতিতে আসা উচিত। তাতে রাজনৈতিক জগতের গুণগত উন্নতিসাধন হবে, আর রাজনৈতিক দলগুলি দেশের স্বার্থে যথাযথ ও ঠিক পদক্ষেপ করতে পারবে। সমস্যা হল, রাজনীতির উন্নতিসাধন তো দূরস্থান, বর্তমান রাজনীতির দুরবস্থা এক জনের চারিত্রিক ও নৈতিক অবনমনের কারণ হতে পারে। অন্য ভাবে বললে, ‘সিস্টেম’ মানুষের পরিবর্তনের কারণ হয়ে যায়, ‘সিস্টেম’-এর পরিবর্তন হয় না। বুদ্ধিমান ছাত্ররা এটি বোঝে বলেই হয়তো আজকাল আর রাজনীতিতে আসে না। সেই জন্যই আমাদের হয়তো খুশি হওয়া উচিত এই ছাত্রটি রাজনীতিতে আসবে বলাতে। কিন্তু একটু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, সিস্টেম তাকে গিলে খাবে না তো?
ছাত্রসমাজের বা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের উচিত তাদের পঠনপাঠন সংক্ৰান্ত দাবিদাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা। তার জন্য একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কোনও ছাত্রছাত্রী যাতে কোথাও বৈষম্যের শিকার না হয়, সে দিকে নজর রাখা। ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে সদর্থক পদক্ষেপ ও দাবি পেশ করাই তাদের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। কোনও ছাত্র কুকর্মে জড়িত থাকলে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসাও তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যেন তেন প্রকারেণ কুকর্ম ঢাকা দেওয়া তাদের কাজ নয়, মুক্ত চিন্তার নাম করে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজকতার পরিবেশ তৈরি করা তো অবশ্যই নয়। ছাত্র-ভর্তির দিন ভিড় করে নিজের রাজনৈতিক দলের সদস্য বাড়ানো তাদের লক্ষ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক কারণে রাস্তা আটকে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখাটাও অনভিপ্রেত। এতে সাধারণ মানুষের বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া আর কিছুই হয় না, এবং রাজনৈতিক ভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে।
রাজনীতি আদর্শের স্বার্থে করা এক বিষয়। জীবিকা হলে বেনো জল ঢুকবেই, যা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আজকাল যারা ছাত্র-রাজনীতিতে সক্রিয় তাদের অনেকেরই স্বাধীন ভাবনাচিন্তার ক্ষমতা নেই, পার্টির দাদা-দিদিরা যা বোঝান তা-ই তারা আওড়ে যায় ইষ্টনাম জপ করার মতো। কেউ কেউ আবার স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা থাকলেও জীবিকার স্বার্থে শেখানো বুলি আওড়ানোই শ্রেয় মনে করে। আর যারা স্বাধীন চিন্তা করতে চায় তাদের পার্টি থেকে পত্রপাঠ বিদায় করা হয়। এদের একটি বড় অংশ সমাজ বদলানোর জন্য রাজনীতিতে আসেনি, নিজের আখের গোছাতে এসেছে। তাই এদের থেকে খুব বেশি আশা না করাই সমীচীন।
একটি অঞ্চলের ছাত্র-রাজনীতি সেই অঞ্চলের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই আয়না স্বরূপ। শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন, সামাজিক সংস্কৃতিকেও তা প্রতিফলিত করে। তাই আমরা আজ যা দেখছি তা হয়তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটি নিম্ন রাজনৈতিক ও কূপমণ্ডূক সমাজের প্রতিচ্ছবিমাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy