অ্যাসিড অ্যাটাক সারভাইভার।
ভিক্টিম নন, সারভাইভার। লড়াকু আট মেয়ের সঙ্গে দেখা হল সে দিন। ১১ অক্টোবর কলকাতার এক আয়োজনে এসেছিলেন দক্ষিণবঙ্গের নানা জেলার বাসিন্দা এই মেয়েরা। অ্যাসিড অ্যাটাক সারভাইভার। ওঁদের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে চোখ জলে ভরে ওঠেনি, এমন মানুষ সে-দিন হলঘরে ছিলেন কি? আমাদের কিছু বদলে দিয়ে গেলেন এই মেয়েরা? করুণা নয়, তাঁরা বিচার দাবি করেছিলেন।
ঘটনাগুলো শোনা যাক।
কেস ১, ২, ৩...। না, কেস নন এঁরা কেউ। এক-এক জন জলজ্যান্ত মানুষ। আলাদা আলাদা জীবন বহনকারিণী আলাদা নারী, যাঁদের নিজস্ব সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়া সব আছে। যাঁদের মুখের আচ্ছাদনটুকু কেড়ে নিয়েছে প্রথমে আক্রমণকারী, পরে সমাজ। আমাদের সিস্টেম। যার ভিতরে বহু গলদ।
ধরা যাক সুলতা (এঁদের সবার নামই এ লেখায় পরিবর্তিত)। বাড়ি বর্ধমানের এক গ্রামে। আক্রান্ত হওয়ার পর ছ’বছর লেগে যায় ক্ষতিপূরণ পেতে। অজস্র সার্জারির পরও একটি চোখ চলে গিয়েছে। চশমার আড়ালে ঢাকা আছে সে চোখ। অন্য চোখের সম্বল করে তিনি একটি সংস্থায় কাজ করেন। সিঁদুর পরেন, কিন্তু বর ও তার পরিবার ঘরে নেয় না। হ্যাঁ, সুলতা বিবাহিতা। শুধু কুমারী মেয়েরাই প্রেমের প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধে আক্রান্ত হন না। এই দিনের আট জনের মধ্যে তিন-চার জন বিয়ের পরে আক্রান্ত।
অমিতা। হুগলির মেয়ে। ঘাড়ে পিঠে আছে পোড়ার দাগের মতো। চামড়ায় যেন হাল চষার চিহ্ন হয়ে গেছে। মুখ, নাক রি-কনস্ট্রাকশন হয়েছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত। কারণ, বিবাহবহির্ভূত প্রেমিকের হামলা হয়েছিল বিবাহিতার উপরে। সম্মতি ছিল না অমিতার সেই আগন্তুক প্রেমিকের ডাকে। যখন তখন যে কারও ‘ভালবাসা’ (হ্যাঁ, এই শব্দটাই অমিতা ব্যবহার করেছিলেন) এসে হামলা করতে পারে এক মেয়ের জীবনে? অ্যাসিড হামলায় তার সমস্ত মুখ ও শরীর বিপর্যস্ত, চেহারা পাল্টে যায়। তার নিজ গর্ভের সন্তান পর্যন্ত ভয়ে মায়ের কাছে আসেনি। শ্বশুরবাড়ির কতটা অবদান ছিল সন্তানের এই দূরে সরে যাওয়ার ব্যাপারে, তাও ভাবার। অমিতা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে পুলিশি কেস তো করছেনই। বাড়তি আছে তাঁর আইনি লড়াই। তিনি এখন সন্তানের অধিকারের জন্য লড়ছেন।
রুপালি, কলকাতার প্রান্তে থাকেন। বিধবা মা চেয়েছিলেন মেয়ে পুলিশ হোক। তিনি মায়ের কাছে যথেষ্ট প্রশ্রয় পেয়েছিলেন পড়াশোনায়। ভাইয়েরা ছোট। মেয়ের চাকরির পরীক্ষার এক দিন আগে অ্যাসিড হামলা হয়। মা নিজে সর্বস্বান্ত হয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন, পুলিশ কেসের কথা ভাবেননি। ভয়ে লজ্জায় মুখ হারানো মেয়েটি চার বছর বাড়ির বাইরে বেরোননি। অজস্র অর্থব্যয়ের পর সার্জারির পর আগের মুখ ফেরেনি। তিনি এক দিন ঘুরে দাঁড়ান। বলেন, মা আর সার্জারি নয়। আর বাড়িতে থাকা নয়। আমি বেরোব। এখন তিনি চাকরি করেন। পরোয়া করেন না আর কে কী বলল, ভাবল। শুধু তাঁর পুলিশের চাকরি করার পক্ষে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
মানালি। রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের মেয়ে। অনেক পথ পেরিয়ে আজ তিনি বহু আক্রান্তের রোল মডেল। তিনি আজ অ্যাক্টিভিস্ট। লড়াই লড়ে জেলে পুরেছেন আক্রমণকারীকে। কিন্তু এক দিন তো আক্রমণকারী বেরিয়ে আসবে জেল থেকে। যে মেয়ে তাকে জেলে পুরেছে, তাঁর দিকে আবার সে যে প্রতিশোধ নেবে না, কে বলতে পারে? তবু মানালি আক্রমণকারীর দিকে তাচ্ছিল্য ছুড়ে সাজেন, পুজোমণ্ডপে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। মানালি বলেন, লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকিনি। লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল সেই কাপুরুষের।
বাসবীর বাবার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে প্রোমোটারের সঙ্গে ঝগড়া চলছিল। বাসবীই ছিলেন তাঁর বাবাকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার ‘সফট টার্গেট’। তাঁর মুখে অ্যাসিড ছোড়া হয়। তিনি এখন চোখে দেখতে পান না। দু’চোখেই অন্ধ হয়ে গেছেন বাসবী।
সন্তানবতী অমিতাকে দুই শিশুকে কোলে-কাঁখে নেওয়া অবস্থায় অ্যাসিড ছোড়া হয়েছিল। অ্যাসিড এসে লাগে প্রথমে তাঁর পিঠের দিকে। অসহ্য জ্বলুনিতে তিনি ঘুরে দাঁড়ালে মুখে এসে পড়ে তা। সঙ্গের দুই শিশুর গায়েও ছিটেফোঁটা এসে লাগে। গ্রামের পথে শর্টকাট নিতে গিয়ে এই ঘটনা। সেই পথের গৃহস্থদের সাহায্য চাইলে তারা অস্বীকার করে। শরীরের জ্বালাপোড়া ভুলতে তাঁকে ঝাঁপ দিতে হয় পুকুরে। শিশু দু’টি পথে বসে কাঁদতে থাকে। এক টোটোওয়ালার সাহায্য চেয়ে সেটায় উঠে বাড়ি ফেরেন। তখনও টোটোওয়ালা টাকা দাবি করেন। এই ভয়ানক পথের শেষে তো আছে পুলিশ, হাসপাতালের দ্বারস্থ হওয়া। সে তো অনেক পরে। আক্রান্ত হওয়ার পরে এই বাড়ি অবধি পৌঁছনোর ট্রমা আজও কাটেনি অমিতার।
পরি আক্রান্ত স্বামীর দ্বারা। ভাত ঠিকমতো সেদ্ধ হয়নি বলে স্বামী মুখে ও গলায় অ্যাসিড ঢেলে দেন। পরি আজও ঠিক করে খেতে পারেন না। লিকুইড ফুড খেয়ে থাকেন। খাদ্যনালি জ্বলে গলে গিয়েছে।
কেউ অন্ধ, চোখ প্রায় নষ্ট অনেকের। দীপার চোখে ছ’বার সার্জারি হয়েছে। তাঁকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে আসতে হয় ট্রেনে, গাড়িতে। যাতায়াতের টাকা জোগাড় করাও তাঁর কাছে লড়াই। আট জনের অনেকেই বার বার প্লাস্টিক সার্জারি করার পরও স্বাভাবিক মুখ ফিরে পাননি। একদা ওঁরা লজ্জায় ঘরের বাইরে বেরোতেন না, বছরের পর বছর। বেরোলে মুখ ঢেকে রাখতেন। নীলাকে আয়ার ট্রেনিং নেওয়ার পরও চাকরি দেয়নি কেউ। এক প্রায়ান্ধ বৃদ্ধের বাড়িতে শেষ অবধি সাময়িক কাজ পেয়ে করছেন তিনি।
আজ কিন্তু এঁরা মুখ ঢেকে চলেন না। এঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সুলতা ছ’বছর নিজে গৃহবন্দি ছিলেন। আয়না দেখতে পারেননি এক বছর। উল্টো দিকে মানালি এক মাসের মাথায় আয়না চেয়ে দেখে নিয়েছিলেন, নিজে নিজের ড্রেসিং শিখে নিয়ে করতে শুরু করেন ডাক্তার নার্সদের কাছে। রুপালিকে হাসপাতালে বলা হয়েছিল তুমি ও-দিকে যাবে না, খাবার নিতে। অন্যরা ভয় পাবে, ঘেন্না করবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই রুপালির মা এসে তাঁকে ভাত দিয়ে যেতেন— সকালে, আর রাতে।
অ্যাসিড আক্রমণ শরীরের, মনের উপরে আক্রমণ। সামাজিক ভাবে একটি মেয়েকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আক্রমণ। তাঁর পরিবারকে সমাজচ্যুত করে দেওয়ার জন্য আক্রমণ। এর পরেও নীলা বা বাসবী বিয়ে করেছেন, নিজ পরিবারের বিপক্ষে গিয়েও তাঁদের নতুন পাওয়া পুরুষ বন্ধুকে পাশে পেয়েছেন। সেটাও কম ঘুরে দাঁড়ানো নয়।
২০১৩-র পর থেকে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এই অপরাধকে জামিন-অযোগ্য ‘কগনিজ়েবল’ করা হয়েছে। তথাপি জামিন পেয়ে যাচ্ছে আক্রমণকারী। দণ্ডবিধিতে ৩২৭ ধারায় একটি উপধারা যোগ হয়েছে অ্যাসিড আক্রমণের জন্য। স্বেচ্ছায় কোনও বস্তু দিয়ে আক্রমণ করে কারও শরীরের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে অপরাধকে চিহ্নিত করার ধারা, যার জন্য দশ বছর অবধি কয়েদ হতে পারে। তা সত্ত্বেও বহু বছর আইনি লড়াই লড়েও আক্রমণকারীর সাজা হয় পাঁচ বা সাত বছরের। তার পরেও জেলে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকার সুবাদে আগেও ছাড়া পেতে পারে কয়েদি। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকেই, বেরিয়ে ফের মেয়েটির উপরে কোনও চাপ সৃষ্টি করবে না তো সে?
আক্রমণকারীর পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েটির বা মেয়েটির পরিবারের জানা থাকে। কিন্তু নির্জন পথে মেয়েটিকে যখন আক্রমণকারী অ্যাসিড হামলা করছে, কোনও সাক্ষী থাকবে এমনটা ভেবে নেওয়া ভুল। ফলে, এফআইআর করার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই শুধু মেয়েটির বয়ানের উপরেই তৎপরতা কাম্য থানার তরফে। মেয়েটি প্রচণ্ড যন্ত্রণার ভিতরে, বা অন্ধপ্রায় অবস্থায় আক্রমণকারীকে দেখে শনাক্ত করবেন, এ আশা রাষ্ট্রযন্ত্র করে কী ভাবে?
মেয়েটিকে হয়তো ঘণ্টাভর রাস্তাতেই পড়ে থাকতে হয়েছে, হাসপাতাল অবধি নিয়ে যাওয়ার লোক নেই। গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গভীর রাতে কোন ডাক্তার পাবেন? হাসপাতাল তো আরও দূরের কথা। তার পর সে কিছুটা সুস্থ হলে, ট্রমা কাটিয়ে উঠলে তবে তো এফআইআর করতে যাওয়ার প্রশ্ন। অথচ যত দেরি হবে তার এফআইআর করতে, তত সুদূর হবে থানায় তার বয়ান গ্রহণের বাধ্যতা। সর্বোপরি আছে তথ্যের অভাব, অধিকার জানার অভাব। এ সবের দায় কার? মেয়েটির জন্য হাসপাতাল থেকে থানা পর্যন্ত মসৃণ ব্যবস্থা কেন থাকবে না?
২০১৩ সালের পর, অনেক নতুন নির্দেশ জারি হয়েছে। খাতায়কলমে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রাজ্যে রাজ্যে বিধান করা হয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৭এ ধারা অনুযায়ী, ভিক্টিম কম্পেনসেশন ফান্ড তৈরি করার দায় রাজ্যের। তিন লাখ থেকে দশ লাখ টাকা অবধি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে অ্যাসিড-আক্রান্ত মেয়েদের। কিন্তু, গ্রামের গরিব মেয়েদের নিজের অধিকার সম্বন্ধে জানতেই বছর ঘুরে যায়। দালাল ধরতে হয়, যাঁরা টাকার ভাগ নেন। এনজিওদের খবর খোঁজ পান না অধিকাংশই। অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে খাতায়কলমে অনেক ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু এই আইনঅমান্যের দেশে মানুষকে তা মানতে বাধ্য করবে কে?
এককালীন টাকা দিয়ে এই ক্ষত, এই ক্ষতির পূরণ হয় না। কিছু অসরকারি সংস্থা সত্যিই পাশে থাকে, কিন্তু এই আট যোদ্ধার কাহিনি বুঝিয়ে দেয় যে, কত অপ্রতুল সবই। এবং, তাতেই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই একক লড়াইয়ের আখ্যানগুলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy