—প্রতীকী ছবি।
যে লেখে, সে আমি নয়
কেন যে আমায় দোষী করো!
আমি কি নেকড়ের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে ছিঁড়েছি শৃঙ্খল?
(‘অন্য লোক’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
না সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছুই নেই, এই কথা এখানে বলব না। কারণ সর্বহারা নই, নিপাট মধ্যবিত্ত। ছোটবেলায় বাবা কিনে দিয়েছিল, আর বুড়ি বয়সে নিজে কিনেছি ম্যাজিক স্লেট। খুব মজার— আপনি লিখবেন, মুছবেন, আঁকবেন, মুছবেন আর সুর করে বলবেন, ‘কুমির তোমার জলকে নেমেছি, আমায় ধরতে পারো না।’
বা জননেত্রীর প্রিয় বাক্য, ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান।’
আসলে এটি ধরাধরির গল্প হতে পারে বা বেড়ালেরও গল্প হতে পারে। আবার ম্যাজিক স্লেটেরও গল্প হতে পারে।
আবার সেই প্রাসাদটার গল্পও হতে পারে। ঠিক ধরেছেন, সেই প্রাসাদটা যেখানে সেই মোরগটা খাবার খেতে ঢুকেছিল কিন্তু নিজেই খাবার হয়ে গেল। সেই প্রাসাদটায়।
ধরা যাক, আপনার পাড়ায় এক জন থাকেন, কুঁড়েঘর, হঠাৎ এক দিন দেখলেন বাড়িটা প্রাসাদ হয়ে গেল। তার আগে থেকেই আপনি দেখছিলেন লোকটি শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পিছনে হাত কচলাচ্ছে, তার মোটরবাইক হচ্ছে, এক দিন সে জনপ্রতিনিধি হল, পাড়ার। ভাল কথা। আপনার ফুটপাত বাঁধানো হল, কলে জল এল, রাস্তায় বাতি জ্বলল। আর তার বাড়িটা হঠাৎ প্রাসাদ হয়ে গেল। আপনি খোঁজ নিলেন। জনপ্রতিনিধির বেতন, পরিবারের আয়, খরচ সব মিলিয়েও হিসাব মেলাতে পারলেন না, কিন্তু আপনি কী করবেন? আপনি এক দিন সাহস করে সেই লোকটিকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ভাই বাড়িটা এল কোথা থেকে? লোকটি আপনাকে হিসাব দিল, তার পৈতৃক আয় এত, পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আপনি বুঝতেই পারলেন না যে, এই সে দিনও যে মাটির ঘরে থাকত, তার পারিবারিক ব্যবসা এল কোথা থেকে। কিন্তু মহামতি
শেক্সপিয়র বলে গিয়েছেন: হোরেশিও, স্বর্গ এবং মর্তে এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।
তবে, এই সব দেখেশুনে পাড়ায় ফিসফাস শুরু হল, কিছু লোক ঘোঁট পাকাল, কে যেন চোর বলে পোস্টারও দিল, কিন্তু আপনি তো জানেনই লোকে অন্যের ভাল দেখতে পারে না। এবং যে লোকগুলো পোস্টার মেরেছিল বলে শোনা যায়, তারা নাকি ওই প্রাসাদে গিয়ে খাওয়াদাওয়াও করে এল আর তার পর পোস্টারও মারতে লাগল।
তার পর বাড়িটায় এক দিন সেনা-সান্ত্রি নিয়ে কিছু লোক ঢুকল, আবার বেরোল। গোটা বাড়ি তখন পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিল। আর টেলিভিশনে আলিয়া ভট্টের ফিল্ম দেখানো হচ্ছিল। ফলে মাস্টারমশাই কেন, কেউ কিছু দেখেনি।
কিন্তু ওই সান্ত্রি-পেয়াদার দু’-তিন জন আপনাকে বলে দিল, বাড়িতে কী ঘটেছে, কী তারা দেখেছে। আপনি পুরো কাহিনিটা ম্যাজিক স্লেটে লিখে ফেললেন যাতে ভুলে না যান, আর ঠিক সেই সময়ে বেড়ালটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেসে উঠল। হ-য-ব-র-ল’র বেড়ালটা। কারণ, ওরা বলল, আপনি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বললেন, স্লেটে সব লেখা আছে। কিন্তু স্লেটটাও ফাঁকা কারণ শয়তান বেড়ালটা থাবা দিয়ে ম্যাজিক বাটনটা টিপে দিয়েছিল। ফলে আপনার লেখা বেবাক হাওয়া। স্লেটের লেখাটা তো বেড়াল মুছবেই, কারণ সে তো নিজেই রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে গিয়েছিল।
আপনার রাগ হল, আবার তেমনও হল বলা চলে না। কারণ, এ রকম ঘটনা এখন থেকে আপনার জীবনে ঘটতেই থাকবে আর ঘটতেই থাকবে।
যেমন কিছু লোক জেলে যাবে, কিছু লোক জেলে যাবে না, বিদেশে যাবে। যেমন কিছু লোক বিদেশেই থাকবে, জেলে যাবে না।
যেমন এক দিন রাস্তা দিয়ে আপনি যাবেন, দেখবেন একটা লোককে অনেকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। আপনি দৌড়ে যাবেন, কিন্তু গায়ের জোরে পারবেন না। আপনাকে ওরা ছিটকে ফেলে দেবে। পরে যখন পুলিশ আপনাকে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ডাকবে, আপনি চিনতে পারবেন, কারা মারছিল লোকটাকে, কিন্তু কেউ মানবে না। ওরা বলবে, গোলাপি শার্ট পরা লোকটাই যে রাস্তার ওই প্রধান গুন্ডাটা, সে আপনি জানলেন কী করে? প্রমাণ কোথায়? ও যে যমজ ভাই নয়, ও যে গোলাপি শার্টটার ডপলগ্যাঙ্গার নয় (পৃথিবীতে এ রকম লোক আছে, যারা একই রকম দেখতে কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই), আপনি জানলেন কী করে? আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না, ওই লোকটাই মারছিল, মেরে আধমরা করে দিয়েছিল। আপনি থানা থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসবেন। আপনি কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই, এমন কথা আপনাকে কেউ সরাসরি বলবে না বটে কিন্তু আপনি বুঝে যাবেন, আপনি যা শুনছেন, তা আসলে আপনি শুনছেন না, যা দেখছেন তা আপনি আসলে দেখছেন না। ফলে পারিবারিক ব্যবসা কিছু না থাকলেও জানবেন তা আছে, একতলা বাড়িটা হঠাৎ করে তিনতলা হয়ে গেলে আপনি জানবেন, সব সময়েই তা বৈধ টাকায় তৈরি। আপনি জানবেন গরু থেকে কয়লা, বালি থেকে পাথর, সবাই নিজেরা ট্রাকে উঠে পাচার হতে জানে, চাকরি জানে বিক্রি হওয়ার জন্যই তার জন্ম।
কিন্তু আপনার জানার সূত্র মানে সুতোটি সব সময় ছেঁড়া। কামসূত্র রয়েছে, আমসূত্র নামে বিজ্ঞাপন হতে পারে আমের রসের, কিন্তু সংবাদের কোনও সূত্র থাকতে পারে না। শুধু তাহাই সত্য যাহা প্রেস বিজ্ঞপ্তি বলিয়া প্রেরণ করা হয়। শুধু তাহাই সত্য যা শাসকের মুখনিঃসৃত। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পারো মামলার চিঠি।
বলে রাখা ভাল, সত্তরের দশকে যে কেলেঙ্কারি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এ যে সত্যানুসন্ধান দু’বছর ধরে লেখা হয়েছিল, তার প্রধান সূত্র ছিলেন এফবিআইয়ের প্রাক্তন কর্তা মার্ক ফেল্ট। ইতিহাস তাঁকে জানত ‘ডিপ থ্রোট’ নামে। তিনি যে মার্ক ফেল্ট, তা প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। তার আগে অনেক জল্পনা হয়েছে বটে, কিন্তু সাংবাদিকেরা নীতি অনুসারে তাঁর নাম জানাননি।
কিন্তু ওরা চেঁচাবে, ওরা সব দল, সব রং চেঁচাবে সূত্র, সূত্র, সূত্র, সূত্র কে? ওরা আপনার ছাত্রাবস্থায় কেনা মার্ক্স রচনাবলির একটা পাতা ছিঁড়ে এনে বলবে আপনি মাওবাদী, আপনি নকশাল।
অতএব হে পাঠক, মহামান্য পাঠক, আপনারা এত ক্ষণ যা পড়লেন, এই এতগুলো শব্দ, তা আসলে আপনি পড়েননি, একটা সাদা পাতা দেখেছেন শুধু আর ভেবেছেন এগুলো আপনি পড়েছেন। এই কিছু, এই কোনও কিছু লেখার জন্য, ওই লোকটার প্রাসাদোপম বাড়ির জন্য, ওই গোলাপি শার্ট পরা লোকটার বিরুদ্ধে লেখার জন্য কোনও দিন যদি ওরা আঙুল তোলে, আমি বলব,
“যে লেখে সে আমি নয়... সে কখনো আমার মতন বসে থাকে
টেবিলে মুখ গুঁজে?”
আসলে? যদি বারণ কর, তবে গাহিব,
এমনি ভাবেই গাহিব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy