কবি লিখেছিলেন মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। তখন সবে বৈদ্যুতিনমাধ্যম এসে পৌঁছেছে কলকাতায়, ছাদে ছাদে অ্যান্টেনা পাল্টে দিচ্ছে আকাশের ফ্রেম। খেলা, চিত্রহার, আর ক্বচিৎ-কদাচিৎ দূরদর্শনে দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখার আকর্ষণে পাড়ার টিভিদার বাড়িতে পড়শিদের ভিড়।
তার পর প্রায় অর্ধশতক কেটে গিয়েছে; সমাজমাধ্যম এসেছে হাতের মুঠোয়। বাঙালির আড্ডাপ্রেম, স্বভাবআলস্য, এবং সমাজমাধ্যমের চটজলদি জনসংযোগের ক্ষমতা— এই তিন মিলে নীরব এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে; এক নিঃশব্দ সমাজবিপ্লব— যার অনুরণন চলবে বহু যুগ ধরে। বাংলায় নবজাগরণের মতো হয়তো এ নিয়ে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের চর্চা চলতেই থাকবে, আর তাঁদেরও সম্ভবত মত হবে ফরাসি বিপ্লব নিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চাওয়ায় তার দু’শো বছর বাদে চৌ এন লাইয়ের সেই উক্তির মতোই: “এখনও ঠিক বলা মুশকিল!”
যদি স্বভাবতার্কিক বা আড্ডাবাজ হন, তবে রকে, ঠেকে, বা চায়ের দোকানে যাওয়ার পরিশ্রমটুকুরও দরকার নেই। যদি রাজনীতিতে ঝোঁক থাকে, তা হলে আরামকেদারায় বসেই ফেসবুকে ঝড় তোলা যায়! আর যদি হবু কবি ও সাহিত্যিক হন, সম্পাদকীয় দফতরে লেখা পাঠিয়ে অমনোনীত হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে না— সমাজমাধ্যম (একাধিক অর্থে) আত্মপ্রকাশের অবাধ পরিসর করে দিয়েছে।
প্রথাগত মাধ্যম আর সমাজমাধ্যমের তফাত কী? খেলার মাঠে বা টিভি চ্যানেলে যখন আমরা খেলা দেখি, ধারাভাষ্যকার ও বিশেষজ্ঞদের বর্ণনা শুনি, প্রথাগত মাধ্যম হল তার মতো। আর, পাড়ায় পাড়ায় খেলা হচ্ছে, সেখানে জটলা করে শুধু তা দেখা না, নিজেই ধারাভাষ্য দিতে শুরু করা, ইচ্ছে হলে মাঠে নেমে খেলতে শুরু করা, এমনকি আম্পায়ার বা রেফারির ভূমিকা পালন করতে শুরু করা— সমাজমাধ্যম হল খানিকটা তার মতো। প্রচলিত মাধ্যম হল সংবাদপত্র, পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল। আর সমাজমাধ্যম হল যেখানে কোনও প্রতিষ্ঠান নয়, সাধারণ মানুষই খবর, বিনোদন, এবং মতামত দিচ্ছেন, আবার শুনছেনও তাঁরাই। খানিকটা ‘আমরা সবাই রাজা’র মতো এ যেন অগণিত মানুষের আত্ম-অভিব্যক্তির এক বিচিত্রানুষ্ঠান, যা চব্বিশ ঘণ্টার চ্যানেলের মতো সদাসচল। কিন্তু কোনও চ্যানেল বা মঞ্চ বা অঙ্গনের সঙ্গে সমাজমাধ্যমের মূল তফাত হল, এ সব ক’টি এক জাদু-সুতোয় বাঁধা, যেখানে অগণিত মানুষ একই সঙ্গে কিছু বলছেন বা করছেন, আবার ক্ষণিকের মধ্যে ভূমিকা পাল্টে শুনছেন ও দেখছেন, মতামত দিচ্ছেন, অন্য শ্রোতা ও দর্শকের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন এবং দিনের শেষে ব্যাপারটা জমল কি জমল না, এ রকম একটা জনমত গড়ে উঠছে। এ-বার, এখানে প্রায় সমান্তরাল ভাবে এবং ইচ্ছেমতো আগে বা পরে যোগ দেওয়া যায়, ফলে যে জাদুপ্রাঙ্গণের ছবিটা ফুটে উঠছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
প্রত্যেকে একই সঙ্গে বক্তব্য, গান, কবিতা, ছবি, বা রন্ধনশৈলী পেশ করছেন, আবার শ্ৰোতা বা দর্শক বা পাঠক বা সমালোচকের ভূমিকাও পালন করছেন এবং বিভিন্ন মানুষের এই মহামিলনের সাগরতীরে আপাতদৃষ্টিতে যোগদানের কোনও অন্তরায় নেই, আপাত ভাবে কোনও প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্থতা বা মজন্তালি সরকারসুলভ খবরদারি নেই। এখানে ‘আপাত’ কথাটি ভেবেই ব্যবহার করেছি, কারণ এই যে আপাত-বাস্তব পরিসর তাতে যা দৃশ্যমান আর যা অন্তরালে, তার মধ্যে অনেক ফারাক। এই প্রযুক্তি ও তার ব্যবহার আপাত ভাবে বিনামূল্যে আয়ত্ত হলেও, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা এর থেকে কী ভাবে লাভ করছে এবং রাষ্ট্র কী ভাবে এর মাধ্যমে নাগরিকদের উপর নজরদারি করার চমৎকার ও সুলভ উপায় পেয়ে গিয়েছে, সেগুলো ভুললে চলবে না। আবার, গুজব বা ভুল খবর খুব ঠান্ডা মাথায় এবং সংগঠিত ভাবে ব্যবহার করে রাজনীতির পরিসরে যা হচ্ছে, তা যে গণতন্ত্রের পক্ষে আশঙ্কাজনক, তা নিয়েও আজ দ্বিমত নেই। প্রত্যেকটি বিষয়ই বিশদ আলোচনার দাবি রাখে, কিন্তু এই লেখায় সমাজমাধ্যমের বিশেষত্ব কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করব।
প্রশ্ন হল, সমাজমাধ্যম তাৎক্ষণিক এবং অনেক বৃহত্তর পরিসরে মানুষে মানুষে সংযোগ সম্ভবপর করে দেয় ঠিকই, কিন্তু প্রথাগত মাধ্যমগুলোর সঙ্গে সমাজমাধ্যমের গুণগত তফাত কী? শুধু তা-ই নয়, সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আদানপ্রদানের যে পরিচিত মঞ্চগুলো আছে— সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে নিছক আড্ডা— তাদের সঙ্গেই বা সমাজমাধ্যমের মৌলিক পার্থক্য কী?
তাৎক্ষণিক এবং অনেক বৃহত্তর পরিসরে সংযোগ এবং এই সংযোগের জীবন্ত চরিত্র প্রথাগত মাধ্যমের সঙ্গে একটা বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। ভাবনা থেকে লেখা, লেখা থেকে পাঠকের মতামত, তার প্রত্যুত্তর, এবং আরও পাঁচ জনের এসে যোগ দেওয়া, বিভিন্ন পক্ষ নেওয়া এবং সালিশি বা মাতব্বরি করা, সবই হয় নিমেষে, ঠিক বাস্তব জীবনের আলোচনার আপাত-অনুকরণে। সমাজমাধ্যমে মানুষে মানুষে তথ্য, চিন্তা, মতামত ও সৃষ্টিশীল কোনও প্রয়াস নিয়ে এই যে যৌথ চর্চা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা স্বেচ্ছায় এসে জড়ো হয়েছেন, তার জীবন্ত দিকটিকে যথার্থই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বা আপাত-বাস্তব বলতে পারি। ভেবে দেখুন, কাগজে বা পত্রিকায় কোনও লেখা বেরোল, সেটা নিয়ে কিছু পাঠকের সমালোচনা ও মন্তব্য নিয়ে চিঠি বেরোল, লেখক কোনও ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন, এই সবই হয় অনেক দিন ধরে, এবং তত দিনে ব্যাপারটা পাঠকের কাছে বাসি হয়ে যায়। সমাজমাধ্যমে তার কোনও সম্ভাবনা নেই, বরং আলোচনা এত জমে যায় যে, অনেক সময় রেফারির বাঁশির (হলুদ আর লাল কার্ড তো আছেই) দরকার হয় ‘এ বারের মতো খেলা শেষ’ জানাতে!
সমাজমাধ্যমের আর একটা দিক আছে, যা প্রথাগত মাধ্যমের থেকে মূলত আলাদা। সেটা হল, নতুন সামাজিক সংযোগ তৈরি হওয়া। সমাজমাধ্যম মানে শুধু যে ‘সমাজ’ একটা নতুন ‘মাধ্যম’ ব্যবহার করছে তা নয়, সামাজিক যোগাযোগের একটা নতুন পরিসর তৈরি হচ্ছে। এই দিক থেকে দেখলে সমাজমাধ্যমের ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যে বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই গৌণ হয়ে যায়, বরং সেই সূত্রে ‘আলাপ’ হওয়া লোকেদের সঙ্গে এক ধরনের পরিচিতি হয়ে যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্ধুত্বও। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার বেশ কিছু বন্ধু— তাঁদের বন্ধু বলতে সত্যি কোনও আড়ষ্টতা নেই আমার— সম্পূর্ণ সমাজমাধ্যমে আলাপের সূত্রে হয়েছে। এ-রকম সংযোগ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নানা গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে নিৰ্দিষ্ট বিষয়ে সমভাবাপন্ন মানুষদের উৎসাহে। এ-বারে যদি শুধু আপনি ও আপনার চেনা কেউ নন, চেনার চেনা, তার চেনা, এই ভাবে যে-রকম যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার কথা ভাবেন, তা হলে বলা যেতেই পারে সোশ্যাল মাল্টিপ্লায়ার বা সামাজিক গুণক কথাটির প্রচলিত অর্থের বাইরেও একটা অর্থ হতে পারে। অন্য মাধ্যমের ক্ষেত্রে (যেমন, কাগজ বা পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল) এর সম্ভাবনা কম— চায়ের দোকানে কাগজ পড়া ঘিরে আসর বসতে পারে, তবে প্রায়-অবাধ প্রবেশাধিকার এবং সংখ্যার বিপুলতার দিক থেকে দেখলে তা ঠিক তুলনীয় নয়। তা ছাড়া, সেখানে সামাজিক সংযোগটা আগে থেকেই আছে, আর সমাজমাধ্যমের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী গড়ে ওঠে একই বিষয়ে যৌথ উৎসাহের কারণে।
এর সব ফল যে ভাল তা নয়। যে কোনও প্রযুক্তিরই ভাল মন্দ দুই দিকই থাকে, সমাজমাধ্যম ব্যতিক্রম নয়। যে কোনও সামাজিক পরিসরই বৃহত্তর সমাজের দর্পণ— সমাজমাধ্যমও। তার আপাত-গণতান্ত্রিক ও অবাধ প্রবেশাধিকারের যে দিক, সেটা এক ধরনের সুযোগের সমতা সৃষ্টি করে। যাঁরা গুণী কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নন, এবং বাণিজ্যিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে, তাঁদের আত্মপ্রকাশের একটা মঞ্চ তৈরি করে দেয়। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি, বাংলা ভাষার চর্চা কমে আসা নিয়ে যে একটা পরিচিত খেদ শোনা যায়, সমাজমাধ্যমে খানিক বিচরণ করে, তা অনেকটাই অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে আমার। আবার একই সঙ্গে সমাজের অন্য যে কোনও পরিসরের মতো এখানেও কিছু ধরনের অবাঞ্ছিত আচরণ পারস্পরিক বিনিময়ের পরিবেশটি দূষিত করে দিতে পারে, দেয়ও অনেক সময়। এই আপাত-বাস্তবের পৃথিবীতেও তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কিছু আচরণবিধি ও রীতিনীতি তৈরি হতে থাকে— না হলে, ব্যাবেলের মিনারের মতো কোলাহলে সমাজমাধ্যমের সদর্থক সম্ভাবনাগুলি হারিয়ে যাবে।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy