গত দশকের পর দশক ধরে বাঙালির জীবনে আর বাংলা সাহিত্যে নিরন্তর তাঁর উপস্থিতি, সজাগ প্রকাশ। তিনি ছিলেন আমাদের বেঁচে-থাকা থেকে শিল্পিত প্রকাশের অচ্ছেদ্য গ্রন্থি। শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবি যিনি কবিতায় তো বটেই, গদ্যে, ভাষণে, নিয়ত জীবনযাপনেও প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ভেঙেছেন বার বার।
গত শতকের সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে চাওয়াই যৌবনের ধর্ম হয়ে উঠেছিল, ধর্ম হয়ে উঠেছিল জীবনকে মৃত্যুর সামনে রেখে দেখা বা মৃত্যুকে দেখা জীবনের সামনে রেখে। তার পর যৌবনের সেই ধর্ম অবরুদ্ধ আক্রান্ত হয়ে ঠাঁই পায় স্বপ্নের ইতিহাসে। কবির স্মৃতিতে হানা দিতে থাকে সেই দেশমনস্ক দীপ্ত মুখগুলি, একটি কবিতায় তিনি লেখেন: “আমি কেবল দেখেছি চোখ চেয়ে/ হারিয়ে গেল স্বপ্নে দিশাহারা/ শ্রাবণময় আকাশভাঙা চোখ।/ বিপ্লবে সে দীর্ঘজীবী হোক...।” লেখেন গদ্যেও: “শৃঙ্খলার অজুহাতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে যখন একটা প্রজন্মকে বিকৃত বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় পুলিশের অন্ধকার গুহায়, তখন তার বিরুদ্ধে যদি আমরা সরব হতে নাও পারি, তার সপক্ষে যেন আমরা কখনো না দাঁড়াই। এতটুকু ধিক্কার যেন আমাদের অবশিষ্ট থাকে যা ছুঁড়ে দিতে পারি সেই জেলপ্রাচীরের দিকে, যার অভ্যন্তর ভরে আছে বহু নিরপরাধের রক্তস্রোত আর মাংসপিণ্ডে...।”
রাষ্ট্র যখন তার শস্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়, ব্যক্তির স্বতন্ত্র স্বরের শ্বাসরোধ করে, প্রাতিষ্ঠানিকতার সেই ধরনটি সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ বরাবর সাবধান করেছেন আমাদের। গত শতকের শেষের দিকে, বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতার সূর্য তখনও মধ্যগগনে, এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন: “প্রতাপমত্ততা এবং প্রতাপ-অন্ধতা কোনো সরকারের পক্ষে সর্বনাশের সূচক। সেরকমই কিছু মত্ততা আর অন্ধতায় আমরা ভুলে যাচ্ছি মানুষের যথার্থ ক্ষোভের প্রকৃতি এবং পরিমাণকে, ক্ষোভ আর প্রতিবাদের প্রকাশমাত্রকেই ধরে নিচ্ছি শত্রুপক্ষীয় আচরণ।” কথাগুলি কানে নেয়নি সে সরকার, নতুবা নতুন শতকের প্রথম দশকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা কেন ঘটবে, কেনই বা কবিকে চলে যেতে হবে প্রতিস্পর্ধীর ভূমিকায়। সেই প্রতিস্পর্ধা যদিও কোনও এক নির্দিষ্ট শাসকপক্ষের বিরুদ্ধে নয়— যিনি যখন ক্ষমতায়, তাঁর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে, কলম ধরতে শঙ্খ ঘোষ কখনও দ্বিধা করেননি। কালক্রমে মানুষ যেন ধরেই নিয়েছিল, শাসকের বিরুদ্ধে, তার অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যদি একটিমাত্র কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তবে তা হবে কবি শঙ্খ ঘোষের।
“সুবিনীত মানুষটি/ ‘না’-ও বলে সবিনয়ে/ করে না আপোষ,/ ...নিচুগলা নিচু রেখে/ কোনদিন মানবে না/ ক্ষমতার ফোঁস।”— তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন অশ্রুকুমার সিকদার। জরুরি অবস্থার সময়েও বাঙ্ময় হয়েছিলেন কবি। যখন শৃঙ্খলার নামে বাক্স্বাধীনতাকে খর্ব করা হচ্ছে, তখনই লিখেছিলেন ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’: “পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি/ কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি/ এখন সবই শান্ত, সবই ভালো।/... যে-কথাটাই বলাতে চাও বলি/ সত্য এবার হয়েছে জমকালো।... এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না-দিন/ আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন/ আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে।”
আদি নিবাস বরিশালের বানারিপাড়ায়। নাম ছিল চিত্তপ্রিয়, সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বেই সেই পরিচিতি শঙ্খ নামের আড়ালে চলে যায়। মা অমলাবালা, পিতা সুশিক্ষক, বাংলা ভাষার সম্মানিত বিশেষজ্ঞ, মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। শঙ্খবাবুও শিক্ষকতাই করেছেন সারা জীবন। জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। আত্মপ্রসঙ্গে, ওই অবিভক্ত বাংলা— আজ যা স্বাধীন বাংলাদেশ, তার সঙ্গে নিজের সৃষ্টির আন্তঃসম্পর্কের কথা বলেছেন তিনি: “এমন কবিতা কমই লিখেছি যার মধ্যে— শব্দে বা প্রতিমায়— বাংলাদেশই প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই।... এ তো সত্যি যে মুহুর্মুহু আমি বেঁচে থাকি বাংলাদেশের মধ্যেই।”
দেশভাগের লাঞ্ছনাময় ক্ষত নিয়ে স্বাধীনতা আসার পর, ও-বাংলা থেকে যখন কবি চলে এলেন এ-বাংলায়, হয়তো তখনই তাঁর ওই আপসহীন মনটির রুখে দাঁড়ানোর শুরু। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কোচবিহারে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় এক কিশোরীর, কাগজে সে-খবর পড়ে কবির বিশ্বাস হতে চায় না কথাটা, ক্ষোভে-লজ্জায় কাগজ হাতে বসে থাকেন তিনি। মনে হতে থাকে, “চার বছর পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার পর, দেশের মানুষের কাছে তার খবর এসে পৌঁছেছে, কিন্তু খাবার এসে পৌঁছয়নি তখনও।” তেমনই এক খিদের সুরাহা চাওয়া মিছিলের সামনে থাকা একটি ষোলো বছরের মেয়েকে সীমালঙ্ঘনের অভিযোগে
গুলি করেছিল পুলিশ। “স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের হাতে স্বাধীন এক কিশোরীর কত অনায়াস সেই মৃত্যু!” লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, আর লিখেছিলেন তাঁর সেই ‘যমুনাবতী’ কবিতাটি: “নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/ একটু আগুন দে/ আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে!/... যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে...।” এই মৃত্যুমুহূর্ত, শূন্যতাই কি কখনও স্থির হতে দেয়নি তাঁকে, ব্রতী করে তুলেছিল অসম সংঘাতের ভিতর দিয়ে সামঞ্জস্য খুঁজে বেড়ানোর জীবনব্যাপী কাজে?
তাঁর অন্বিষ্ট যে মানুষকে তিনি সময়ের সমগ্রতায় দেখতে চাইতেন, তাঁর বুদ্ধিমান বা হৃদয়বান হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তাঁকে হয়ে উঠতে হবে তাঁর নিজের আর পরিপার্শ্বের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রশ্নময়। তাঁর মনের মধ্যে অব্যক্ত আর্তনাদ থাকে, প্রত্যেক দিনের ছককাটা জীবনের বাইরে কোনও ব্যথা যখন ব্যাকুল করে, তখনই তিনি চার পাশের সঙ্গে, মানব-প্রকৃতি-সমাজ-ইতিহাস-সময়ের সঙ্গে একটা সম্পর্কসূত্র বুঝে নিতে চাইবেন। “নিজের জীবনকে এই গোটা চালচিত্রের মধ্যে... কখনো-না-কখনো যিনি দেখতে চাননি, জিজ্ঞাসার এই বোধ যাঁকে অন্তত স্পর্শকের মতোও ছুঁয়ে যায়নি কখনো...,” তাঁকে কখনও সাহিত্যের ‘পাঠক’ ভাবতেই পারেননি শঙ্খ ঘোষ।
তাঁর এই ভাবনার ভরকেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আগে বাঙালি বিদ্বজ্জনেরা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তি নিয়েই কেবলমাত্র গর্বিত থাকতেন বা আলোচনা করতেন, তিনিই প্রথম সাহিত্য-গান-নাটক-ছবি-বিশ্বভারতীর সৃষ্টির সমগ্রতায় রবীন্দ্রনাথকে চেনালেন, বাঙালির জীবনে তাঁকে বেঁধে দিলেন এক অমোঘ ছন্দোবন্ধনে, একের পর এক বিরামহীন রচনায় তাঁর শিল্পচেতনা ও জীবনচেতনাকে বাঙালির জীবনে আত্মজাগরণের আত্মদীক্ষার অংশ করে তুললেন।
শঙ্খ ঘোষের রচনাও আমাদের জীবনকে যেন যুধিষ্ঠিরের রথের মতোই এক উত্তরণের দিকে নিয়ে যায়। বিপুল তাঁর রচনাসম্ভার— কমবয়সিদের জন্যে লেখা ছড়া-উপন্যাস থেকে কবিতা-শিল্পসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-সাক্ষাৎকার-ভাষণ-অনুবাদ-রবীন্দ্রনাথ। সেই সুবাদে তাঁর পুরস্কার-সম্মাননাও প্রচুর— সাহিত্য অকাদেমি, নরসিংহ দাস পুরস্কার, শিরোমণি, রবীন্দ্র পুরস্কার, কবীর সম্মান, সরস্বতী সম্মান, দেশিকোত্তম, পদ্মভূষণ, জ্ঞানপীঠ।
কিন্তু, স্বীকৃতি আর সম্মানের এই প্রাচুর্যের মধ্যেও, কখনও সত্যকে বানিয়ে তোলেননি, সৃষ্টিকে কখনও সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক পুতুলের ছাঁচে ঢালাই করেননি। বরং সতর্ক করেছেন: “একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক রচনায় এই প্রভুত্ব বা জোরটাই আমাদের চালাতে থাকে পদে পদে, সংযোগের অর্থ তখন দাঁড়ায় শুধু প্রচ্ছন্ন সংযোগহীনতা।” আমরা যখন সত্যিকারের সংযোগ চাই, তখন তেমন সব শব্দই খুঁজতে থাকি, শঙ্খ ঘোষের বয়ানে “যা অন্ধের স্পর্শের মতো একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছয়।... সবসময়েই খুঁজে যেতে হয় শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy