ভারতে ফুসফুসের প্রধান অসুখ এবং অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা সিলিকোসিস, কিন্তু দেশে এ সম্পর্কে কোনও বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা নেই। প্রতীকী ছবি।
রহমান মোল্লার মৃত্যুর খবরটা কাগজে এসেছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মিনাখাঁ ব্লকের গোয়ালদহ গ্রামের রহমান, কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন রাঢ়ের পাথর খাদানে। অনেকের মতো বাড়ি ফেরেন বুকে সিলিকোসিস নিয়ে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ঝুলিয়ে চলে কিছু কাল, তার পর চল্লিশ না হতেই— দেশের গড় আয়ুর ত্রিশ বছর আগেই— মৃত্যু। রহমানের মৃত্যু তাঁর নাম খবরের কাগজে তুলে দিল, আরও কারও কারও নামও, যেমন নাসির মোল্লা। কিন্তু তাঁর সঙ্গী সহস্র মজুরের মৃত্যুসংবাদ? সরকারি সূত্র, ডিরেক্টর জেনারেল অব মাইনস-এর দফতর যদিও জানাচ্ছে, “ভারতে ফুসফুসের প্রধান অসুখ এবং অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা সিলিকোসিস”, কিন্তু “দেশে এ সম্পর্কে কোনও বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা নেই।” তদুপরি, “সিলিকোসিস রোগীদের চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির দায়িত্ব ন্যস্ত যে সব দফতরের উপর, তারা ঠিকমতো কাজ করে না।” সরকারি নথি এ-ও বলছে, “সিলিকোসিস সংক্রান্ত আইনগুলোও কদাচ বলবৎ হয়ে থাকে।” সরকারি সংস্থাকে সরকারের দিকটাও দেখতে হয়। অতএব প্রতিরোধ বটিকা: “রোগের প্রকোপ বাড়ার অন্যতম কারণ মজুরদের স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব।”
সরকারি সংস্থা নাহয় মজুরদের সচেতনতার অভাবের কথাই বলবে। কিন্তু, একই কথা কেন বলছে শিক্ষিত সম্প্রদায়, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী বাহিনী? এ রাজ্য রাজনৈতিক ভাবে সচেতন বলে দাবি করে, এখানে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। তা হলে কেন ষাটের দশকে পাথর কারখানা শুরু হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি এখানকার বিপুল অসংগঠিত শ্রমিকদের কোনও সমীক্ষা এখনও হয়নি? এ রাজ্যে অবৈধ স্টোন ক্রাশারের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। এমন সাত লক্ষাধিক মানুষ সিলিকোসিস নিশ্চিত জেনেও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যাঁদের অমোঘ প্রশ্ন, “পাথর না ভাঙলে খাব কী?” অথচ, এঁদের নিয়ে কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।
কেন গড়ে ওঠেনি? অনুমান করা যায়, এক দিকে ভোটের রাজনীতি। সিলিকোসিস আক্রান্তদের সংখ্যা ভোটের ফলকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। এই সূত্র ধরে আসে অন্য এক সন্দেহের কথা: সামান্য কয়েক লক্ষ, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা, সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা না-থাকা এই মজুরদের পক্ষে বলতে গিয়ে মালিকপক্ষের বিরাগভাজন হওয়া কাজের কথা নয়। ভোটের রাজনীতি করতে অর্থের প্রয়োজন, আইন বহালকারীদেরও সংসারে সচ্ছলতা চাই। অনেকে মালিকদের সঙ্গে নানা স্বার্থসম্পর্কেও আবদ্ধ। অতএব এই শ্রমিকেরা হয়ে ওঠেন উন্নয়নের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।
আরও একটা জটিল ব্যাপার আছে। দেহ বাঁচাতে অন্নের সন্ধান, সেই দেহেরই চরম বিনাশ চাপানো হয় তাঁদের উপর। সেটাই আবার তাঁদের সংগঠিত হতে বাধা দেয়। দৈহিক অক্ষমতা তাঁদের প্রতিবাদশক্তি নির্মূল করে দেয়— যাঁরা হাঁটতে চলতে পারেন না তাঁরা লড়াই করবেন কোন শক্তিতে? সিলিকোসিস শুধু দেহেরই না, মনেরও প্রতিরোধ ক্ষমতা বিলুপ্ত করে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার মস্ত যোগ। কিন্তু, তাঁরা প্রতিবাদ করতে পারেন না বলেই তো সমাজের এ বিষয়ে বেশি করে গলা তোলার কথা। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই পরীক্ষায় ফাঁকির দিকেই পাল্লা ভারী।
তা সত্ত্বেও, মানুষ তো লড়েই মানুষ। তাই সিলিকোসিসকে কেন্দ্র করে অসংগঠিত শ্রমিকদের লড়াইটা এ রাজ্যের একটা বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বীরভূম, ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিলিকোসিস নিয়ে সংগঠিত প্রতিস্পর্ধা গড়ে উঠেছে। প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান বিক্ষোভ, মিছিল, ডেপুটেশন চলছে। অসুস্থদের সঙ্গে একযোগে লড়াই করছেন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সহযোগীরা, গ্রামে ফিরে আসা সুস্থ শ্রমিকেরা। স্বভূমিতেই থেকে যেতে পেরেছেন যে গ্রামবাসীরা, তাঁরাও আন্দোলনের বড় শক্তি। এঁরা সবাই মিলে গড়ে তুলেছেন ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’। চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি এঁরা পরিবেশ বাঁচাও, ষোলো বিঘা বস্তি বাঁচাও কমিটি, জমিহারা কমিটি, কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মতো সংগঠন ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে। প্রায়ই আক্রান্তরা শারীরিক ভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন না, তাঁদের সহজীবীরাই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এর ফলে মানবাধিকার কমিশন এবং আদালতেরও অনেকটা সক্রিয়তা দেখা গিয়েছে, আন্দোলনকে যা আরও জোরালো করে তুলছে। আদালতের ক্রমাগত বিধানের ফলস্বরূপ অতি সম্প্রতি সরকার থেকে একটি সিলিকোসিস নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এই নীতি কার্যকর করতে এবং একে আরও প্রসারিত করতে সরকার কতখানি সক্রিয় হবে, তা নির্ভর করছে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর। সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকেরা লড়াইটা শুধু নিজেদের জন্যই নয়, করছেন আগামী প্রজন্মের জন্যও। তাঁদের এই সংগ্রাম একটা আলোকরেখা। আমরা তা দেখতে না পেলে সে আমাদের অন্ধত্ব, তার ফলও ভোগ করতে হবে আমাদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy