ভাইরাল হল একটি দৃশ্য। ভোপালে একটি ছোট ছেলে ফুড ডেলিভারি বাক্সের উপর মন দিয়ে লিখছে— ‘খুশ রহিয়ে’। এমনই ছবি আমাদের রাজ্যেও। ছোট্ট ছেলে শুভেচ্ছা কার্ড এঁকে দিচ্ছে খাবারের বাক্সের সঙ্গে। বাক্সরা যাবে করোনায় আক্রান্ত, নিভৃতবাসীদের কাছে। দু’ক্ষেত্রেই বাচ্চাটির মা-বাবা কোভিড আক্রান্তদের বাড়িতে খাবার সরবরাহ করেন।
এমনই শয়ে শয়ে সংস্থা, বেসরকারি উদ্যোক্তারা কোভিড আক্রান্তদের খাবার সরবরাহ করছেন। অধিকাংশই স্বল্প বা বিনামূল্যে। খুব সাবধানে করোনা আক্রান্তকে খাবার পৌঁছে দিতে হয়। অনেক সময় দরজায় উঠে আসারও সামর্থ্য থাকে না রোগীদের। তাই নিরাপদ দূরত্বে দরজার বাইরে খাবার রেখে নয়, বহু ক্ষেত্রে নিজেদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও অসুস্থের নাগালে খাবার পৌঁছনোর চেষ্টা করতে হয়। কেউ কেউ অস্বীকারেরও চেষ্টা করেন যে, তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। জোগানদাতার কাছে তা বিপজ্জনক, সংক্রমণের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায়।
কোভিড নামের সঙ্গে যুক্ত অস্পৃশ্যতার দায়ভার তো থেকেই যাচ্ছে। রোগীদের খাবার পৌঁছবার দায়িত্ব নিলে, সংক্রমিত না হলেও চার পাশের মানুষজনের থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। বোঝানো সম্ভব হয় না, আক্রান্তদের খাবার সরবরাহের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এবং শর্ত হিসেবে স্পর্শবিবর্জিত থাকতেই হয়। অ্যাপের মাধ্যমে খাবার আনার চেষ্টায় সমস্যা আরও প্রকট। যে অ্যাপের মাধ্যমে যখন তখন খাবার আনিয়ে আনন্দ করা যায়, দূরত্ব বা লকডাউনের কারণে কোভিড আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সেই অ্যাপের সাহায্য পাওয়াই দুষ্কর। তথ্য গোপন করা ছাড়া অনেকের কাছেই উপায় থাকে না। কোভিড আক্রান্তের বাড়িতে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন— অ্যাপের সরবরাহকারীদের আবার তা জানালেও মুশকিল। যদিও অনেক সময়ই সংস্থার আশ্বাস, স্পর্শবিবর্জিত পদ্ধতিতে আক্রান্তের বাড়ি খাবার পাঠাতে তাঁরা রাজি।
খাবার বাড়ির বাইরে রেখে আসা, রোগীকে বলে রাখা যে, সরবরাহকারী না যাওয়া পর্যন্ত দরজা খুলবেন না ইত্যাদি সতর্কতা স্বেচ্ছাসেবকেরা পালন করেন। তবুও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেকে গোপনীয়তা রক্ষা করেই খাবার পৌঁছে দেন, অনেকেরই সংবেদনশীলতা কম। আক্রান্ত বয়স্ক মানুষ রঙিন প্যাকেটে খাবার পাঠাতে বলেন, যাতে পাড়া বা আবাসনবাসীরা বুঝতে না পারেন যে নিয়মিত খাবার আনাতে হচ্ছে। কারণ, সেই কোভিড সংক্রান্ত অস্পৃশ্যতার ভয়। এক বৃদ্ধা কোভিড আক্রান্ত হলে তাঁর মেয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে যোগাযোগ করে গোপনীয়তা বজায় রেখে খাবার পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। সরবরাহকারী তিন তলায় উঠে আক্রান্তের বন্ধ দরজার সামনে খাবার রাখতে রাজি হন না। বৃদ্ধ স্বামীকে নীচে আসতে হয়। চেঁচামেচিতে সবাই জেনে যায় যে, পরিবারটিতে করোনার ছাপ পড়েছে। লোক জানাজানির ভয়ই সত্যি হয়। খাবারের প্যাকেট হাতে মাথা নিচু করে উঠে যান বৃদ্ধ। তাঁর অপরাধ, স্ত্রী কোভিড আক্রান্ত এবং এই পরিস্থিতিতে তিনি খাবার আনাতে বাধ্য।
মুদ্রার অন্য পিঠও থাকে। আক্রান্ত পরিবার ধীরে ধীরে সেরে ওঠে। তাঁদের প্রশ্ন, ডিম থালি সয়াবিন থালির পথ্য নয়, অল্প ঝালমশলা দিয়ে মাংসের ঝোল করে দেওয়া সম্ভব? নিভৃতবাস শেষের আনন্দ ফোনের ও-পার থেকেই ছুঁয়ে যায়।
ভীষণ বিপদের মুখে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়াই আমরা। হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করি। না হলে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খাবার নিয়ে ছুটত না গাড়ি, বাবা-মায়ের সঙ্গে খুদেরাও ঝাঁপিয়ে পড়ত না কাজে। একেই রেবেকা সোলনিট আ প্যারাডাইস বিল্ট ইন হেল বইতে ‘আনন্দের চেয়েও গভীরতর এক সদর্থক অনুভূতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। পাঁচটি মহামারি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (যেমন ১৯০৬-এর সান ফ্রান্সিসকোর ভূমিকম্প, ২০০৫-এর হারিকেন ক্যাটরিনা) ক্রমান্বয় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এমন মারাত্মক বিপর্যয়ের সামনে— বিশেষত যখন প্রশাসন সম্পূর্ণ সহায়ক হতে পারছে না— তখন বার বারই একক বা দলবদ্ধ ভাবে বিপর্যয় মোকাবিলায় ঝাঁপিয়েছেন সাধারণ মানুষ। রেবেকা দেখিয়েছেন, এই কথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। টমাস পেনের রাইটস অব ম্যান বইতে মানুষের এই ব্যবহারের উল্লেখ আছে। অন্য সময়ে কিন্তু একই মানুষজনের এই রকম সদর্থক প্রবণতা, সবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা দেখা যায়নি। কিন্তু কী আশ্চর্য, মহামারি সামনে এলেই তাঁরা অন্য মানুষ!
তাই রোগীকে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করবে যুবকরা, কোথায় কার বাড়িতে সাহায্য দরকার খবর দেওয়ার জন্য অতন্দ্র থাকবে নিন্দিত সমাজমাধ্যম, ঝুঁকি আর অপবাদ অগ্রাহ্য করে রোজ সকালে কোভিড আক্রান্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার খাবার তৈরি হবে রান্নাঘরে।
অন্য সময়, হৃদয়হীন হয়ে মুখ ঘোরানো শহর, তার রক্ত গড়িয়ে চলা হৃদয়কে নিয়ে, মৃত্যুর মিছিলকে নিয়েই প্রস্তুত হবে আর এক ঝড়ের জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy