লাটিন আমেরিকার যে সব দেশে বামপন্থীরা ক্ষমতায়, সেখানেও সংসদে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি রীতিমতো প্রবল। প্রতীকী ছবি।
গোটা দুনিয়ায় সাধারণ মানুষ কেন উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছে, এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। ধনী দেশ-দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমেরিকায় ট্রাম্প জমানা থেকে শুরু করে রিপাবলিকান দল, ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের সমর্থক গোষ্ঠী খুবই শক্তিশালী। ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন এবং জার্মানিতে নব্য নাৎসি-প্রভাবিত এএফডি প্রধান বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইটালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডে এখন উগ্র দক্ষিণপন্থীদের শাসন চলছে। এমনকি সুইডেনেও সরকারের প্রধানতম সমর্থক এক নব্য-নাৎসি দল। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে তুরস্কতে এর্দোয়ান, ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায়। ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থীরা লুলা দা সিলভার কাছে হারলেও তাঁদের নেতা বোলসোনারো পেলেন ৪৯.২% ভোট। লাটিন আমেরিকার যে সব দেশে বামপন্থীরা ক্ষমতায়, সেখানেও সংসদে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি রীতিমতো প্রবল। কেন এই ধরনের রাজনীতির প্রসার, আমার নতুন বইয়ে (আ ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিয়োরিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২২) সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি।
অনেকে বলেন যে, দুনিয়া জুড়ে আর্থিক অসাম্য এত বাড়ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণপন্থীদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। অথচ, দক্ষিণপন্থী নেতাদের অনেকেই বহু হাজার কোটি ডলারের মালিক— ট্রাম্প, ল্য পেন, অরবান, এর্দোয়ান, মাইকেল ফারাজ প্রত্যেকেই। নরেন্দ্র মোদী নিজে এত ধনী না হলেও তাঁর ওঠাবসা এমন কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যাঁরা দুনিয়ার ধনীতম মানুষের তালিকাভুক্ত। দক্ষিণপন্থী নেতাদের আর্থিক নীতিও ধনীদের অনুকূল— ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদী ভারতে কর্পোরেট কর যতটা কমিয়ে দিলেন, টাকার অঙ্কে তা ভারতের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের প্রায় অর্ধেক। ভারতে পরিবেশবিধি শিথিল করে জনজাতিদের চরম স্বার্থহানি করে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কতিপয় বিশেষ শিল্পপতিকে। এর পরও কি গরিব মানুষের তাঁকে সমর্থন করার কথা? মানুষ কিন্তু করছে। আমার মনে হয়, মানুষ অসাম্য নিয়ে ততখানি মাথা ঘামায় না, যতখানি চিন্তা করে চাকরি বা পরিবারের ভাত-কাপড়ের সংস্থানের নিরাপত্তা নিয়ে। গোটা দুনিয়াতেই দক্ষিণপন্থী নেতারা সেই সংস্থানের লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
তবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পিছনে সাধারণ, গরিব মানুষের সমর্থনের কারণটি যতখানি অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার অভাবপ্রসূত। প্রথমে আর্থিক অনিশ্চয়তার কথা বলি— চাকরির নিরাপত্তা নেই, আয়ের নিরাপত্তা নেই। এক দিকে উৎপাদনের কাজ চলে যাচ্ছে চিনে, অন্য দিকে অটোমেশন আর স্বয়ংক্রিয় রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। ইউরোপের এগারোটি দেশে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁদের রুজিরুটিতে ভাগ বসাচ্ছে রোবটিক্স, চরম দক্ষিণপন্থী দলকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের ক্ষেত্রে বেশি। এখানে অবশ্য একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক— আর্থিক বিপন্নতার তো মানুষকে বামপন্থার দিকে ঠেলার কথা, এ ক্ষেত্রে উল্টোটা হচ্ছে কেন?
এই প্রশ্নের প্রথম উত্তর হল, বামপন্থীরা যে সব নীতির পক্ষে সওয়াল করতেন, বহু ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী নেতারা সেই নীতি আত্তীকরণ করেছেন। এর্দোয়ান শ্রমিকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বলেন। ভারতে নরেন্দ্র মোদী গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনাকে ‘কংগ্রেসের ব্যর্থতার সৌধ’ বলেও তাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন, খাদ্য নিরাপত্তা আইন বজায় রেখেছেন; সেই সঙ্গে যোগ করেছেন স্বচ্ছ ভারত, উজ্জ্বলা যোজনা। সামনের ভোটের আগে ‘হর ঘর নলসে পানি’-র প্রচারও তুঙ্গে উঠবে। আগেকার দক্ষিণপন্থীদের তুলনায় আজকের দক্ষিণপন্থী নেতারা রাষ্ট্রের ভূমিকায় অনেক বেশি বিশ্বাসী। তবে, রাষ্ট্রের যে ভূমিকাকে বামপন্থীরা ‘মানুষের অধিকার’ বলতেন, দক্ষিণপন্থীরা সেটাকেই নেতার দয়া বা অনুগ্রহ হিসাবে দেখান। ভারতের কথাই যদি ধরি, কংগ্রেসের শত দোষ থাকলেও তারা মানুষকে অধিকারসম্পন্ন ‘নাগরিক’ বলে মনে করত, বিজেপি তাদের বশংবদ প্রজা মনে করে, তাদের ‘কর্তব্য’-র কথা সর্বদা মনে করিয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, দুনিয়া জুড়েই বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের জোর কমেছে। উন্নত দেশগুলির পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৮৫ সালের তুলনায় আজ শ্রমিক সংগঠনগুলির সদস্যসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়েছে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় এই সংগঠনগুলির বড় ভূমিকা ছিল। ট্রেড ইউনিয়ন কেন দুর্বল হল, তার অনেক কারণ আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পর্যায়ে উন্নত দেশগুলিতে বড় শিল্পসংস্থাগুলির এক ধরনের একচেটিয়া ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতা থেকে যে উদ্বৃত্ত আয় হত, ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে তার একটা অংশ শ্রমিকদের কাছেও পৌঁছত। এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাড়ায় সেই সংস্থাগুলির বাজারের উপর দখল কমেছে। উদ্বৃত্তের পরিমাণও কমেছে। পুঁজিপতিরা এখনও নিজেদের লাভের অঙ্কটুকু বুঝে নিচ্ছেন— রাষ্ট্রই তাঁদের সেই ব্যবস্থা করে দেয়, নয়তো তাঁরা পুঁজি নিয়ে দেশান্তরি হওয়ার হুমকি দেন— কিন্তু, শ্রমিকরা আর কোনও উদ্বৃত্তের বখরা পান না। যে-হেতু শ্রমিক সংগঠনগুলি তাঁদের উদ্বৃত্তের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, ফলে শ্রমিকরাও আর এই সংগঠনগুলিকে গুরুত্ব দেন না। অন্য দিকে, মূলত স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরাই ছিলেন শ্রমিক সংগঠনের প্রধান সদস্য। আজকের প্রযুক্তির জগতে অতি দক্ষ শ্রমিকদের গুরুত্ব বাড়ছে, অকুশলী শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের ফারাকও বিস্তৃততর হচ্ছে। দুনিয়া জুড়েই শ্রমিক সংগঠনের মূল জোরের জায়গা ছিল পণ্য উৎপাদনক্ষেত্র আর পরিবহণ। আজকের অর্থব্যবস্থায় এই দু’টি ক্ষেত্রের গুরুত্ব তুলনায় কমেছে, পরিষেবাক্ষেত্রের গুরুত্ব বেড়েছে। পরিষেবাক্ষেত্রের শ্রমিকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন, তাঁদের সংগঠিত করা মুশকিল। ভারতের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র-প্রধান দেশে তো বটেই, উন্নত দুনিয়াতেও এখন যাকে বলে গিগ ইকনমি, তার অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে।
কিন্তু, আর্থিক অনিশ্চয়তার থেকেও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বেশি সহায়ক হয়েছে মানুষের সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তা। ইউরোপে শরণার্থী সঙ্কট তেমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে— স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির শরণার্থীরা এলে তাঁদের সনাতন সংস্কৃতির ক্ষতি হবে। এই অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগাচ্ছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে নতুন বিদ্বেষ তৈরি করছে। ভারতের উদাহরণ তো আছেই, এখানে অস্ট্রিয়ার একটা উদাহরণ দিই। সম্প্রতি সেখানকার এক নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের ইতিহাস তুলে আনল। মানুষকে মনে করিয়ে দিল, সেই সময় অটোমানরা ভিয়েনার আশপাশের কিছু অঞ্চলে বিধ্বংসী আক্রমণ করেছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, দক্ষিণপন্থীরা যে জায়গাগুলোর কথা তাঁদের প্রচারে উল্লেখ করেছিলেন, সেখানে তাঁদের সমর্থনে ভোটের অনুপাত বেড়েছে। কয়েক বছর আগেও কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও বিভেদ ছিল না। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে ভিত্তিহীন ভয় উস্কে দেওয়ার রাজনীতিও করে চলেছে দক্ষ ভঙ্গিতে। ভারতে যেমন প্রচার করা হয় যে, মুসলমানরা, যারা দেশের ১৫ শতাংশ, দ্রুত জনসংখ্যা বাড়িয়ে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে। কথাটা নেহাত পাটিগণিতের হিসাবেই প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধর্মের চেয়েও মাতার শিক্ষাস্তরের উপর নির্ভরশীল, কেরলে মুসলমান নারীদের প্রসবের হার উত্তরপ্রদেশে হিন্দু নারীদের প্রসবের হারের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এ সব কথা বলে না। ইউরোপে শরণার্থীদের নিয়েও এমন মিথ্যা প্রচার চলে লাগাতার। সমাজমাধ্যমেও মিথ্যা ও কুৎসার জয়, সেখানেও দক্ষিণপন্থীদের রমরমা।
সামাজিক ভাবে উদারবাদীদের বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থীরা প্রচার চালান যে, তাঁরা সংখ্যালঘু বা শরণার্থীদের তোষণ করেন। নরেন্দ্র মোদী যেমন বারে বারেই ‘খান মার্কেট গ্যাং’-এর কথা বলেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এই অবস্থানটিকে ‘অ্যান্টি এলিট’ বলা চলে, যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ একাত্ম বোধ করেন। দিল্লির ক্ষমতাকেন্দ্রে থাকা মানুষ যেমন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক দূরে, তেমনই ওয়াশিংটন ডিসি বা ব্রাসেলস-এর ক্ষমতাবানদের সঙ্গেও সাধারণ মানুষের দূরত্ব বিপুল। কিন্তু, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধিতা ‘লিবারাল এলিট’-দের প্রতি, আর্থিক এলিটদের প্রতি নয়।
মানুষের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে বামপন্থী রাজনীতিতেও অনেক ফাঁক রয়ে গিয়েছে। সেই রাজনীতি উন্নয়ন কর্মসূচিকে মানুষের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নির্ভর করেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর, আমলাতন্ত্রের উপর— অনেক ক্ষেত্রেই যা দুর্নীতিগ্রস্ত, ফাঁকিবাজ, মানুষের প্রতি সহমর্মিতাহীন। অন্য দিকে, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি তাদের সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। ভারতে সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠনের উদাহরণ দেওয়া যায়। উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলমান দেশেও দক্ষিণপন্থী রাজনীতি বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের কাছে সরাসরি প্রাথমিক পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে। ভারতে জনজাতি অঞ্চলে সরকারি স্কুলে যেখানে শিক্ষক আসেনই না, সেখানে সঙ্ঘ পরিবারের স্কুলে লেখাপড়া হলে তার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পাঠ নিতে মানুষের আপত্তি থাকবে কেন, সেটা ভাবা জরুরি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy