— ফাইল চিত্র।
ফেরিওয়ালাদের ডাক এখনও কবিদের হাতছানি দেয়, এক স্তব্ধ দুপুরে সেই ডাক ভেঙে দেয় দুপুরের নীরবতা, যার রেশ চলে বেশ কিছু ক্ষণ— যেন নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে একটি পাখির ঝাঁক এঁকে দেয় বৃত্তাকার জলের আলপনা। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘ফেরিওয়ালা’ কবিতায় ফেরিওয়ালাদের ডাক কখনও ভুলতে পারেননি কবি— “অনেক কাল আগের কথা। কিন্তু সেই তিন/ ফেরিওয়ালার/ তিন রকমের ডাক এখনও ভুলিনি।” সেই ডাক তাঁকে হারানো গ্রাম এবং শহরের কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা-তে ফেরিওয়ালাদের ডাক শোনা গেছে বার বার, ফেরিওয়ালার ডাক দু’তিন দশক আগেও ছিল শহরের শব্দজগতের অন্যতম অংশীদার। এখনও মাঝেমধ্যে শুনি ফেরিওয়ালার ডাক— আইসক্রিম, ঘটিগরম চানাচুর বা লেপ-তোশক বানানোর ডাক।
তখন ভাবি, ফেরিওয়ালাদের ডাক কি সত্যিই কোনও প্রাণের আহ্বান, কোনও গভীর দ্যোতনার স্বর, কোনও কবিতার হাতছানি, না কি সর্বনিম্ন আয়ের এক মজুরের মৃদু আর্তনাদ? সারা দিন হেঁটে চেঁচিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড়ের নিদারুণ চেষ্টামাত্র? এখনও তাঁদের অস্তিত্ব আমাদের অস্তিত্বে কি অস্বস্তি আনবে না? আমেরিকার বঙ্গ উৎসবে রাখা কলকাতার হাতে-টানা রিকশার সামনে ছবি তুলে অতীত ঐতিহ্যে একটু জারিত হয় প্রবাসী বাঙালি, ভুলে যায় প্রচণ্ড গ্রীষ্মে খালি পায়ে পিচের রাজপথে এক শীর্ণ মানুষের দুই সুখী মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার অমানবিক বাস্তবকে।
এ সব মনে হয় সাম্প্রতিক বয়স্কদের অতীতচর্চা দেখে-শুনে। সে অতীতচর্চার মূল সুরটি হল— আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! বয়স্ক মানুষদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রবেশ করলেই পাবেন অতীতবিলাসীদের বর্তমানচর্চা। যাঁরা একটু লেখালিখি করেন, বড় কাগজ থেকে নিজস্ব ব্লগে, সেখানে সেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সংক্ষিপ্ত কথা আরও বিশদে লেখেন। দুঃখ করেন বর্তমানের গতিপ্রকৃতি দেখে। এই বয়স্করা অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত, দেশ-বিদেশ ঘোরা মানুষ। তাঁরা দুঃখ করেন পাড়ার মুদির দোকান হারিয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে গেল পাড়ার স্টেশনারি দোকান। এতে কারও অর্থনৈতিক ক্ষতি হলে তাঁর দুঃখ হওয়ারই কথা— কিন্তু দোকানদার নন, দুঃখ করছেন তাঁর একদা খদ্দেররা। তাঁরা মনে করছেন, এ এক সামজিক অবক্ষয়— এ সব ছোট দোকান শুধু ব্যবসা (যা ‘শিক্ষিত’ বাঙালির কাছে একটি নিম্ন মানের জীবিকা) নয়, এগুলি সামাজিক যোগাযোগের একটি কেন্দ্র ছিল। আসতে-যেতে ‘দাদা’, ‘কাকু’ বলে ডাক শুনতাম, এ দিক-সে দিকের কথা হত, একটা মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠত। আহা, সে সব উঠে যাচ্ছে, এখন সব বড় বাজার নয় অনলাইন কেনাকাটা, কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ! এই সব দোকানদার এখন কোথায় যাবেন, কী করবেন? আগে ছিল মানুষে মানুষে যোগাযোগ, আহা, আগে আমরা কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।
বেশ লাগে শুনতে, তাই না? যদিও কোনও দিন শুনিনি যে, এই বিত্তবান খদ্দেররা পাড়ার মুদির দোকানকে কখনও অর্থনৈতিক সাহায্য করতেন, বিত্তবান খদ্দেররা নিজেরা চাঁদা তুলে দোকানির মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন ইত্যাদি। শুনিনি, প্রয়োজন না থাকলেও ফেরিওয়ালার জিনিস কিনে তাঁকে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে দেননি কেউ। দোকানিরা সব সময়েই খদ্দেরের সঙ্গে ভাল, মন জুগিয়ে কথা বলেন, তা আপনি যে দলেরই হোক না কেন। সেই মন জোগানো কথা আর শোনা যায় না, কিছু ক্ষণ ফালতু সময় কাটানো যায় না, ফলে কাগজে লিখি সেই সব মানবিক সম্পর্ক আর নেই। আসলে নতুন বড় দোকানে কেউ আর আলাদা করে পাত্তা দেয় না, নিজের সময় নষ্ট করে খেজুরে আড্ডা দিতে চায় না, ফলে ব্লগে লিখি দোকান কি শুধুই কাজের লেনদেন, মানুষে মানুষে সম্পর্কের কোনও দাম নেই? এঁরা মূলত চাকরিজীবী, নিশ্চিত মাইনে, ইনক্রিমেন্ট, ডিএ, পেনশন পেয়ে থাকেন, কিন্তু বাড়ির কাজের মেয়েটি কোনও অধিকারের কথা বললে তাঁকে স্রেফ অন্য কাজ দেখতে বলেন।
এই অতীতবিলাস শুধু কিছু হাহুতাশ নয়, সময় কাটানো বাক্যালাপ নয়, এটিকে মনে করা হয় বেশ একটি সামাজিক দায়িত্ব। এই বিলাস দেখায়, কী ভাবে এই সমাজ অবক্ষয়ে যাচ্ছে— শপিং মল থেকে মোবাইল, অনলাইন কাজকর্ম মানুষকে সামাজিক আবহ থেকে সরিয়ে অমানবিক করে তুলছে। আগের পৃথিবী ছিল অনেক সুন্দর— পাড়া ছিল, সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ ছিল, সবুজ গ্রাম ছিল, মানুষের এত চাহিদা ছিল না— এই বাজার অর্থনীতি, এই যান্ত্রিক অর্থনীতি সেই সুন্দর দিনগুলিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ব্যাধিটি সংক্রামক, তরুণ গায়ক গান গায় ভুলে যাওয়া ডাংগুলি, এক্কা-দোক্কা আর আব্বুলিশের রোমন্থনে।
এ সব গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে গত এক দশকে, হোয়াটসঅ্যাপ নামক আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমটি মোবাইলে আসার পর। চায়ের দোকানের সীমিত আড্ডার বদলে এই হোয়াটসঅ্যাপ আবার মিলিয়ে দিয়েছে আড্ডায় পুরনো বিদ্যালয়ের, অফিসের, কলেজের বন্ধুদের— যাঁদের সঙ্গে অন্যথা এ রকম আড্ডার কোনও সুযোগই হত না। তারও আগে মোবাইল ফোনের মতো একটি বিস্ময়কর বস্তু লোকের হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করার পর বুঝতে পারলাম, মানুষ কত কথা বলতে চায়। পথে, বাসে, ট্রেনে সবাই কথা বলে চলেছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের এত যোগাযোগ আগে ভাবাও যেত না। তবে যে শুনি, মানুষে মানুষে নাকি যোগাযোগ কমে যাচ্ছে? এই লেখকের পরিবারে একটি গল্প চালু ছিল— দুই নারীর ট্রেনে সিটে বসায় কিছু চাপাচাপি নিয়ে বচসা, এক জন কিছুটা বয়স্কা সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা, অন্য জন সবে তরুণী। গত শতকের ত্রিশ দশকের কাহিনি। বচসা চলল, শেষ পর্যন্ত দু’জনেই নামলেন একই স্টেশনে। তার পর সেই বচসা শেষ হল, যখন দু’জনেই জানলেন যে, তাঁরা একই গ্রামের একই বাড়িতে যাচ্ছেন। তার পর কান্নাকাটি— ছোট বোন বড় দিদিকে দেখছে কুড়ি বছর পর, এক দূরের জেলায় বিয়ের পর এই প্রথম দিদি আসছে বাপের বাড়ি। মানবিক যোগাযোগের অবস্থা ছিল এ রকম। আমাদের উদ্বাস্তু পরিবারের আত্মীয়রা অনেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারেই হারিয়ে গেছেন। এখন দেখি বেঙ্গালুরু বাসিন্দা মেয়ে কলকাতায় একাকী মায়ের বাজার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছে অনলাইনে ফোনের মাধ্যমে। একেবারে গৃহবধূরা ফেসবুকে মিতালি পাতিয়ে এক সঙ্গে ঘুরতে বেরোচ্ছে, এমনকি ব্যবসাও শুরু করছে। মনে পড়ে একাকী মেয়ের কথাটি— ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই। এখন মোবাইল হাতে সে তা পারে।
আসলে ভবিষ্যতের ভয় দেখানো কিছুটা সুখী মানুষের বিলাস আর যে-হেতু ভয়ের বিক্রির বাজার ভাল, তা বিভিন্ন মাধ্যমে গুরুত্ব পায় বেশি। বাষ্পচালিত রেল নিয়ে বিভিন্ন ভীতির কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কমিশন রেল চালানো বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছিল। ইলেকট্রিক বাল্বের আলো যে চোখের ক্ষতি করবে, তাও বলা হয়েছিল টাইমস পত্রিকায়। মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে সে ভাবেই অতীতবিলাসীরা লিখে যাচ্ছেন, মোবাইল কী ভাবে নিদারুণ ক্ষতি করে চলেছে শিক্ষায়, ছেলেমেয়েরা কিছুই শিখছে না, মত্ত রয়েছে মোবাইল নিয়েই। অথচ বিদ্যালয়–মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বেশির ভাগটাই আজ অদরকারি, সেখানকার সার্টিফিকেটের পরিচয় কেবল ‘ভদ্রলোক’দের সঙ্গে একাসনে বসে চা খাওয়ার যোগ্যতার বেশি কিছু নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখছি, যে ছেলে বা মেয়েটি বইয়ের পড়া কিছুই বলতে পারে না, সে কিন্তু মোবাইলে দক্ষ। সেই দক্ষতায় সে খবর রাখে কাজের দুনিয়ার, প্রযুক্তির। ইউটিউব দেখে সে শিখে নেয় সাইকেল দিয়ে ধান ভানার উন্নত উপায়, শিখে নেয় গাড়ি সারানোর কাজ। সুন্দরবনে পর্যটনের মরসুমে তিন মাস বোট চালায়, তার পর কেরলে গিয়ে ঢালাই করার মেশিন চালায়— সবই জেনেছে এই প্রযুক্তির যোগাযোগে। আর মেধাবী মেয়েটি আলেকজ়ান্ডারের ভারত জয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে অষ্টম শ্রেণিতেই লিখে ফেলেছে অ্যাপ তৈরির কোড।
পৃথিবীটা দিনে দিনে খারাপ হয়ে যাচ্ছে, পরিবেশ গেল-গেল অবস্থা, মানুষে মানুষে আর প্রাণের যোগ নেই— এ সব বলে সুখী বয়স্করা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। পৃথিবী ধ্বংসের ভয়টা কোনও জ্যোতিষীবাবাজি দেখাননি, গত পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই শুরু করেছিলেন বিশ্বনন্দিত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরা। বলেছিলেন, জনবিস্ফোরণে সারা পৃথিবী, বিশেষত ভারতে, কোটি কোটি লোক না-খেয়ে মরে থাকবে। গত সাত দশকে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে ২৫০ কোটি থেকে হয়েছে ৮০০ কোটি, কিন্তু খাদ্যাভাব বিশেষ কোথাও নেই। আজকের দিনে পথের পাঁচালী-র সর্বজয়াকে অনশনে দিন কাটাতে হত না, রেশন পেয়েই যেতেন। দুর্গার মৃত্যু হত না, স্বাস্থ্যসাথী বা আয়ুষ্মান ভারত তাকে বাঁচিয়ে তুলত। দুর্গা ট্রেনে চেপেই ঘুরে আসত মাঝেরপাড়া স্টেশন পেরিয়ে অনেক দূর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy