—প্রতীকী ছবি।
সহমর্মিতাই হয়তো সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দান। বইয়ের পাতায় আমরা নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি যেমন দেখতে ভালবাসি, তেমনই জেনে নিতে চাই অজানা, স্বল্প-পরিচিত জীবনের গল্প। সাহিত্যই সেতু, তাই আদ্যন্ত শহুরে মানুষ গ্রামজীবনের গল্প পড়ে চোখের জল ফেলে, পুরুষ টের পায় নারীর আলাদা দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে, বামুন-কায়েত নিজেকে নতুন করে চেনে দলিত-সাহিত্য পড়ে। আক্ষেপ, বাংলা সাহিত্যের কোলে এখনও তেমন ভাবে ঠাঁই পায়নি কুইয়র সাহিত্য।
‘কুইয়র’ অর্থাৎ অদ্ভুত। সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জীবন নিয়ে যে সাহিত্য গড়ে ওঠে, তা বিশ্বসাহিত্যে এই নামে পরিচিত। বাংলায় এর পরিভাষা তৈরি হয়নি, তা আশ্চর্য নয়— যা আলোচনায় আসে না, তা ভাষাতেও আসে না। বাংলা মূলধারার সাহিত্যে শহুরে, উচ্চবর্ণ হিন্দু পুরুষের আধিপত্য, তাদের মূল্যবোধ ও জীবনচর্যাই তার অবলম্বন, এই অভিযোগ নতুন নয়। তবে বহু দশক ধরে এর বিপ্রতীপে বাংলায় কলম ধরছেন শক্তিশালী লেখকরা। ১৯৩৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত আশাপূর্ণা দেবীর ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ ছোট গল্প দিয়ে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত পূজাবার্ষিকী-সাহিত্যে, নারীভুবনের যে জয়যাত্রার সূচনা হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত। অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম থেকে শুরু করে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আত্মজীবনী ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন দলিত-জীবন সম্পর্কে শহুরে বাঙালির চোখ খুলে দিয়েছে। সম্প্রতি দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যা সাহিত্যের এই ধারাটিকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করছে।
তুলনায় ব্রাত্য কুইয়র সাহিত্য। অথচ, এমন হওয়ার কথা ছিল না। শহর বা গ্রাম, উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত, বাঙালির জীবনে সমকামিতা-উভকামিতা-রূপান্তরকামিতা ছিল না বা নেই, তা তো নয়, তা হলে এত বছরে সেই জীবনের ব্যাখ্যান সাহিত্যে এত নগণ্য কেন? বাংলা সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো কম হয়নি। নানা সময়ে দাদাবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা পর্যন্ত অনেক কিছু গ্রহণ করেছে। সাহিত্যের রুচিতে বাঙালি থাকতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক। তা হলে কুইয়র সাহিত্যে সে পিছিয়ে থাকল কেন, যেখানে ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের কথা বলা এখন অতি পরিচিত হয়ে উঠেছে?
একটা কারণ হতে পারে ভারতীয় সমাজের সমকাম-বিদ্বেষ। খোলাখুলি সমকামী-রূপান্তরকামী জীবন নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো লেখকের উপর নেমে আসবে সামাজিক হিংসা-হেনস্থা, তিনি নিজে ভিন্ন যৌনতার মানুষ হন বা না হন। এটা বোঝা যায়, তবু বিস্ময় ঘোচে না। ভারতেরই অন্যান্য প্রদেশে তো নিজেদের সমকামী, বা রূপান্তরকামী পরিচয়কে নিজের জীবনকথায়, কবিতায় বা গদ্যে প্রকাশ করছেন অনেক সাহিত্যিক। এর ইতিহাসও দীর্ঘ। ১৯২৭ সালে পান্ডে বেচন শর্মা (উগ্রা)-র গল্পগ্রন্থ চকলেট প্রকাশ পেয়েছিল, যার প্রত্যেকটি গল্প সমলিঙ্গের প্রেম নিয়ে। ১৯৪২-এ ইসমত চুগতাইয়ের বিখ্যাত গল্প ‘লিহাফ’ প্রকাশিত হতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কমলেশ্বরের এক সড়ক সাতভা গলিয়াঁ (১৯৫৬) বা কমলা দাসের আত্মজীবনী এন্তে কথা (১৯৭৩), বিজয় তেন্ডুলকরের মরাঠি ভাষার নাটক মিত্রোচি গোস্তা (১৯৮১)— দৃষ্টান্ত কম নয়। ইংরেজি নাট্যসাহিত্যে মহেশ দতানির ডান্স লাইক আ ম্যান (১৯৮৯) পৌরুষের প্রচলিত ধারণাকে আঘাত করে শোরগোল ফেলেছিল। হোয়্যার ডিড আই লিভ মাই পর্দা (২০১২) অবধি তিনি ক্রমাগত লিখে গিয়েছেন ভিন্ন লিঙ্গ ও যৌনতার কথা। নানা ভাষা, নানা দেশের ভিন্ন যৌনতার রচনা অনুবাদ করে কিছু সঙ্কলনও হয়েছে।
এমন নয় যে বাংলা সাহিত্যে সমকামী, অথবা রূপান্তরকামী মানুষদের কথা একেবারে আসেনি। নবনীতা দেব সেন-এর বামাবোধিনী, তিলোত্তমা মজুমদারের চাঁদের গায়ে চাঁদ, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ কিংবা কমল চক্রবর্তীর ব্রহ্মভার্গব পুরাণ-এর কথা। তথ্যনির্ভর বইয়ের মধ্যে নিলয় বসু ও অজয় মজুমদারের ভারতের হিজড়ে সমাজ, পুরুষ যখন যৌনকর্মী বইগুলি রয়েছে। মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনীগ্রন্থ আমার অর্জিত নারীত্ব বাংলা কুইয়র সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। সম্প্রতি নীলাদ্রি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদে পেলাম কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের চমৎকার গদ্যসাহিত্যকে (এন্টারিং দ্য মেজ়), যা খোলাখুলি সমকামী জীবনের কথা ব্যক্ত করে।
লিঙ্গ-যৌনতা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কেবল কুসংস্কার আর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের জন্য অনালোচিত থাকবে, সাহিত্যের মঞ্চে ঝাঁপিয়ে এসে পড়বে না— এটা মেনে নেওয়াও কঠিন। একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ-ব্যথার কথা সাহিত্যের সূত্রে আমরা কেন টের পাব না, সেই প্রশ্ন আজ করতে হবে। হাতেগোনা বই দিয়ে সাহিত্যের কোনও ধারা গড়ে উঠতে পারে না। তবে কি বাংলার সম্পাদক-প্রকাশকদের মধ্যে কোথাও সমকাম-বিদ্বেষ কাজ করছে, ভিন্ন যৌনতার মানুষদের নিয়ে কাজ করতে তাঁরা অস্বস্তিতে? প্রশ্নটা জরুরি, কারণ সমকামিতা-রূপান্তরকামিতার যাপন যাঁদের নেই, যাঁরা এ-জীবন বাইরে থেকে দেখেছেন, তাঁরা এ-সাহিত্য গড়ে দেবেন, তা হয় না। যে কোনও সাহিত্যিক তাঁর সহানুভূতি, সমানুভূতি দিয়ে যে কোনও ধর্ম, জাতি, লিঙ্গের মানুষের অন্তস্তল ফুটিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, নারী, দলিত, মুসলিমের নিজের কণ্ঠস্বর বাংলা সাহিত্যের আসরে যত শক্তিশালী হয়েছে, তত তা সমৃদ্ধ, প্রাণময় হয়েছে। প্রাণ পেয়েছে সমাজও। সাহিত্যের মহাযজ্ঞে এ বার ভিন্ন যৌনতার মানুষদের সাদর আমন্ত্রণ করুন প্রকাশক-সম্পাদকরা। বইমেলার এই মরসুমে তার সূচনা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy