কখনও দূষিত স্যালাইন, কখনও জাল ওষুধ, কখনও চিকিৎসার গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু, কখনও পরিকাঠামোর অভাবে পরিষেবা দিতে না পারা ডাক্তারকে রোগীর পরিবারের তরফে মারধর, হাসপাতাল ভাঙচুর, আবার কখনও ক্ষমতার দখল নিয়ে ডাক্তারদের রাস্তায় নেমে মারামারি। স্বাস্থ্যে এমন অস্বাস্থ্যকর অধ্যায়ের জন্ম হয়েছে বার বার। হইচই, গোলমাল, তদন্ত হয়েছে। কিন্তু সুরাহা হয়নি।
আর জি কর আন্দোলন হালে সব কিছুকে ছাপিয়ে একটা গণ-আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাস্থ্যে শুদ্ধির দাবি নতুন নয়। স্বাস্থ্যের মতো একটি বিভাগ, যেখানে বরাদ্দ বেড়েছে, হাসপাতাল বেড়েছে, শয্যা বেড়েছে, ডাক্তার বেড়েছে, প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেমন যেন অনাথ হয়েই থেকে গেছে এই দফতর। মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে রেখে এর আপাত গুরুত্ব বাড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নিয়মিত নজরদারির কেউ নেই। তাই যা খুশি করে পার পাওয়ার ছাড়পত্র রয়েছে, এমন বার্তাও রটেছে চার দিকে। অধুনা স্বাস্থ্যে প্রায় প্রকাশ্যেই তৃণমূলের দু’টি আলাদা শিবির হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতির চাঁইদের অনেকেরই সাহস বেশ খানিকটা বেড়ে গিয়েছে। হয়তো, যে কোনও একটি শিবির ধরে রাখতে পারলেই নিরাপত্তা নিশ্চিত, এই আশ্বাস জন্মেছে তাঁদের অনেকের মধ্যেই।
কিন্তু কেন স্বাস্থ্যের এমন বেহাল দশা হল? তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর যে ক’টি বিভাগের হাল গোড়াতেই ফিরতে শুরু করেছিল, স্বাস্থ্য তো তারই অন্যতম। খোদ মুখ্যমন্ত্রী যেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সেখানে তো অন্য রকমও কিছু হতে পারত। প্রবীণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্তারা অনেকেই বলছেন, একনায়কত্বের এই পরিস্থিতিই সমস্যার অন্যতম কারণ।
সেটা কেমন? একটা ছোট্ট উদাহরণ। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে কলেজ কাউন্সিল থাকবে। কিন্তু তারা স্বাধীন ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সবটাই সরকারকে জানাতে হবে। নবান্নে অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকে তখন হাজির স্বাস্থ্য সচিব এবং বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা। আর জি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তত দিনে বিভিন্ন কলেজে হুমকি প্রথায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। বৈঠকে আচমকাই তিরস্কৃত হলেন আর জি করের অধ্যক্ষ। অপমানিত, তিরস্কৃত হওয়ার ভয়ে কোনও অধ্যক্ষ বলে উঠতে পারেননি, সবই যদি সরকারকে জানিয়ে করতে হবে, তা হলে কলেজ কাউন্সিল রাখার প্রয়োজনটা কী?
দীর্ঘ স্বাস্থ্য-সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার সুবাদে দেখেছি, বিভাগের কোনও সিদ্ধান্ত, কোনও প্রকল্প, এমনকি নিজেদের সাফল্যও চিকিৎসকেরা বলতে সাহস পান না। পাছে মুখ্যমন্ত্রী রেগে যান! “যা বলার উনিই বলবেন।” কিন্তু যে কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক প্রশাসনের মূল শর্তই তো হওয়া উচিত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া যে সমস্ত কাজের ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন না, তা তো নয়। তা হলে সেটা অস্বীকার করা কেন?
যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তিনিই স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী। কতটা সময় তাঁর পক্ষে দফতরের কাজে ব্যয় করা সম্ভব? তাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া কোথাও একটা পাতাও পড়বে না, এমনটাই প্রশাসন চালানোর নীতি ও লক্ষ্য স্থির করে রেখেছেন মমতা। ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। একই সঙ্গে এত গুরুদায়িত্ব সামলাতে গিয়ে ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রবীণ চিকিৎসকদের অনেকেই বলেন, ঠিক যে ভাবে বাম আমলে ‘পাওয়ার কাট’-এর ভয়াবহতা কাটাতে শঙ্কর সেন মাঠে নেমেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন, সে ভাবেই স্বাস্থ্যে কোনও শঙ্কর সেনের কথা কেন ভাবা হবে না? কোনও দক্ষ চিকিৎসকের হাতে যদি স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব যায় তা হলে তিনি হয়তো বিষয়টির গভীরে ঢুকে তা পরিচালনা করতে পারবেন। শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মেডিক্যাল কলেজ বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নয়, প্রকৃত পরিষেবা বাড়ানোর কথা ভাবতে পারবেন।
যদিও এ কথা ঠিক, চিকিৎসক হলেই তিনি দফতর চালানোর ক্ষেত্রে সফল হবেন, তা না-ও হতে পারে। সূর্যকান্ত মিশ্র চিকিৎসক হয়েও সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন না। বাম আমলে শেষ ১০ বছর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বহু কিছুই কার্যত স্তব্ধ ছিল।
কিন্তু সংখ্যার বিচারে এগিয়ে থাকাই যে সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়, তা মানতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে কথা বলার সময়ে হামেশাই সংখ্যায় এগিয়ে থাকার তৃপ্তি যে ভাবে ফুটে ওঠে তাঁর প্রতিটি কথায়, তার আড়ালে চাপা পড়ে যায় রোগীস্বার্থের আসল উদ্দেশ্যটাই।
স্বাস্থ্যে বদল আনতে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন মমতা। কিন্তু সেই বদল ধরে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আর এ জন্য এক জন দক্ষ ‘ফুল টাইম মন্ত্রী’ প্রয়োজন। প্রয়োজন এমন সেনাপতি, যিনি মেরুদণ্ড সোজা রেখে মুখ্যমন্ত্রীকে সাদা-কালোর তফাত বোঝাবেন।
স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে অনেক কমিটি গড়েছেন তিনি। কিন্তু সেই কমিটি তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য, নিজেদের বক্তব্য জানানোর জন্য তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পায়নি। অজস্র নয়া প্রকল্প চালু করেছেন। কিন্তু সেই প্রকল্পের পথে কী কী বাধা আসছে, কী ভাবে প্রকল্পগুলি আরও এগিয়ে নেওয়া যায় সে নিয়ে আলোচনার জন্য স্বাস্থ্যকর্তারা তাঁর সময় চেয়েও পাননি। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ গোটা রাজ্যের গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে। কত জনকে, কত বিষয়ে সময় দেবেন তিনি? এ ক্ষেত্রে নিজের কাঁধ হালকা করার কাজটা তো তাঁকেই করতে হবে।
স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকেই আড়ালে আক্ষেপ করেন, মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা পান না, অথচ স্বাধীন ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। নিলে কখন যে রোষদৃষ্টিতে পড়তে হবে, তাঁরা জানেন না!
বরাদ্দ বাড়াচ্ছেন তিনি। কিন্তু যত ক্ষণ ভিতরের শক্তপোক্ত শিকড় গাড়া দুর্নীতিকে নির্মূল করা না যায়, তত ক্ষণ বরাদ্দ বাড়িয়ে লাভ কী? বাম আমলেও স্বাস্থ্যে দুর্নীতি ছিল ভয়াবহ রকমের। কিন্তু সেখানেও এমন অবস্থা ছিল না যে টাকা ছাড়া কার্যত একটা ফাইলও নড়বে না। যে সৎ আধিকারিক, সৎ প্রশাসক, সৎ চিকিৎসকেরা রয়েছেন তাঁরা ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছেন। নিজেদের নিঃশব্দে সরিয়েও নিচ্ছেন অনেকে। অনেকে হতাশ, বিরক্ত, দায়িত্বে থাকতে বা বড় দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক।
স্বাস্থ্যে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আলাদা সংগঠন গড়ে আরও ভুল হল। এতে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উল্টে হুমকি প্রথার বাড়বাড়ন্ত যাঁদের কারণে, তাঁদের দাপট আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। যাঁরা সত্যিই কাজ করতে চান, তাঁদের কাছে ভুল বার্তাও পৌঁছবে।
অতীতে বার বার দেখা গেছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কোনও বিপর্যয় সামলাতে গিয়ে বিপর্যয়ের নেপথ্যের কারণ খুঁজে বার না করে সফট টার্গেট বেছে নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হয়েছে। জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল খাইয়ে জ্বর কমানোর পক্ষপাতী থাকতে দেখা গিয়েছে প্রশাসনকে, জ্বরের আসল কারণ নির্ণয়ে নয়। এখনও বিক্ষোভ, প্রতিরোধ সামাল দিতে একের পর এক সংগঠন গড়া হচ্ছে। কিন্তু আসল কারণ খুঁজে বার করে তা প্রশমনের চেষ্টা হচ্ছে না। সামান্য প্রতিবাদ এলেই তাঁদের বিরোধী তকমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কার দোষে মানুষের শরীরে ঢুকছে দূষিত স্যালাইন বা মেয়াদ ফুরোনো ওষুধ, কার্যকারিতাহীন ওষুধ-ইনজেকশনের বরাত দিয়ে সরকারি টাকা নয়ছয় করছে কারা, অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে কোটি কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে কাদের পকেট ভরতে, কাদের মদতে সরকারি হাসপাতালে চলছে দালালচক্র, কোন স্পর্ধায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে না দেখে চিকিৎসক চলে যাচ্ছেন প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে, কী ভাবে চলছে পোস্টিং কেনা-বেচা, এই সব কিছুর শুধু উত্তর জানলে চলবে না। দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষকে তা জানাতে হবে।
আর জি কর আন্দোলন কোনও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর চলে আসা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সূত্রে বেরিয়ে এসেছে মানুষের অনাস্থা, অবিশ্বাস। আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছেন ভেবে তাঁর কিন্তু স্বস্তিতে থাকার উপায় নেই। ক্ষোভ কিছুটা চাপা পড়েছে মাত্র, মুছে যায়নি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)