প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
লক্ষ্মী স্বভাবতই চঞ্চলা। বিশ্বকর্মা কি তুলনায় স্থিতিশীল? বিশ্বকর্মার স্থানিকতা সুনিশ্চিত করে লক্ষ্মীলাভের আরাধনার আর এক নামই তো ‘শিল্পনীতি নির্ধারণ’। অতিমারি-উত্তর সময়ে বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক শিল্পবিকাশের ভাবনায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে গোটা পৃথিবী জুড়েই। শিল্প ভুবন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে স্বাগত জানাতে চলেছে। তার এক দিকে রয়েছে তথ্যের ব্যবহার— কৃত্রিম মেধা থেকে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’; অন্য দিকে উন্নয়নকে ‘সাস্টেনেবল’ বা সুস্থায়ী করার চাহিদা। এই মহাযজ্ঞে যোগ দিতে গেলে প্রয়োজন শিল্পভাবনায় আমূল পরিবর্তন।
আর্থিক বৃদ্ধির তত্ত্বের দিক থেকে দেখলে, এই শিল্প বিপ্লবের দু’টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। একটা সময় অবধি বিশ্বাস ছিল যে, কোনও অর্থব্যবস্থায় আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হল সঞ্চয়ের হার এবং সেই সূত্র ধরে মূলধন গঠনের হার। কিন্তু পরবর্তী কালে সেই ধারণা পাল্টেছে। সেই জায়গা নিয়েছে কোনও দেশে ‘ইনোভেশন’ বা উদ্ভাবনের হার— প্রযুক্তির উন্নতি এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তার ফলিত প্রয়োগ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তির এক পর্বান্তরের উপরে— তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটি স্তরে পৌঁছচ্ছে যা ইতিপূর্বে কল্পনারও অতীত ছিল। অন্য দিকে, উন্নয়নের তত্ত্বে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব পেয়েছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টার’ এবং ‘ইনোভেশন ইকোসিস্টেম’-এর উন্নতি। একই ভৌগোলিক অঞ্চলে এক জাতীয় বা পরস্পরসম্পর্কিত অনেকগুলি কারখানা বা দফতরের সমাহার হলে তাকে ‘ক্লাস্টার’ বলা যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে কিছু বিশ্বখ্যাত ক্লাস্টারের কথা বলা যায়— সিলিকন ভ্যালি, কেমব্রিজ হাইটেক ক্লাস্টার, তামিলনাড়ুর তিরুপুর ক্লাস্টার, বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাস্টার ইত্যাদি।
একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে থাকার কারণে ক্লাস্টারের বেশ কিছু সুবিধা আছে: দক্ষ শ্রমিক পেতে সুবিধা হয়, বিনিয়োগকারী বা উপভোক্তাদের খুঁজতে কষ্ট কম হয়, অনেকগুলি একই ধরনের শিল্প এক জায়গায় থাকলে নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদানের (নেটওয়ার্কিং) মাধ্যমে প্রত্যেকেই লাভবান হতে পারে। এ কারণে ক্লাস্টার এবং তা থেকে ইকোসিস্টেম তৈরির মাধ্যমে শিল্পবিকাশের চেষ্টা অনেক দেশেই দেখা গিয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে ‘ইকোসিস্টেম’ কথাটির অর্থ হল, এই বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে চলে আসে একই ভ্যালু চেনে থাকা ছোট, মাঝারি, বড় বিভিন্ন সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কাঁচামালের জোগানদার, এই সমস্ত কিছু। এই সব কিছুর সমাহারে এবং পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ সম্ভব, এটাই ইকোসিস্টেম ধারণার মূল কথা।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নতুন শিল্পনীতির আলোচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে ভারতে যে রাজ্যগুলিতে শিল্পনীতি ঘোষিত হয়েছে, সেগুলি হল (বন্ধনীতে শিল্পনীতির ঘোষিত মেয়াদ): তামিলনাড়ু (২০২১-২৬), গুজরাত (২০২৩-২৮), কর্নাটক (২০২০-২৫), রাজস্থান (২০২২-২৭), ঝাড়খণ্ড (২০২১-২৬), অন্ধ্রপ্রদেশ (২০২৩-২৭), হরিয়ানা (২০২০-২৫), ওড়িশা (২০২২-২৭), মহারাষ্ট্র (২০১৯-২৪) এবং উত্তরাখণ্ড (২০২১-২৫)। এই তালিকাটিতে একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে— এই রাজ্যগুলি কিন্তু কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের দ্বারা শাসিত নয়; ভারতে যত গোত্রের রাজনৈতিক রং রয়েছে, কার্যত প্রতিটিরই প্রতিনিধিত্ব আছে এই তালিকায়। অর্থাৎ, শিল্পনীতির প্রয়োজন সবাই অনুভব করছে। তালিকায় খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিছু অনুপস্থিতিও আছে বটে।
তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলির মধ্যে বেশ কিছু রাজ্যের শিল্পনীতির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বিষয়টি আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এই রাজ্যগুলি কর্মসংস্থানের উপর ভিত্তি করেই কোনও শিল্পকে সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কর্মসংস্থানের বিষয়টি মূলত দু’ভাবে দেখা হয়েছে— এক, সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি; এবং দুই, কর্মসংস্থান ভর্তুকি বা নতুন শ্রমিকের প্রশিক্ষণে ভর্তুকি। অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলিই প্রশিক্ষণে ভর্তুকির রাস্তা নিয়েছে।
এই রাজ্যগুলির শিল্পনীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? এক, বিনিয়োগের পরিমাণ অনুসারে বড় (লার্জ), অতি বড় (মেগা) এবং সর্বাধিক বড় (আলট্রা মেগা) মূলত এই তিন (অথবা চার) ভাগে প্রজেক্টগুলিকে ভাগ করা হয়েছে; দুই, প্রকল্পগুলিকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আছে স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড়, প্রশিক্ষণে ভর্তুকি, জমি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে একগুচ্ছ সুবিধা, সবুজ শিল্পায়ন বা গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে আরও কিছু বিশেষ সুবিধা প্রদান; তিন, শিল্পের সুষম ভৌগোলিক বিকাশের জন্য জেলাগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সর্বাধিক সুবিধা প্রদানের দিক থেকে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলি— তামিলনাড়ু, গুজরাত, তেলঙ্গানা— প্রায় সমপরিমাণ সুবিধা প্রদান
করছে। এর পরেই আছে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশ।
নতুন শিল্পনীতি তৈরিতে সরকারের ভূমিকা ঠিক কী রকম? সরকার কি শুধু ছাড় দিয়েই দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন তামিলনাড়ুর কথা। দেশের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক কারখানা এই রাজ্যে আছে। দেশের সবচেয়ে বেশি শিল্পশ্রমিক এই রাজ্যে, শিল্প উৎপাদনেও এই রাজ্য প্রথম সারিতে রয়েছে। গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ, বস্ত্রশিল্প, পাম্প, মোটর, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, হালকা ও ভারী কারিগরি যন্ত্রাংশ নির্মাণ— সবগুলিতেই তামিলনাড়ু বর্তমানে দেশের মধ্যে অগ্রণী। এই ধরনের শিল্পগুলির রফতানির ক্ষেত্রে এবং বিদেশি বিনিয়োগের দিক থেকেও তামিলনাড়ু সামনের সারিতে আছে। শিল্পে এই ভাল ফলের কারণ হিসাবে রাজ্যের উন্নত শিল্প ইকোসিস্টেম-এর কথা উল্লিখিত হয়।
২০১৪-র শিল্পনীতির পরে তামিলনাড়ু পরবর্তী শিল্পনীতি প্রকাশ করেছে ২০২১ সালে। পাশাপাশি, ‘তামিলনাড়ু স্টার্ট আপ অ্যান্ড ইনোভেশন পলিসি ২০১৮-২৩’, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পলিসি ২০২০’, ‘ব্লকচেন পলিসি ২০২০’, সানরাইজ় সেক্টরগুলির জন্যে ‘রিসার্চ অ্যান্ড টেকনলজি অ্যাডপশন ফান্ড’— এই ধরনের নীতিগুলি তৈরি হয়ে চলেছে। শিল্পের বাস্তুতন্ত্রে স্বভাবতই তার প্রভাব পড়ছে। গত দশ বছরে বিশ্বব্যাপী শিল্পব্যবস্থা এমন ভাবে বদলে গিয়েছে যে, এই তৎপরতা ব্যতীত উপায় নেই।
পরিশেষে কিছু অমীমাংসিত জায়গার কথা উল্লেখ করা দরকার। যদি বা ভারতের রাজ্যগুলি ক্লাস্টার এবং শিল্পের ইকোসিস্টেম তৈরি করতে সচেষ্ট হয়, সে ক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ হবে ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য ছোট ও মাঝারি শিল্পকে এই নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসে তাদের বিকাশ সাধন করা। না হলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিপুলতার মধ্যে— ব্যাপক উদ্ভাবন, শিল্প বিনিয়োগের তাৎপর্যপূর্ণ স্থান পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে— ভারতের লক্ষ-লক্ষ ছোট-মাঝারি শিল্প মার খাবে। আজকের এই সতত পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন শিল্পনীতি রচনা এক সাধনার বিষয়। এবং নিঃসন্দেহে এই সাধনা সহজসাধ্য নয়। যাঁরা এটা পেরেছেন তাঁরা লাটাই থেকে ল্যাপটপ, সুতো থেকে সুতিবস্ত্র সব কিছুরই বরাত পেয়েছেন। আর যাঁরা পারেননি, তাঁদের হাতে রইল শুধু ছেঁড়া ঘুড়ি! এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যও কি শিল্পনীতি নিয়ে নতুন ভাবে ভাবা প্র্যাকটিস করবে? সময়ই বলবে সে কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy