—প্রতীকী ছবি।
আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীপক্ষে থাকলে সরকারের দিকে আঙুল তুলে নির্ঘাত বলতেন, রাজ্যে জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। প্রায় ছ’দশক আগে নিজেরই সরকারের বিরুদ্ধে ঠিক এমন শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। তারও পরিপ্রেক্ষিত ছিল প্রধানত আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রিক। সেই থেকে এই বাক্যবন্ধটি বেশ চালু।
এখন সেটি মনে পড়ার কারণ রাজ্যে এখনকার কিছু পরিস্থিতি— যার আড়ালে এক শ্রেণির পুলিশ, অফিসার এবং শাসক দলের একাংশের মধ্যে গড়ে ওঠা বিবিধ দুষ্টচক্রের মাথা তোলা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায়। আরও উদ্বেগের বিষয়, এটা আজ শুধু ভাগে-যোগে টাকা খাওয়াতেই থেমে নেই, জনজীবনে গুরুতর আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া থেকে কলকাতার হাসপাতাল পর্যন্ত একাধিক ঘটনা তার গরম নিদর্শন।
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা অবশ্য নিজের সরকারকে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ বলার মতো কোনও বিপ্লব ঘটাননি। বরং যা করলেন, সেটা ইদানীং কালের নিরিখে তাঁর ক্ষেত্রে কম ব্যতিক্রমী নয়। অতি দ্রুত নিজের পুলিশ, নিজের প্রশাসন, নিজের দলকে কাঠগড়ায় তুলে তিনি এ বার এক দিকে ‘রাজধর্ম’ পালনের বার্তা দিতে চাইলেন, অন্য দিকে বিরোধীদের পালের হাওয়া আপাতত কিছুটা রুখে দিতে পারলেন। হয়তো রাজ্যপাল তথা কেন্দ্রের তৎপরতাতেও খানিক আগল দেওয়া যাবে।
বিগত দিনগুলিতে একের পর এক ঘটনায় প্রশাসক মমতার পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কামদুনি-কাণ্ড, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড, আনিস-কাণ্ড থেকে শুরু করে হাল আমলের শাহজাহান-কেলেঙ্কারি বা কেন্দ্রীয় এজেন্সির ধরপাকড়ের মতো আলোড়ন তোলা অধ্যায়গুলি নজর করলে বোঝা যাবে, তিনি প্রথমেই দল, পুলিশ, প্রশাসন সকল পক্ষকে কার্যত আড়াল করার চেষ্টা করে এসেছেন। একাধিক ক্ষেত্রে এমন কথাও বলে ফেলেছেন, যাতে বিরোধী পক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্তকে ‘প্রভাবিত’ করার অভিযোগ তুলতে পেরেছে। এমনকি, বড় কোনও ঘটনায় তাঁর ব্যবস্থা গ্রহণের মাত্রা নিয়েও নানা সময়ে বিতর্ক হয়েছে। সেই দিক থেকে মমতার বর্তমান ভূমিকা পর্যবেক্ষকদের নজর কাড়ে।
তবে সবচেয়ে আগে প্রশ্ন হল, ‘পরিবর্তিত’ মমতার লক্ষ্য কি শুধুই ‘রাজধর্ম’ পালন? মানুষের সামনে প্রশাসনের ‘স্বচ্ছতা’ প্রতিষ্ঠিত করা? ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে চতুর্থ বার ক্ষমতা দখলের লড়াইতে সরকারের ঝকঝকে চেহারা দেখানো তাঁর কাছে নিঃসন্দেহে খুব জরুরি। বিশেষ করে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সির মোকাবিলা যখন তাঁদের বড় চ্যালেঞ্জ।
তথাপি মনে হয়, আরও কিছু অঘোষিত চ্যালেঞ্জও তাঁর সামনে রয়েছে। যেগুলি প্রশাসক ও দলনেত্রী, দুই মমতার কাছেই আজকের দিনে সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিজের মুঠি শক্ত করার মাধ্যমে তিনি এ বার কি তবে এক ঢিলে অনেক পাখি নিশানায় রাখছেন? অনেকের ধারণা সেই রকম।
মমতার দলে অভিষেক সেনাপতি, এটা আজ তৃণমূলে প্রচলিত তত্ত্ব। আবার এমনও গুঞ্জন আছে, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়ে অভিষেকই সংগঠনের মুখ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। দলে আদি-নব্য টানাপড়েন সত্ত্বেও দেখা যায় অভিষেকের কর্তৃত্ব মজবুত। যেটা ক্ষমতার আর একটি ‘ভরকেন্দ্র’। সভাপতি বা অন্য পদাধিকারীরা কাগজে-কলমে থাকলেও তাঁদের ভূমিকা যেন ‘নেপথ্যে মৃত সৈনিক’। এ বারের লোকসভা ভোটে দলের অন্যতম প্রবীণ এবং মমতা-ঘনিষ্ঠ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের চেষ্টা যে কার্যত রাস্তায় নেমে এসেছিল, তা-ও আর গোপন নেই। এ সবই দলের অন্দরের চাপ। মমতাকেও যা নিরন্তর নিতে হয়।
এরই পাশাপাশি আছে প্রশাসনে শাসক দলের অদৃশ্য ছায়াপাত। কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করুন বা না-করুন, যে দল যখন সরকারে থাকে, তখন সেই দলের সাংগঠনিক কর্তার সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের উপরমহলে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দলীয় কর্তার বহু পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া, অফিসার বাছাই ইত্যাদি প্রশাসনের অন্দরে ‘গুরুত্ব’ পায়। অফিসারেরাও চেষ্টা করেন ক্ষমতাসীন দলে ক্ষমতাশালী নেতার ‘মন জুগিয়ে’ চলতে। যুগে যুগে অতুল্য ঘোষ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসরা এই রকম প্রভাব ‘কাজে’ লাগিয়েছেন। তাঁদের চাওয়া ‘মান্যতা’-ও পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, এখন অভিষেক রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের দলীয় প্রধান। বাকিটা অনুমানসাপেক্ষ!
তবে লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বড় জয়ের পর থেকেই মনে হচ্ছিল, সব যন্ত্র বোধ হয় এক সুরে বাজছে না। ভোট মিটিয়ে নবান্নে ঢুকে মমতা যে ভাবে আমলা ও পুলিশ কর্তাদের কাজকর্ম পর্যালোচনা শুরু করেন এবং কয়েকটি রদবদল ঘটান, ওয়াকিবহাল অনেকের চোখে তা তাৎপর্যপূর্ণ বোধ হয়েছে।
ঘটনাচক্রে এই সময়ই অভিষেক ঘোষণা করে দলের কাজ থেকে ‘সাময়িক ছুটি’ নিলেন। মমতার পুরনো সঙ্গী, দলের সভাপতি সুব্রত বক্সীকে বহু দিন পরে সহসা ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় দেখা গেল। তাঁর মাধ্যমে নেত্রী মমতা এখন দলের রাশও নিজের হাতে নিয়েছেন। দ্রুত স্পষ্ট হচ্ছে, সরকার ও দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি পুরনো মেজাজে ফিরতে চাইছেন।
কয়েক দিন আগে দেখেছি, যত্রতত্র হকার বসানো, বেআইনি নির্মাণ, জবরদখল ইত্যাদির বিরুদ্ধে মুখ খুলে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং দুষ্টচক্রের কথা বলেছেন। কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তাঁর প্রশাসন, পুলিশ এবং দলীয় নেতা-কাউন্সিলরদের একাংশকে। বলেছেন, কাউকে ছাড়া হবে না। প্রয়োজনে গ্রেফতার করাও হতে পারে। তাঁর উষ্মার তালিকায় দলের নবীন-প্রবীণ বিচার ছিল না। ‘রাজধর্ম’ ঠিকই। একই সঙ্গে কর্তৃত্বের চাবি যে তাঁর আঁচলে, সেটা জানান দেওয়াতেও কোনও কার্পণ্য নেই। এটাই মমতার আকস্মিক ও অর্থবহ ‘বদল’।
উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং কলকাতার হাসপাতাল দুই জায়গায় যা ঘটেছে, চরিত্রে তারা মোটামুটি এক। অর্থাৎ, মহিলাদের রাস্তায় ফেলে পেটানো। চোপড়ায় পেটাল তৃণমূল বিধায়কের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দুষ্কৃতী। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে রোগীর আত্মীয়াকে লাঠি পিটিয়ে ‘শায়েস্তা’ করার সরকারি কর্তব্য পালন করল পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার, যারা সকলেই পুরুষ!
যুক্তি-তর্কে এই ধরনের ঘটনার অভিঘাত ঢেকে দেওয়া বা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের চেষ্টা হলে তা যে শাসকের বিরুদ্ধে যাবে, এটা বুঝতে নবান্ন এ বার দেরি করেনি। তাই তৃণমূল নেত্রী যখনই জানতে পারেন, চোপড়ায় অভিযুক্ত দুষ্কৃতী তাজিমুল তাঁর দলের বিধায়ক হামিদুল রহমানের প্রশ্রয়ে পুষ্ট, তখনই বিধায়ককে শো-কজ়ের নির্দেশ দেন তিনি। চোপড়ায় মহিলাকে (সঙ্গে এক পুরুষকেও) রাস্তায় ফেলে কঞ্চি দিয়ে পেটানোর ভিডিয়ো সামনে আসে রবিবার। স্থানীয় সূত্রে খবর, এটা ঘটেছিল শুক্রবার। জেলার পুলিশকর্তা কবুল করেছেন, ঘটনাটি তাঁরা রবিবার ভিডিয়ো দেখে ‘জানতে’ পারেন।
এখন তো সবার হাতে হাতে মোবাইল। তবু পুলিশ খবর ‘জানত না’! এই কি তাদের সোর্স? এই তাদের দক্ষতা? এর পরেও কি এই সব আইনরক্ষকের উপর কোনও আস্থা রাখা যায়? সূত্রের খবর, ‘রাজধর্ম’ মমতাকে এই সবই ভাবাচ্ছে। শুধু ওসি-কে শো-কজ় করাতেই বিষয়টি থামবে না। প্রয়োজনে তিনি আরও উপরে যাবেন।
সদ্য লোকসভা ভোটে তৃণমূল দার্জিলিঙে হারলেও চোপড়া বিধানসভা এলাকায় ৯০/৯২ হাজার ভোটে এগিয়ে। সেই দলের ধ্বজাধারীরাই বা তখন কী করছিল? নবান্নের তদন্তে এগুলিও আছে। খাস কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, পুরুষ পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার এক মহিলাকে ইমার্জেন্সির বাইরে ফেলে পেটাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী এ ক্ষেত্রেও কঠোর মনোভাব নিয়েছেন।
একটি-দু’টি ঘটনা দিয়ে সামগ্রিক বিচার হয়তো ঠিক নয়। একটি-দু’টি পদক্ষেপও হয়তো শেষ কথা বলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সময়, পরিস্থিতি সবই পরিবর্তনসাপেক্ষ। তবে নিজে রাশ ধরে, মুখ্যমন্ত্রী সর্বসমক্ষে ‘রোগ’ খোলসা করে দিয়েছেন। ক্ষমতাই এখন ক্ষমতার শত্রু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy