—ফাইল চিত্র।
আমাদের একটা ‘এথিক্যাল সোশ্যালিজ়ম’ আর পাশাপাশি একটা ‘এথিক্যাল সেকুলারিজ়ম’ ছিল। অর্থাৎ নৈতিক সমাজবাদ আর নৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা। ‘ভদ্রলোক সমাজবাদ’, ‘ভদ্রলোক ধর্মনিরপেক্ষতা’ও বলতে পারি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় দু’টি ক্ষেত্রেই নেহরুর প্রভাব থাকলেও, দু’টিই প্রধানত কমিউনিস্টদের অবদান। কমিউনিস্টরা যে এদের কোনওটিকেই ঠিকমতো তত্ত্বায়িত করেছিলেন তা নয়। পার্টি লাইন, পার্টি প্রোগ্রামেও এই দু’টি আদর্শ তেমন গভীর স্থান পায়নি। তবে সমাজতত্ত্ববিদ স্টুয়ার্ট হলের ভাষায় বলা যায়— এরা “কাজ করত ইতিপূর্বেই তৈরি হয়ে ওঠা সামাজিক চর্চা আর যাপিত মতাদর্শের জমির উপর।”... “এই উপাদানগুলি— দীর্ঘ সময় পার করার ফলে একটা ঐতিহ্যের অনুরণন জাগাত, আর জনমানসেও বেশ দাগ কাটতে পারত— সেগুলিকেই ব্যবহার করে গড়ে উঠেছিল” কমিউনিস্ট রাজনীতি।
সমাজবাদ তথা সাম্যবাদ নিয়ে একটা সুন্দর সমাজের অস্পষ্ট ছবি বা ভিশন কখনও কোনও কমিউনিস্টদের মনে থাকলেও কদাচিৎ সেটা মিশন হয়ে উঠেছে। সেই মিশনেও আবেগ যত ছিল চিন্তাভাবনা ততটা নয়। আসলে নিজেদের মতাদর্শে তাঁরা নিজেদেরই তত্ত্বায়িত করেননি। ফলে মুখে আদর্শের কথা বললেও পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানানসই করে নিজেদের আর্থিক উন্নতি বা ক্ষমতার ভোগদখল করতে তাঁদের অসুবিধে হয়নি। নব্বইয়ের দশক থেকে সোভিয়েটের পতন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ধাক্কায় সেই মৌখিক আদর্শটুকুও বিলীন হয়ে গেল। বাইরে তার কিছু ছাপ অবশ্য থেকে গেল। যেমন গরিবের সঙ্গে ভাল ব্যবহার (চট করে তুই/তুমি নয়, আপনি সম্বোধন), নিজের বাড়ির পরিচারিকার মাইনে বাড়াতে গায়ে লাগলেও কলকারখানায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে সমর্থন, নিজের ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে আমেরিকায় পাঠানোর উচ্চাশার পাশাপাশি গরিবের ছেলেমেয়ের সাক্ষরতার অধিকারটুকু স্বীকার করে নেওয়া (তাতেও অবশ্য ১৯৮১-২০০১ বাম জমানার এই কুড়ি বছরে সাক্ষরতার হারে পশ্চিমবঙ্গ যে ছ’নম্বরে ছিল তা-ই থেকে যায়)। ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন ভাল মতো থেকে গেল। ‘আমি তোমাদের লোক’ যদি বা বলা যায়, ‘তুমি আমাদের লোক’ কদাপি নয়।
সেকুলারিজ়মের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কমিউনিস্টরা কোনও দিনই নিজেদের রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ককে ঠিকমতো সংজ্ঞায়িত করেননি। এই সম্পর্কের একটা বিরাট পরিসর ছিল। ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ তো ছিলই। গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপুজোর দখলের মাধ্যমে কমিউনিস্ট প্রভাব বিস্তারের কিছু উদাহরণ জানি। প্রায় ক্ষেত্রে কমিউনিস্টরাই ছিলেন পাড়ার পুজোর উদ্যোক্তা। নেতারা ‘পুজোর শুভেচ্ছা’ নয়, ‘শারদীয়া শুভেচ্ছা’ পাঠাতেন। আর মণ্ডপে থাকত মার্ক্সবাদী বইয়ের স্টল। কলকাতার এক কমিউনিস্ট ব্রাহ্মণ তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজোর এমত ব্যাখ্যা দিতেন, এ পুজো তো ন্যায়ের উদ্যাপন। লক্ষ্মী সমৃদ্ধির প্রতীক, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক লড়াকু কমিউনিজ়মের আর গণেশ সংসদীয় কমিউনিজ়মের। তা ছাড়া পুজো একটা সামাজিক বন্ধন তো তৈরি করে, এ পুজোয় শুধু হিন্দুরাই নয়, শিখ ও মুসলমানরাও যোগ দেয়। ‘ভদ্রলোক সেকুলারিজ়ম’ যতই অস্পষ্ট হোক, সত্যি করে ধর্মনিরপেক্ষতা তার না-ই থাকুক, ধর্মীয় সহনশীলতার সদিচ্ছাটুকু ছিলই। বস্তুত এটাই ছিল সেকুলারিজ়মের ‘কমন সেন্স’ অর্থ। মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনও বৈরিতা যে মাথা তোলেনি, এটা নিশ্চয়ই অনেকটা কমিউনিস্ট প্রভাবের ফল। তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানদের নিষ্ক্রমণ বা স্থানচ্যুতি ও ‘গেটো’য় নির্বাসন তাঁরা আটকাতে পারেননি। বস্তুত হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিয়ে তাঁরা যত মাথা ঘামিয়েছেন, মুসলমানদের নিয়ে তত নয়; যদিও আর্থ-সামাজিক সুযোগসুবিধা প্রায় কিছুই না পেয়েও মুসলমানরা দীর্ঘ দিন তাঁদের সমর্থক ছিল। ফলে অ-মুসলমান কমিউনিস্টরাও কেউ কেউ ‘শুভ বিজয়া’ বলতে লজ্জা পেলেও সোল্লাসে ‘হ্যাপি ইদ’ বলতেন। বাম জমানায় ধর্মের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্কটি বেশ অস্পষ্ট আর অব্যক্ত হয়েই ছিল। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের দূরত্ব বজায় রাখার প্রাথমিক নীতি বজায় ছিল। সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে পুজো দিতে গিয়ে পার্টির কাছে তিরস্কৃত হয়েছিলেন।
আমি কিন্তু এখানে কমিউনিস্টদের কথাই শুধু বলছি না, বলছি সামগ্রিক ভাবে ভদ্রলোকদের কথা। যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নিরিখে আধুনিক বাংলার ইতিহাসের একটা পর্যায়ে অ-ব্রাহ্ম ভদ্রলোকদেরও ‘হাফ-বেহ্ম’ বলে অভিহিত করেছেন কোনও কোনও ইতিহাসবিদ, সেই নিরিখে ষাট/সত্তরের দশক থেকে বহু ভদ্রলোককেই বোধ হয় ‘হাফ-কমিউনিস্ট’ বলা যায়। কিন্তু বৃহৎ ঐতিহাসিক শক্তিকে ঠেকানোর মতো আত্মপ্রত্যয় ভদ্রলোক সংস্কৃতির ছিল না। তাই নব্বইয়ের দশক থেকে সংস্কৃতিটা দ্রুত বদলাতেও লাগল। কমিউনিস্টরাও উঠে পড়লেন ক্যাপিটালিজ়মের ব্যান্ডওয়াগনে। বাম জমানায় গ্রামের দিকে স্থানীয় নেতৃত্বে জমিদার-জোতদারদের জায়গা নিয়েছিলেন মোটামুটি উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তরাই, যাঁদের মধ্যে সরকারি সুবিধাভোগী স্কুলশিক্ষকরা প্রচুর সংখ্যায় ছিলেন। এ বার তাঁদেরও জায়গা ক্রমশ নিতে থাকলেন ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায়ী, ইটভাটার মালিক, রেশন-ডিলার গোছের লোকজন। দ্রুত এসে গেল লুটপাটের ধনতন্ত্র। অন্য দিকে, ১৯৯২-এর বাবরি দাঙ্গা বাংলাকেও ছাড়ল না, এই সময় থেকেই ভদ্রলোকের নিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ্যে আসতে লাগল। তদুপরি ব্যাঙের ছাতার মতো মন্দির গজিয়ে ওঠা, পুজোর ক্রমবর্ধমান ঘটা, প্রায়শই ধর্মীয় আগ্রাসন। জাতপাত নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির দ্বৈততাও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠল, আগে যেটা খবরের কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপনে লুকিয়ে থাকত। মণ্ডল কমিশন, মিড-ডে মিল জাতিগত পক্ষপাতকে একেবারে প্রকট করে দিল। অথচ জাত-ধর্ম-শ্রেণি সব বিভাজন বজায় রেখেই পার্থিব লেনদেনের ভিত্তিতে তৈরি হয়ে উঠল এক বিরাট ক্ষমতার কাঠামো তথা সর্বগ্রাসী ‘পার্টি সোসাইটি’ (দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের শব্দবন্ধ)— একের পর এক নির্বাচনী সাফল্যের উৎস ।
বাম জমানার কিছু বিশ্লেষণ বিদ্যায়তনিক স্তরে পেয়েছি। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক আকচাআকচিতে যত দড়, বিশ্লেষণে (বিশেষত আত্ম-বিশ্লেষণে) ততটা নই। বিশ্লেষণের দরকার বোঝার জন্য এখনও অনেকে গেলাস অর্ধেক খালি না দেখে অর্ধেক ভর্তি দেখছেন, আর সেই পুরনো সংস্কৃতির উপরেই ভরসা রাখছেন তা ভর্তি করার জন্য। গেলাসের মস্ত ফুটোটাকে দেখতে পাচ্ছেন না, বা দেখলেও ভাবছেন যে বঙ্গীয় বামপন্থী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েই ফুটো বোজানো যাবে। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী নব্য ধনতন্ত্রের মোকাবিলার কোনও প্রকল্পও যেমন কমিউনিস্টদের নেই, নেই সঙ্কীর্ণ অস্মিতার রাজনীতির জবাবও। অস্মিতার ভিত হিসাবে সারা দুনিয়ায় ধর্মের রাজনীতিকরণ হয়েছে। এ দেশে দেখছি হিন্দুরাষ্ট্রের রাজনীতির সামনে দাঁড়িয়ে সামগ্রিক ভাবেই রাজনীতির ধর্মাচ্ছন্নতা। সেকুলারিজ়মের অর্থ দাঁড়িয়েছে প্রতিযোগিতামূলক ধর্মাচরণ। বামফ্রন্টের উত্তরসূরি শাসক লুটপাট ও লেনদেনের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নেওয়া এবং খয়রাতি সংযোজনের পাশাপাশি অনেকটা ধর্মীয় রাজনীতি করেই ‘পার্টি সোসাইটি’কে শক্তপোক্ত করেছেন। কমিউনিস্টরা কী করবেন জানেন না। বরাবরই তাঁদের একটা সহজ পন্থা ছিল খুব সঙ্কীর্ণ অর্থে সংস্কৃতির চর্চা, নাচ গান নাটক ইত্যাদি। কিন্তু তাতে কতিপয় ভদ্রলোকের আত্মতৃপ্তি হলেও বাস্তবটা বদলানোর নয়। সম্প্রতি নির্বাচনে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রুখে দেওয়ার উল্লাসের মধ্যেই বন্ধুদের (কেউ কেউ একদা সিপিএম-ঘনিষ্ঠ) কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পেয়েছি যে, মুসলমান জনসংখ্যা ভয়ানক বেড়ে যাচ্ছে, তাদের জন্যই আমরা চাকরি পাই না, শিগগিরি তারা হিন্দুদের বাড়িঘর দোকানের দখল নেবে ইত্যাদি।
রাজনীতিতে কোনও ক্রমে এক পা এগোলেও সামাজিক ভাবে আমরা দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছি না তো? এর মোকাবিলা করতে হলে কিন্তু ‘পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা/ আর চলিবে না’। মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের চিন্তা দরকার, যে চিন্তার সঙ্গে বোধ হয় যুক্ত থাকা দরকার মানুষ তৈরির প্রকল্প এবং যার প্রতি-আধিপত্য চারিয়ে দেওয়া দরকার গোটা সমাজে। নিছক নির্বাচনের কথা ভাবলে সেটা সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে সঙ্ঘ পরিবারের কাছ থেকে হয়তো কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে। বহু বছর ধরে আরএসএস নীরবে এ ধরনের আধিপত্য বিস্তারের কাজ করে গেছে, ফলে আজ মনে হচ্ছে শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজেও বিপ্লবটা ওরাই এনে ফেলল— কংগ্রেস গান্ধীয় সমাজকর্মের উত্তরাধিকার বহন করেও, বা কমিউনিস্টরা ‘পার্টি সোসাইটি’ তৈরি করেও যে কাজটা করতে পারলেন না। আজকের দাবি হল এক সম্পূর্ণ নতুন আর সত্যিকারের বামপন্থা: মননশীল, সাহসী আর আন্তরিক বামপন্থা, “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy