উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য দেশভাগে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফাইল চিত্র।
উত্তরবঙ্গকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা মাঝেমধ্যেই হাওয়ায় ভাসছে। অন্যতম যুক্তি, এ ভাবেই নাকি উত্তরবঙ্গের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব। উত্তরবঙ্গের তথাকথিত অনুন্নয়ন-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যই নাকি পুনর্গঠন জরুরি। আলাদা রাজ্য হলেই তবে উত্তরবঙ্গের প্রতি বঞ্চনা দূর হয়ে যাবে?
অখণ্ড বঙ্গদেশ থেকে শুধু পশ্চিমবঙ্গ— এই ছুরিকাঘাতের ক্ষত নিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। ছিন্নমূল হওয়ার রক্ত শুকোতে না শুকোতেই আবার বাংলা ভাগের কথা উঠছে, অবাক হতে হয়। উত্তরবঙ্গের হাজারো সমস্যা নিরসনের দাবিতে প্রতি দিনই নতুন আন্দোলন দেখা দিচ্ছে। তবে কি এই বিভাগ-বিভাজনের গল্প উত্তরবঙ্গের মূল সমস্যাগুলি থেকে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার বিশেষ উদ্যোগ? ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো করার পর প্রমাণিত— ছোট রাজ্য গঠন হলেই উন্নয়নের বন্যা আসে না। ক্ষমতার টেবিলে বসে মানচিত্রে পেনসিলের দাগ কেটে, একটা জাতির, বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর ইতিহাস ভূগোল, নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বকে নস্যাৎ করা যায় না।
১৮৭৪, ১৯০৫ ও ১৯৪৭-এ বাংলার সীমানা নির্মাণ-বিনির্মাণ, অদলবদলের স্মৃতি আজও বিষণ্ণ করে। ১৯৪৭-এর দিনাজপুর, মালদহ ও জলপাইগুড়ির মুসলিম ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার মধ্যে র্যাডক্লিফের সীমান্ত নির্ধারণ সহজ হয়নি। ঔপনিবেশিক আমলের সীমানা বদলের ইতিহাস ও রাজনীতি এখানকার ভূমিপুত্রদের জীবন ও জীবিকায় প্রভাব ফেলেছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পর্বে সেটাই সঙ্কীর্ণ পরিচয়বাদী রাজনীতির দাবার ঘুঁটিতে পরিণত। স্বাধীন ভারতে আজও সেই ক্ষমতার রাজনীতি উত্তরবঙ্গকে নানা ভাবে ভাগ করতে চাইছে। উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ ভুলতে পারেন না যে, ১৯৪৭-এ শুধু বাংলাই ভাগ হয়নি, সঙ্গে ভাগ হয়েছে ধর্মের নামে মানবিকতা, হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা জাতির আত্মপরিচয়সম সংস্কৃতিও।
উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য দেশভাগে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক ইতিহাস আলাদা করে লেখাই হল না! সেই ইতিহাস বলে, অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চল অষ্টম শতাব্দী থেকে পূর্ব হিমালয়ের তিব্বতের এবং পরে ভুটান ও সিকিমের শীতকালীন বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। শীতের সময় এই সমতলের প্রবেশদ্বার ছিল ভুটানের পথদুয়ার। এই দুয়ার সন্নিহিত এলাকাগুলি এখনকার ডুয়ার্স। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর এই ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়। উত্তরবঙ্গে যে জেলায় যা বিখ্যাত তার ব্যবসাই ছিল ইংরেজদের এখানে থাকার কারণ। যেমন মালদহের রেশম, আম, ধান। রংপুর, দিনাজপুরের চাল, চিঁড়ে, গুড়। জলপাইগুড়ির পাট, চা, তামাক, কাঠ। জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিঙে বনসম্পদ প্রচুর। কোম্পানির কর্মচারীরা কাঠের ব্যবসায় নেমেছিলেন। তখন কাঠের আসবাবপত্র ও রেললাইনের কাঠের খুব চাহিদা ছিল। প্রথমে অসমে, পরে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির চা-বাগান বাণিজ্যক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার রংপুর, জলপাইগুড়িতে বেসরকারি ব্যাঙ্কব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উত্তরবঙ্গে চা, কাঠ, পাট, তামাক, চিনি ইত্যাদির বিপণন ব্যাঙ্কের আওতায় আসে। কিন্তু দেশভাগের পর উত্তরবঙ্গ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, যোগাযোগ— সব দিক থেকেই প্রান্তিক হয়ে যায়। কোচবিহার রাজ্য রাজার হস্তচ্যুত হয়ে একটি জেলায় পরিণত হয়। রাজার উত্তরসূরিরা কলকাতায় এবং পছন্দমতো জায়গায় চলে যান। তাঁদের কিছু স্থাবর সম্পত্তি রয়ে যায় ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সীমানার ভিতর, যা আজ ছিটমহল নামে পরিচিত।
উত্তরবঙ্গ বরাবরই কলকাতার শিল্পের কাঁচামাল জোগানদার। উত্তরবঙ্গ থেকেই পাট আর বাঁশ যেত কলকাতার পাটকলে, কাগজকলে। জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ৫০টি চা-বাগানের মুখ্য কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এক সময় উত্তরবঙ্গের বিত্তবান নেতারাই তরাই, ডুয়ার্স ও অসমে চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। সেগুলির মালিকানায় আজ আর তাঁরা নেই। স্বাধীনতার পর নেপাল-ভারত যৌথ চুক্তির ফলে নেপাল থেকেও প্রচুর মানুষ উত্তরবঙ্গে এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। অসম, মেঘালয়, ভুটান থেকে উৎখাত হয়ে তাঁরা বিভিন্ন চা-বাগানে আশ্রয় নিয়েছেন, বনবিভাগের জমিতে বসতি গড়ে তুলেছেন। দেশভাগে উত্তরবঙ্গের রেলপরিবহণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চা-শিল্পের অগ্রগতির জন্য লন্ডনের সংস্থা ‘বেঙ্গল ডুয়ার্স রেল’ তৈরি করে। ১৯১৫-য় পদ্মা নদীতে হার্ডিং ব্রিজ চালু হলে দার্জিলিং মেল উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের ব্যবস্থায় যুগান্তর আনে। দেশভাগে তা থেমে যায়। উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত রেলপথের পাঁচটি ‘সেকশন’ দেশভাগের ফলে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এত উদাহরণেই স্পষ্ট, সে কালের অর্থনীতিতে উত্তরবঙ্গ কতখানি প্রাসঙ্গিক ছিল। প্রশাসকদের সুবিধা, রাজনৈতিক নেতাদের শক্তিবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মুনাফা লাভের জন্য পরাধীন ও স্বাধীন ভারতে উত্তরবঙ্গ ভাগাভাগির চেষ্টা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের মানুষ কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই উপকৃত হননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy