Advertisement
৩১ জানুয়ারি ২০২৫
Food

খাওয়ার পাতে রাজনীতি

২০১৯-২১ সালের সরকারের নিজের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য গবেষণা দেখায় প্রায় ৭৫ শতাংশ ভারতীয় কখনও না কখনও আমিষ খেয়েছেন।

—প্রতীকী ছবি।

শ্রেয়া ঠাকুর
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২২
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচনের আবহে সাধারণ মানুষের খাবারের পাতে প্রবেশ করল রাজনীতি। সেই রাজনীতির জন্য আর গোমাংসের প্রয়োজন পড়ছে না— প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, নবরাত্রি ও ‘সাবন’ চলাকালীন আমিষ খেলে তা ‘মোগল-মানসিকতা’র প্রকাশ। জানা যাচ্ছে, দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের বহু রাজ্যে এই সময় প্রশাসনের অনতিপ্রচ্ছন্ন অঙ্গুলি নির্দেশে বাজারে কার্যত বন্ধ হয়েছে মাছ-মাংসের বিক্রি।

সংবিধান অনুসারে আহারের স্বাধীনতা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এখানেই শাসক দলের সূক্ষ্ম কারসাজি— প্রথমে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া যে, ‘মোগল’ অর্থাৎ মুসলমানরা ভারতের শত্রু, তার পর আমিষাশীদের দেগে দেওয়া ‘মোগল’ বলে।

আমিষ-নিরামিষের এই প্রচারিত দ্বন্দ্বে একটি কথা স্পষ্ট— বিজেপি তার জন্মদাগ গোপন করতে পারে না কোনও মতেই। গোটা দেশে তার নির্বাচনী বিজয়কেতন উড়বে কি না, সে প্রশ্ন ভিন্ন— কিন্তু, বিজেপি কোনও মতেই সর্বভারতীয় দল নয়। দলটি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের উচ্চ ও মধ্যবর্ণের হিন্দু পুরুষের। সে দলের যাবতীয় নৈতিকতাও সেই পরিচিতি থেকেই আহৃত। ফলে, সর্বভারতীয় বহুত্বকে হজম করা বিজেপির পক্ষে শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। বারে বারেই এই কথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্বেও তা হয়েছে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় উচ্চবর্ণের হিন্দু মূলত নিরামিষাশী, ফলে বিজেপির নৈতিকতা বলে, অন্তত পূজাপার্বণের সময় নিরামিষ খাওয়াই বিধেয়। অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিতে যে ভিন্ন কথা বলতে পারে, তা মানার মতো নমনীয়তা দৃশ্যত বিজেপির নেই।

২০১৯-২১ সালের সরকারের নিজের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য গবেষণা দেখায় প্রায় ৭৫ শতাংশ ভারতীয় কখনও না কখনও আমিষ খেয়েছেন। এখনও সুযোগ বা সামর্থ্য থাকলেই খেয়ে থাকেন। ২০১৮ সালে দেশের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, মাত্র পাঁচটি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরামিষাশী— রাজস্থান (৭৫%), হরিয়ানা (৬৯%), পঞ্জাব (৬৭%), গুজরাত (৬১%) ও হিমাচলপ্রদেশ (৫৩%)। দক্ষিণ ভারত ও ভারতের পূর্বাঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রাচীন ও স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস আমিষ। উত্তরপ্রদেশেও শতকরা ৫৩% মানুষ আমিষ খান।

আর মোগল প্রভাব? ইতিহাস বলছে, আকবরের বঙ্গদেশ বিজয় ১৫৭৬ সালে। তার প্রায় সমসাময়িক কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল-এ ফুল্লরার জবানিতেই রয়েছে— “দেবীর প্রসাদ মাংস সবাকার ঘরে।” আর বণিকরমণী খুল্লনার খাবার? দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন কবি, ‘চিথলের কোল’, ‘মীনে রসাল মুসুরি’— মাছে ভাতে তৃপ্ত বঙ্গবালা। অর্থাৎ, মোগল পা রাখার আগে থেকেই আমিষ রয়েছে মানুষের পাতে। আমিষের সন্ধান মেলে গোবলয়ের আরাধ্য দেবতা রামের যাপনেও।

খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে রুচি ও সংস্কৃতির উপর। জড়িয়ে থাকে পরিবার বা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসও। হিন্দু ধর্মে কিন্তু বহুত্ব ও বৈচিত্রকে বরাবর স্থান দেওয়া হয়েছে। গণেশ-বজরংবলীর নিরামিষ ভক্তও হিন্দু, আবার কালী-শিব-দুর্গার আমিষ ভক্তটিও হিন্দু। আবার ইব্রাহিমের কন্যা বনবিবির ‘জহুরানামা’-র বিশ্বাসী শ্রোতা সুন্দরবনের মধুসংগ্রাহকদের মধ্যেও হিন্দু ধর্মের মানুষ রয়েছেন। এই উদার বহুত্বের কারণেই এখনও এক মধ্যবিত্ত আমিষাশীর বাড়ি থেকে মাংস রান্নার গন্ধ এলে তেড়ে যান না মধ্যবিত্ত নিরামিষাশী। বর্তমান নব্য হিন্দুত্ববাদ অবশ্য সেই বহুত্বের সুরটুকু ধরতেই চায় না। বরং, মানুষের সংস্কারের ধরন বুঝে মগজধোলাই করতে তৎপর।

হিন্দু ধর্ম একটি যাপনচর্যা। হিন্দুত্ববাদ হল সেই ধর্মের নামে বিদ্বেষমূলক একনায়কতন্ত্রের পরিকল্পনা। যাতে হিন্দুধর্মকে সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রে বেঁধে ফেলে কায়েমি ভাবে চালু করা যায় ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’-এর জয়যাত্রা। গেরুয়াপন্থীদের দাবি, আমিষ মানুষকে হিংস্র করে তোলে। এ দিকে, আমিষ শুনলেই তেড়ে আসা, পিটিয়ে মেরে ফেলা দলটি নিরামিষাশী বলে দাবি করে নিজেদের। অদ্ভুত এক অসহিষ্ণু ‘বিশুদ্ধ শাকাহারী’ মানসিকতা এখন চার পাশে। শব্দটির ব্যবহার উল্লেখ্য— ‘বিশুদ্ধ’। আসলে, একনায়কতন্ত্রের দু’টি স্তম্ভ। প্রথমটি হল নিজেদের অত্যাচারিত, বঞ্চিত মনে করা। দ্বিতীয়, নিজেদের চিন্তাই সঠিক ভাবার প্রবণতা। এর সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে অশিক্ষা, উচ্চবর্ণ হওয়ার অহঙ্কার ও অন্য মানুষের প্রতি শীতল ঘৃণা।

আতঙ্ক জাগে যখন দেখি, মানুষ সংস্কারবশত হিন্দুত্ববাদকেই হিন্দু ধর্ম মনে করছেন। তার আড়ালে লালিত বিদ্বেষ থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। সমাজমাধ্যমের খাবারের গ্রুপগুলোয় নবরাত্রির ভোগের ছবি এখন উপচে পড়ে। শ্রাবণ মাসে সবুজ চুড়ি, পোশাক, নিরামিষ খাবারের প্রণালী নিয়ে আলোচনা হয়। উস্কানিমূলক মন্তব্যেরও কোনও খামতি নেই— ‘ঝটকা না হালাল’, এই প্রশ্নের কমেন্টবাক্সে বহু মানুষের মুখোশ খুলে যায়।

হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের এই প্রচার থেকে বহু দিন ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিবিদ্বেষ চুইয়ে পড়ে দেশের বহুত্ববাদের আত্মাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন তা গড়িয়ে এসে ঠেকেছে খাবার থালায়। রুখে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় আছে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Food Post Editorial Lok Sabha Election 2024 PM Narendra Modi BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy