Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
football

ক্রিকেটে পারি, ফুটবলে পারি না

নতুন কিচ্ছু বলার নেই, সমস্যাগুলো আমরা সবাই মোটামুটি জানি। টাকা নেই, সহায়-সম্বল নেই। কেউ কেউ সরকার বা বিজ্ঞাপনদাতাদের দুষবেন।

খেলোয়াড় তৈরি করা বা প্রশিক্ষণ বা তালিম দেওয়া বা দক্ষতায় শাণ দেওয়ার জন্য দুটো খেলাতেই পুরো পিচ-টাই লাগে।

খেলোয়াড় তৈরি করা বা প্রশিক্ষণ বা তালিম দেওয়া বা দক্ষতায় শাণ দেওয়ার জন্য দুটো খেলাতেই পুরো পিচ-টাই লাগে। ফাইল চিত্র।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:২৫
Share: Save:

১৯৭৮ থেকে ২০২২, আমাদের অনেকেরই জীবনে সাকুল্যে এই এক ডজন বিশ্বকাপ ফাইনাল টেলিভিশনের পর্দায় দেখার উন্মাদনা, যা এখনও একটুও টসকায়নি; আটাত্তরে পাসারেলা-কেম্পেস, ছিয়াশির মারাদোনা-বুরুচাগা, আজ মেসি-আলভারেজ়ের জন্য গলা ফাটাচ্ছি একই ভাবে। ফুটবলের দেশতালিকাটা আমরা অবশ্যই বেশি দেখছি না, যেখানে আমাদের অবস্থান একশো-দেড়শো দেশের পরে। উইকিপিডিয়া-মতে, বর্তমানের ফিফা র‌্যাঙ্কিং-পদ্ধতি শুরু হয় ১৯৯২-এ; এর মধ্যে, ভারতের জাতীয় দলের সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্ক ছিল চুরানব্বই, ১৯৯৬ সালে। আর সর্বনিম্ন একশো-চুয়াত্তর, ২০১৫ সালে! এ সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী। বরং চার-বছর অন্তর-অন্তর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দু’-ভাগে ভাগ হয়ে যাক গোটা দেশ। সেই ভাল।

নতুন কিচ্ছু বলার নেই, সমস্যাগুলো আমরা সবাই মোটামুটি জানি। টাকা নেই, সহায়-সম্বল নেই। কেউ কেউ সরকার বা বিজ্ঞাপনদাতাদের দুষবেন। নেই রোল-মডেল, তুলে ধরার মতো দেশি নেতা, নেই কোনও তেমন-মাপের বিদেশিও। কেউ বা বলবেন আসল কথা হল আমাদের প্লেয়ারদের কোনও দক্ষতাই নেই, মুখেই মারিতং জগৎ। শুধু তা-ই নয়। কথা উঠবে শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টির অভাব, প্রযুক্তির অপ-ব্যবহার, এমনকি, সামাজিক-অসাম্যেরও।

বিপরীতে যুক্তিও কম নেই। টাকা, সরকারি সাহায্য, বেসরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত পরিমাণেই তো এসেছে, গত দশ বছরে তো বটেই। ইউরোপের মতো না হলেও নয়, আমাদের ফুটবল লিগে পেশাদারিত্বের যথেষ্ট ছাপ পড়েছে। এ ছাড়া, খেলোয়াড়দের গড়নও বিশ্বমানের সমতুল-প্রায়; আর, ভারতকে জগৎসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে ইচ্ছা আর উন্মাদনা তো বেড়েছেই। তা হলে?

নিশ্চয়ই ক্রিকেটের কথাটা উঠবে। ১৯৮৩-র পর থেকে ক্রিকেট ছাড়া বাকি সব খেলার অধঃপাতে যাওয়ার জন্য গাল পাড়া হয় তো সেই ক্রিকেটে বিশ্বজয়কেই, আর সবেধন আইপিএল-কে।

কথাটা ভুলও নয়, বিশেষ করে, দলগত খেলার ক্ষেত্রে। গত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে যে সব খেলাতে আমাদের আক্ষেপ কিছুটা হলেও কমেছে, সেগুলো প্রায় সবই ব্যক্তিগত খেলা, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, দাবা। ইতিমধ্যে বহু দিনের অপেক্ষার পরে অলিম্পিক্সেও ধারাবাহিক সাফল্য এসেছে, তবে তা হকির মতো দলগত খেলার হাত ধরে নয়, ব্যক্তি-স্তরে, কুস্তি, ভারোত্তোলন, শুটিং, তিরন্দাজি ইত্যাদিতে।

তা হলে কি দলগত খেলা বলতে আমাদের দেশে শুধু ক্রিকেটই বেঁচে থাকবে? না কি, ক্রিকেটের মতো টাকা এলেই তবে ফুটবলের উন্নতি হবে?

মনে রাখতে হবে, তুলনাটা কিন্তু করা হচ্ছে ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা ময়দানের ক্রিকেট-ফুটবলের সঙ্গে আজকের যুগের। অন্য কোনও দেশের সঙ্গে নয়, অন্য কোনও খেলার প্রেক্ষিতেও নয়। আগেকার দিনে চুনী পিকে বলরাম-এর যুগের ব্যক্তিগত দক্ষতা আমাদের ময়দানের ফুটবলে কৃশানু বিদেশ-এর সময়ও যেমন ছিল, এখনও কিছু কম নেই। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের সর্ব স্তরে, জেলায়-জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায়, ফুটবল খেলার সংখ্যা বা মানও কিছু কমেনি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত কিশোরদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখার ঘাটতিও কমেনি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা কমলেও তা উধাও হয়ে যায়নি। তা হলে ক্রিকেট-ফুটবলের তফাত কোথায় ঘটল? বিশ্বক্রিকেট আর ফুটবলের জগতের একটা বড় তফাত আলোচনা হয় না: পিচ। দুটো খেলায় পিচ শব্দটার দুটো ভিন্ন অর্থ। বল করার জন্য বাইশ গজ হল ক্রিকেটের পিচ; আর, ফুটবলের পরিভাষায় গোটা মাঠটাকেই বলে ফুটবল পিচ। প্রথমটার দৈর্ঘ্য ২০ মিটার, অন্যটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হল ১০৫-৬৮ মিটার।

খেলোয়াড় তৈরি করা বা প্রশিক্ষণ বা তালিম দেওয়া বা দক্ষতায় শাণ দেওয়ার জন্য দুটো খেলাতেই পুরো পিচ-টাই লাগে। গত কয়েক দশকে আমাদের জেলাশহরে, এমনকি গ্রামেও অজস্র ক্রিকেটের মাঠ, এমনকি পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে; সেই মাঠগুলোর সাইজ় ছোট-বড় যা-ই হোক না কেন, পিচের সাইজ় কিন্তু সবারই এক, বাইশ গজ। মুশকিল হল, আন্তর্জাতিক আয়তনের ফুটবল পিচ দু’-চারটে বড় স্টেডিয়াম ছাড়া রাজ্যের কোত্থাও মিলবে না। পাড়ায় পাড়ায় ১০৫-৬৮ মিটারের ফাঁকা জায়গা পাবেন কোথায়?

এ দিকে এর মধ্যে বিশ্বমানের ফুটবলে ব্যক্তিগত দক্ষতা শব্দটার সংজ্ঞাই গেছে বদলে। আগে ফুটবলে দক্ষতা বলতে বোঝাত এক-দু’জনকে কাটানো বা ড্রিবলিং, গোলে শট মারা, ডিফেন্ড করা, গোল বাঁচানো, ইত্যাদি। এই সব দক্ষতা শেখানোর জন্য তো আর পুরো ১০৫-৬৮ লাগত না, এখনও লাগে না। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে খেলাটাই এখন অন্য, মেসির মতো ব্যক্তিকেও বুঝতে হয় ১০৫-৬৮ মিটার জুড়েই এই দলগত খেলাটা খেলতে হয়। পায়ের সব ‘কাজ’ ছকে ফেলতে হয় ‘বড়’ মাঠে। আর সেটা শিখতে গেলে গ্রামের বা জেলার ‘ছোট’ মাঠ পর্যাপ্ত নয়।

এখানেই ইউরোপ তো বটেই, এমনকি লাটিন আমেরিকার দেশগুলোও এগিয়ে গেছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের কথাই সাধারণত আমরা জানি; কিন্তু তার তলায় আরও চারটে লিগে খেলে প্রায় একশোটা দল, তার বাইরেও আছে আরও কয়েকশো ক্লাব। নিচু স্তরের সেই সব ক্লাবের মাঠ আন্তর্জাতিক মানের না হলেও, পিচ-এর সাইজ় ফিফার মাপের।

অগত্যা, ভারতের, আমাদের রাজ্যের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক মানে তুলতে হলে আগে চাই পিচ। যে খেলার যা দাবি। বিশ্ব ফুটবলের মাঠের সাইজ় একই, বড়-ছোট মাঠ বলে কিছু হয় না। সর্ব স্তরে এই সাইজ়ের মাঠ আগে চাই; দলগত খেলার পরিবেশ চাই। বড়-মাঠের খেলোয়াড় তবেই মিলবে।

কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

football India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE